ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আমাদের দেখা হোক মহামা‌রির পরে

মাসুদ করিম

প্রকাশিত : ০৫:৪৬ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

মাসুদ করিম

মাসুদ করিম

এক

সকা‌লে অফিসে যাওয়ার প্রস্তু‌তি নি‌চ্ছি। এখনও কিছুটা সময় হা‌তে আছে। ভাবলাম, একটা গান শুন‌লে ভাল লাগ‌বে। ভেরা লি‌নের ‘উই উইল মিট এগেইন’ গানটা শুনলাম। গা‌নের কথাগু‌লি অনেক সুন্দর।

‘উই উইল মিট এগেইন / ডোন্ট‌নো হোয়ার, ডোন্ট‌নো হো‌য়েন / বাট আই নো উই উইল মিট এগেইন সাম সা‌নি ডে’।

ইং‌রেজ গী‌তিকার রস পার্কার ও হিউই চার্লস লি‌খে‌ছেন ও ক‌ম্পোজ ক‌রে‌ছেন। সুরটা অপূর্ব। ভেরা লিন গে‌য়ে‌ছেন দারুণ । দ্বিতীয় বিশ্বযু‌দ্ধের সম‌য়ে ১৯৩৯ সা‌লে গান‌টি গে‌য়ে আলোড়ন তু‌লে‌ছি‌লেন। ১৯১৭ সা‌লের ২০ মার্চ জন্ম নেয়া ভেরা অনেক জন‌প্রিয় গা‌নের গা‌য়িকা। পাশাপা‌শি, তি‌নি গী‌তিকার ও অভি‌নেত্রীও।

সংকটকালে অনেক দারুণ কিছু সৃ‌ষ্টি হয়। বাংলা‌দে‌শের মু‌ক্তিযু‌দ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কে‌ন্দ্রের গানগু‌লি তেম‌নি অমর সৃ‌ষ্টি ।

দুই

ব্রাক্ষণবা‌ড়িয়ার গতকা‌লের ঘটনাটা কিছু‌তেই মাথা থে‌কে যা‌চ্ছে না।

জুবা‌য়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় এক লা‌খের বে‌শি লোক সম‌বেত হ‌য়ে‌ছেন। লোকটার নাম আমি আগে কখনও শু‌নি‌নি। বাংলা‌দেশ খেলাফত মজ‌লিস না‌মের এক‌টি রাজ‌নৈ‌তিক দ‌লের সি‌নিয়র সহ সভাপ‌তি। তার জানাজায় লো‌কের ঢল দে‌খে ম‌নে হয়, ওই অঞ্চ‌লে তার দ‌লের ভাল সংগঠক তি‌নি।

বাংলা‌দে‌শে ইসলাম শব্দ যুক্ত ক‌রে দ‌লের নাম দি‌য়ে রাজনী‌তি ক‌রে এমন দ‌লের সংখ্যা এক ডজ‌নের বে‌শি হ‌বে। তার বাইরেও ইসলা‌মের না‌মে নানা কর্মকাণ্ড প‌রিচা‌লিত হয়। এদের ব্যাপা‌রে সৈয়দ ওয়া‌লিউল্লাহ তাঁর লালসালু উপন্যা‌সে অনেক আগে লি‌খে‌ছেন, ধ‌র্মের চে‌য়ে ধ‌র্মের আগাছা বে‌শি। এখনও অবস্থার তেমন প‌রিবর্তন হয়‌নি। এসব কর্মকাণ্ড ইসলা‌মি প‌রিচ‌য়ের দেশগু‌লোর আচার অনুষ্ঠা‌নের স‌ঙ্গে মি‌লে না।

ক‌রোনাভাইরা‌সের মহামারির সম‌য়ে সৌ‌দি আর‌বে মক্কায় প‌বিত্র ক্বাবা শ‌রিফ ও মদীনায় মস‌জি‌দে নববী‌সহ সকল মস‌জি‌দে জামায়া‌তে নামাজ নি‌ষিদ্ধ করা হ‌য়ে‌ছে। তারাবি ও ঈদের জামায়াত নি‌ষিদ্ধ। ওমরাহ পালন বন্ধ। প‌রি‌স্থি‌তির উন্ন‌তি না হ‌লে হজও বন্ধ হয় কিনা নি‌শ্চিত হয়‌নি এখনও। সৌ‌দি আর‌বের স‌ঙ্গে অনেক বিষ‌য়ে ভিন্নম‌তের ইরান ও তুরস্কও একই প‌থে হাঁট‌ছে।

