সুচিত্রা সেন কেন স্বেচ্ছায় ৩৬ বছর হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০৭ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ১২:১১ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২০ বুধবার
কিংবদন্তী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। অপার রহস্যে ঘেরা একটি মানুষ। যিনি নিজের সম্মোহনী রূপ, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশকালেই সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে, দর্শকের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন এই নায়িকা।
বাংলা সিনেমার এই মহানায়িকার জীবনটা স্বপ্নকাতর বাঙালির কাছে ছিলো রূপকথাই। অনিন্দ্যসুন্দর মুখ, মূর্তিমতি লাবণ্য, সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় শারীরিক গড়ন ও অতুলনীয় অভিনয়ের সুবাদে তিনি পৌঁছেছিলেন খ্যাতির শিখরে।
সুচিত্রার চুল, চোখ, সাজগোজ ছিলো বাঙালি মেয়েদের কাছে ফ্যাশনের সমার্থক। তখনকার সমাজে পুরুষদের কাছে প্রেমিকার আদল ছিলেন তিনি।
কিন্তু দর্শক হৃদয়ে নিজেকে গভীরভাবে গেঁথে দিয়ে এবং আলোচনার ঝড় তুলে দিয়ে, হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। নিরবে-নির্জনে, এক স্বেচ্ছা নির্বাসনে ৩৬ বছর কেটেছে তার। সেই মানুষটি পরিবারের কাছে ছিলেন কৃষ্ণা, সমাজে ছিলেন রমা দাসগুপ্ত এবং চলচ্চিত্র জগতে এসে হয়ে উঠেছিলেন মহানায়িকা।
১৯৫২ সাল। ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রঙিন দুনিয়ায় পা রাখেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু অভিনয়ের অভিষেক সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। পরবর্তীতে তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ছিল ‘সাত নম্বর কয়েদি’। তবে এ সিনেমাও তাঁকে জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি। এরপর ১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমা দিয়ে সবার নজরে পড়েন। চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেন সুচিত্রা সেন। তারপর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বরং সেই জনপ্রিয়তার মাপকাঠি দিনের পর দিন ধরে এতটাই আকাশচুম্বী হয়েছিল যে, এখন পর্যন্ত বাংলার কোনো নায়িকাই তাঁর কাছাকাছি যেতে পারেননি।
অথচ অভিনয়জীবনের ২৫ বছর পর তাঁর রূপ-সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রেখেই নিজেকে পর্দার আড়ালে গুটিয়ে নেন নায়িকা। ফলে তাকে ঘিরে তৈরি হয় তুমুল আকর্ষণ, আবেগ, রহস্য ও কৌতূহল। তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্রের নাম ‘প্রণয় পাশা’। ১৯৭৮ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর কোনো সিনেমাতে অভিনয় করেননি। ঠিক এরপরই তিনি সকলের সামনে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নেন।
সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি তার মেয়ে মুনমুন, নাতনি রাইমা ও রিয়া, নিকটাত্মীয় এবং পারিবারিক ডাক্তার ছাড়া কারো সামনে আসেননি। এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন হাসপাতালে ভর্তি হন তখনও সাংবাদিকরা সেখানে অষ্টপ্রহর জেগে তার সাক্ষাৎকার কিংবা ছবি কিছুই পাননি। শেষ পর্যন্ত সকল কিছু থেকে নির্বাসন নেওয়া মানুষটি যখন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি পৃথিবী থেকেও নির্বাসন নেন, তখন তার ইচ্ছেমতোই কালো কাচে ঢাকা ভ্যানে কফিন বন্দী হয়ে তার দেহ পৌছায় শ্মশানে।
সফলতার তুঙ্গে থাকা, সকল পুরুষের স্বপ্নের নারী এবং সকল নারীর ফ্যাশন আইডলের কোনো ঘোষণা ছাড়া নির্বাসনে যাওয়ার কারণ আসলে কী?
