ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

খবরের ফেরিওয়ালাদের খবর

শাকেরা আরজু

প্রকাশিত : ০৬:২১ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:৫৫ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

রাকীনের আধো আধো কথা বলা শুরুর পর থেকে ওকে না দেখলে জাবেদ আখতারের ঘুম আসে না। ওর দুষ্টুমিতে অনাড়ম্বর ঘরটাও যেন আনন্দের মহল মনে হয়। আগেই মায়ের সঙ্গে যশোর গেছে রাকীন। তাকে ছাড়া একাকী জীবন কাটছে জাবেদের। করোনা ভয়ে ঢাকায় পরিবারকে ছাড়াই থাকছে সে। প্রিয় মুখটা মোবাইলে দেখে সাধ মেটে না তার।

জাবেদ আখতার এটিএন নিউজের রিপোর্টার। এমন ভয়াবহ মহামারির সময়েও দায়িত্ববোধ থেকে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। জাবেদের মত লড়ছে হাজারো সাংবাদিক। কখনো করোনা রোগীর সংবাদ সংগ্রহ, কখনো ডাক্তারদের নিরাপত্তাহীনতার খবরের পেছনে, কখনো বা অসহায়দের পাশে থেকে, আবার কখনো বা ত্রাণ চোরদের খবর সংগ্রহ করে। 

সাংবাদিক বাবা বাইরে সংবাদ সংগ্রহে যান বলে নিজের অতি প্রিয় সন্তানকেও একই ঘরে থেকে রাখছেন দূরে। কোন সাংবাদিক মা নিরাপদ স্থানে ছেড়ে যাচ্ছেন সন্তানকে। কোন সাংবাদিক আবার নিজে আক্রান্ত হয়ে পরিবারের জন্য হচ্ছেন বিপদের কারণ। কোনো কোনো সাংবাদিক পরিবার থেকে দূরে থাকছেন ইচ্ছা করেই। এমন হাজারো বাস্তবতার গল্প সংবাদের পেছনে কাজ করা এই মানুষগুলোর।

আমরা জানি মহামারির এ সংকটের সময় চিকিৎসক, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। মানুষের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে এসব মানুষ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। স্বাভাবিকভাবে তাদের পরিবার পরিজনকে সময় দিতে পারছেন না। 

গণমাধ্যমের সদস্যরা এসব মানুষদের ত্যাগের কথা বিভিন্নভাবে তুলে ধরছেন। এসব খুবই স্বাভাবিক চিত্র। সংকটের সময় যে যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা যারা জেনে শুনেই সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিকতা করছি, অন্যান্যরা যারা না পড়েও সাংবাদিকতায় এসেছেন আমার মনে হয় এ পেশার ঝুঁকি ও দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। 

এটা সত্য যে সাংবাদিকরা মানুষের জীবনের গল্প শোনান। মানুষের জীবনের কথা, সংকটের কথা, আনন্দ-বেদনার কথা তুলে ধরাই তাদের পেশা। জনগণ কোয়ারেন্টাইন মানছে কিনা, ঘরে খাবার আছে কিনা, খাবার কেউ চুরি করলো কিনা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ বিনা চিকিৎসায় মরলো কিনা, এসব তথ্যই পুলিশ, ডাক্তারের পাশে থেকে জানাচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। 

সবার ভালো মন্দের খোঁজ যারা পরিবেশন করেন তাদের নিজেদের জীবনেরও একটি গল্প আছে। সে গল্প শোনার সময় সুযোগ অবশ্য বেশিরভাগ মানুষেরই হয় না। অথবা বলা যায় মানুষের অগোচরেই থেকে যায় সাংবাদিকতা বা তাদের পরিবারের সুখ-দুঃখের কথা। গার্মেন্ট কর্মীরা বেতন পেলো কিনা সেটা জানাতে পারলেও নিজেদের বেতন না পাওয়ার কথা বলতে পারেন না তারা। 

করোনা পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছে এরই মধ্যে। জীবন আর জীবিকা বিপন্ন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত ১৭ জন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত। তাদের পরিবারের কোনো কোনো সদস্যও হয়েছেন আক্রান্ত। ব্যতিক্রম হলো ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেও তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন বা ঝুঁকিভাতা বলে সাংবাদিকদের জন্য তেমন কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতেও আবার অনেকের মনে চাকরি হারানোর ভয় দেখা দিয়েছে। কারণ, করোনার কারণে অনেক পত্রিকার বিজ্ঞাপন না থাকায় বন্ধ ঘোষণা করেছে। আবার অনেকে স্বল্প পরিসরে কাজ করছে। টেলিভিশনগুলোতেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

আমি আগেও বলেছি এ সময়ে ঝুঁকি নিয়ে বেশ কয়েকটি পেশার মানুষ কাজ করছেন। নিশ্চিতভাবেই স্বাস্থ্য কর্মীদের কাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অন্য পেশার মানুষেরা কম বেশি যার যার নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আবার তারা তাদের চাকরি বিধি অনুযায়ী কিছু সুযোগ সুবিধা পাবেন, ভাতা পাবেন, এসব নিয়ে কোন কথা বলছি না। 

অন্যদিকে, সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ তাদের গত মাসের বা বকেয়া বেতন পাবেন কি-না তারও নিশ্চয়তা নেই। এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা কিন্ত কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ, সংকটে দায়িত্ব আরও বাড়ে, যেটা আমাদের সাংবাদিক সমাজ জানে। বাংলাদেশের কোন সংকটেই সাংবাদিক সমাজ কখনো পিছিয়ে থাকেনি। বলা যায়, সবসময় তারা অগ্রগামী প্রতিনিধি হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইতিহাস সেটাই বলে। 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত কাজ করেছেন। আবার অনেক সাংবাদিক সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়ে শহীদও হয়েছেন। দেশের মানুষের সকল সংকট সম্ভাবনায়, স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন সবসময় এদেশের সাংবাদিকরা জীবন বাজি রেখে সঠিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। 

এখন সময় এসছে সাংবাদিকদের নিয়ে ভাবার। বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে সাংবাদিকদের বিষয়ে ভাবতে হবে রাষ্ট্র এবং গণমাধ্যম মালিকদের। একটা মহামারিতে কিভাবে সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করবেন তা নিয়ে এদেশে এখনও কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি। প্রশিক্ষণ, ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ কী পাবেন এসব প্রশ্নের উত্তর অজানা। যদি এই মহামারি দীর্ঘ হয় সে সময়ের ভাবনাও থাকা চাই।

বাড়ির পাশে ভারতেও বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত। চাকরিও হারিয়েছেন কেউ কেউ। সেই পরিস্থিতির বিবরণ দিতে গিয়েই ভারতীয় সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘কালান্তক করোনা মিডিয়াকেও রেয়াত করছে না। ভাতে এবং পাতে, দুই ক্ষেত্রেই মার খাচ্ছে মিডিয়া।’

আমরা আশাবাদি হতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের দেশের সরকার এবং গণমাধ্যম মালিকদের যথেষ্ট সামর্থ আছে আমাদের সুরক্ষা দেয়ার। করোনা মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আমরা চাকরি হারানোর আশঙ্কা বা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কা মুক্ত হতে চাই।

লেখক: সংবাদকর্মী

এআই/