মহামারি কিংবা যুদ্ধকা‌লে ইসলামি চর্চার নিয়ম কিংবা এ বিষ‌য়ে মহানবী (সাঃ) কী শিক্ষা দি‌য়ে‌ছেন সে সম্প‌র্কে আমার জ্ঞান সী‌মিত। ত‌বে আমি এটা বল‌তে পা‌রি, বিশ্বব্যা‌পি এ মূহু‌র্তে যেভা‌বে ইসলাম চর্চা হ‌চ্ছে, তার স‌ঙ্গে ব্রাক্ষণবা‌ড়িয়ায় আনসারীর অনুসারী‌দের ইসলাম চর্চায় কোনও মিল নেই। সে কার‌ণে কো‌ভিড-১৯ নি‌য়ে গোটা বি‌শ্বের মি‌ডিয়ায় এ খবর প্রচার হ‌য়ে‌ছে। নিশ্চয়ই বিশ্ববা‌সী এখান থে‌কে অনেক কিছু শিখ‌বে!

বি‌শ্বের মানুষ এটাও শিখ‌বে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সামা‌জিক দূরত্ব বজায় রাখার গাইডলাইন লংঘন ক‌রে জানাজার না‌মে শোডাউন আ‌য়োজন করায় বাংলা‌দেশ খেলাফত মজ‌লি‌সের নেতা‌দের বিরু‌দ্ধে বাংলা‌দেশ সংক্রামক ব্য‌াধি (প্র‌তি‌রোধ, নিয়ন্ত্রণ, নিরমূল) আইন ২০১৮ প্র‌য়োগ হয়‌নি।

‌তিন

যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, মহামারি, মন্বন্তর, অর্থ‌নৈ‌তিক মন্দা প্রভৃ‌তির পর বি‌শ্বের কোনও না কোনও দে‌শে সাধারণত দু‌র্ভিক্ষ হয়। ত‌বে কোথায় সেটা হ‌বে সেটা আগেভা‌গে বলা মুশ‌কিল। দু‌র্ভি‌ক্ষে অনেক সময় মহামারির চে‌য়ে বে‌শি মানুষ মারা যায়। ২০০৭-০৮ সা‌লের মন্দার সম‌য়ে আফ্রিকায় দাঙ্গা হ‌য়ে‌ছিল। ক‌রোনাভাইরা‌সের মহামারির ফ‌লে ‌বি‌শ্বে দু‌র্ভিক্ষ, বেকারত্ব ও সামা‌জিক অ‌স্থিরতার আশঙ্কা উ‌ড়ি‌য়ে দেয়া যা‌চ্ছে না।

‌বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বল‌ছে, গ‌রিব লোক‌দের খাদ্য দি‌তে না পার‌লে দু‌র্ভি‌ক্ষে তিন কো‌টি মানুষ মারা যা‌বে। আন্তর্জা‌তিক শ্রম সংস্থা বল‌ছে, বি‌শ্বে ২০ কো‌টি মানুষ বেকার হ‌বে। আন্তর্জা‌তিক মুদ্রা তহ‌বিল বল‌ছে, কর্মসংস্থান সৃ‌ষ্টি না হ‌লে সৃ‌ষ্টি হ‌বে সামা‌জিক অস্থিরতা।

‌কো‌ভিড ১৯ সংক্রম‌ণে বি‌শ্বে ক‌য়েক লাখ মানুষ মারা যাওয়ারে আশঙ্কা করা হ‌লেও না খে‌য়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা তার চে‌য়ে বে‌শি মানু‌ষের। এ ব্যাপা‌রে বি‌ভিন্ন দেশ বি‌ভিন্ন পদ‌ক্ষেপ নি‌চ্ছে।

বাহরাই‌নে বাংলা‌দে‌শের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলা‌মের স‌ঙ্গে কথা হ‌চ্ছিল। তি‌নি বল‌লেন, বাহরাইন সম্ভবত দ্রুত ঘু‌রে দাঁড়া‌বে। দেশ‌টি সা‌ড়ে ১১ বি‌লিয়ন ডলার প্র‌ণোদনা ঘোষণা ক‌রে‌ছে। তারা কো‌ভিড-১৯ পরীক্ষা ব্যাপকহা‌রে কর‌ছে ব‌লেও জানান তি‌নি।