এ নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নানান তত্ত্ব প্রকাশ হয়েছে। নিজেদের মত করে তাঁর চারপাশের রহস্যের প্রাচীরটাকে ভাঙতে চেয়েছেন অনেকেই। তবে এক কথা বলাই যায়, তিনি নিজেকে নিয়ে নানা মিথ্যার জন্ম দিয়েছিলেন।
সুচিত্রা সেনের নির্বাসন নিয়ে সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি উত্তম কুমার সম্পর্কিত। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল জুটি উত্তম-সুচিত্রা। সুচিত্রা সেন নাম নিলে সবার মনে উত্তম কুমার নামটা চলে আসে। সমস্যা বাঁধে সেখানেই। যখন চলচ্চিত্র জগৎ ছাপিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটির আভাস ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ে। সেই রেশ ধরে উত্তম-সুচিত্রা দু’জনেরই পারিবারিক জীবনে ঝড় নেমে আসে। যদিও তাদের প্রেমের সম্পর্ক রুপালি পর্দা ছেড়ে বাস্তবে রূপ নিয়েছে, এমনটি কেউ কখনোই স্বীকার করেননি। কিন্তু ‘অগ্নিপরীক্ষা’ চলচ্চিত্রের পোস্টারের নিচে লেখা ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হল অগ্নিপরীক্ষা’ এবং তার নিচে সুচিত্রা সেনের স্বাক্ষর উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে আলোচনার এক তুমুল ঝড় উঠিয়েছিল। তবে সেই লেখার ব্যাপারে কেউই কোনোদিন মুখ খোলেননি।
উত্তম-সুচিত্রা প্রেমের গুঞ্জন তাদের ব্যক্তিজীবনে নানান বিচ্ছেদের জন্ম দেয় বলেও মনে করা হয়। তাই ভক্তদের অনেকেই মনে করেন, অসুখী দাম্পত্যজীবন, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ও ১৯৬৯ সালে স্বামীর অকালমৃত্যু ও আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝোঁক সুচিত্রার ব্যক্তিজীবনে প্রভাব ফেলে। তাই তিনি রুপালী পর্দাকে এক ঝলকে টেনে ফেলে নিজের জীবনের পর্দা যখন টেনে দেন তখন সকলেই তাঁকে নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেন।
এছাড়াও ভক্তদের মনোজগতের মহানায়িকা হয়ে নানা আলোচনার ঝড় তুলে তিনি যখন অন্তরালে চলে যান, তখন অনেকেই বলেন যে তাঁর যৌবনের জোয়ার এবং সৌন্দর্য বিদায় নেয়ার আগেই তিনি সকলের থেকে বিদায় নিয়েছেন। এতে করে তাঁর ভক্তদের মণিকোঠায় যুগ যুগ ধরে থাকবে তাঁর একই চিত্র। যেই চিত্রে সুচিত্রার বয়স বাড়ে না, রূপ কমে না, তিনি থেকে যান পরমাসুন্দরী এক নারী। তাই সুচিত্রা সেন নিজেকে অমর যৌবন দান করে অন্তরালে নিজের মরণশীল দেহ ও আত্নাকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলেই মনে করেন ভক্তরা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন সুচিত্রা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে পরিবারের সঙ্গে তাকে কলকাতায় চলে যেতে হয়। পরের বছর কলকাতার শিল্পপতি আদিনাথ সেন তনয় দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর তাদের ঘর আলো করেন একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন। সুচিত্রার দুই নাতনি রাইমা সেন ও রিয়া সেনকে সবাই চেনেন। ১৯৫২ সালে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে চলচ্চিত্রাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন রমা সেন। তিনিও টালিউডের জনপ্রিয় তারকা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে আমাদের বিশ্বকেও এক বিশেষ এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে৷ সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই বাধ্যতামূলক এই ঘরবন্দী জীবনে সুচিত্রা সেনের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের একান্তভাবে নিজের পরিবার ও নিজের সাথে সময় কাটানো ছাড়া উপায় নেই। ৩৬ বছরের স্বেচ্ছাকৃত ‘হোম কোয়ারান্টাইন’ জীবনের সাধনাকে দৃষ্টান্ত ধরে আমরা অন্তত কিছুদিনের এই হোম কোয়ারান্টাইন মেনে চলব, এমনটাই আশা চলচ্চিত্র প্রেমীদের।
এসএ/