বাংলা‌দে‌শের প‌রি‌স্থি‌তি‌তে দৃশ্যত ম‌নে হ‌চ্ছে দু‌র্ভিক্ষ হ‌বে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনা এক লাখ কো‌টি টাকা প্র‌ণোদনা ঘোষণা দি‌য়ে‌ছেন। বাংলা‌দে‌শের মানুষ দু‌র্যোগ মোকা‌বেলায় চ্যা‌ম্পিয়ন। তার ওপর বাংলা‌দে‌শে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে। বো‌রো ও আউশ উৎপাদন ভাল হ‌লে দু‌র্ভি‌ক্ষের আশঙ্কা কম। ২০০৮ সা‌লের মন্দাও বাংলা‌দেশের জনগণ সাফ‌ল্যের স‌ঙ্গে মোকা‌বেলা ক‌রে‌ছিল। আশা ক‌রি, এবারও পার‌বে।

চার

আমা‌দের অঞ্চল একা‌ধিক দু‌র্ভিক্ষ প্র‌ত্যক্ষ ক‌রে‌ছে। ১৯৪৩ সা‌লে দ্বিতীয় বিশ্বযু‌দ্ধের সম‌য়ে বেঙ্গ‌লে দু‌র্ভিক্ষ হ‌য়ে‌ছিল। এতে বেঙ‌লের ছয় কো‌টি মানু‌ষের ম‌ধ্যে ৩০ লাখ মানুষ ম্যা‌লে‌রিয়া, ক্ষুধা ও অন্যান্য রো‌গে মারা যায়। অপু‌ষ্টি, স্বাস্থ্য‌সেবার অভাবও দেখা দেয়। জ‌মি বি‌ক্রি ক‌রে গৃহহারা অনে‌কে কলকাতা চ‌লে যান কা‌জের খোঁজে। ওই দু‌র্ভিক্ষ সম্প‌র্কে অমর্ত্য সেন তার বই‌য়ে লি‌খে‌ছেন, খাদ্য ঘাট‌তির জ‌ন্যে নয়; বন্ট‌নে ত্রু‌টির জ‌ন্যে দু‌র্ভিক্ষ হয়।

১৯৭৪ সা‌লে বাংলা‌দে‌শে খাদ্য উৎপাদন ভাল ছিল। তখনও খাদ্য বন্ট‌নে বাজা‌রের কতৃত্ব এক গ্রু‌পের হা‌তে চ‌লে যাওয়ায় খাদ্য ঘাট‌তি দেখা দেয়। তার ওপর কিউবায় বাংলা‌দে‌শের পাট রফতা‌নির সিদ্ধা‌ন্তের প্র‌তিবা‌দে যুক্তরাষ্ট্র ২২ লাখ টন খাদ্য সহায়তা বন্ধ ক‌রে দেয়। বাংলা‌দেশ শেষ পর্যন্ত কিউবায় পাট রফতা‌নির সিদ্ধান্ত বা‌তিল ক‌রে। কিন্তু যুক্তরা‌ষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা এত দে‌রি ক‌রে যে দু‌র্ভিক্ষ ঠেকা‌নো যায়‌নি।

দু‌র্ভিক্ষ আরও অনেক কার‌ণে হয়। বন্যা, জনসংখ্যা বৃ‌দ্ধি, খাদ্য মজু‌দে সরকা‌রের অব্যবস্থাপনা, এক জেলা থে‌কে অন্য জেলায় খাদ্য সরবরা‌হে বাঁধা, প্র‌তি‌বে‌শি দে‌শে পাচার, খাদ্য বন্ট‌নে ব্যর্থতা। এসব বিষ‌য়ে সজাগ থাক‌তে হ‌বে।

লকডাউ‌নে মানুষ কর্মহীন। সরকার খাদ্য দি‌চ্ছে। কেউ কেউ বল‌ছেন, নগদ টাকা দি‌লে ভাল হয়। বাজা‌রে খাদ্য থাক‌লে মানুষ কি‌নে খে‌তে পার‌বে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়‌বে। ব্যাং‌কে তারল্য সংক‌টে প্র‌ণোদনার প্রভাব নি‌য়ে অনে‌কে শ‌ঙ্কিত। পৃ‌থিবী এক স‌ঙ্গে সংক‌টে প‌ড়ে‌ছে। কেউ কাউকে সাহায্য কর‌তে পার‌বে না। আত্ম নির্ভরশীলতার প‌থে হাঁট‌তে হ‌বে।

লেখক- সাংবাদিক

এমবি//