করোনা থেকে বাঁচতে দরকার সুদৃঢ় পরিকল্পনা
লায়লা নাজনীন
প্রকাশিত : ১২:৫৮ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৯:৫১ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার
লায়লা নাজনীন
আমাদের বাঙালিদের অভ্যাস হচ্ছে সব কিছু শেষ সময়ে গিয়ে করা। যেমন স্কুল কলেজের শেষ দিনে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ সম্পাদন করা। সময় থাকলেও অন্য দিনে করবে না। কারণ মনে করে সময় তো আছেই, সবার গা ছাড়া ভাব। আবার দেখবেন ঈদ পূজা বা অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠানে গ্রামের বাড়ি যাওয়া নিয়ে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। বাস বা ট্রেনের স্টেশনে টিকেটের জন্য দীর্ঘ লাইন।
অনেক সময় দেখা যায়, শেষ সময়ে গিয়ে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি-মারামারি, শুরু হয় একে অন্যকে পিছনে ফেলার প্রতিযোগিতা। এরপর শেষ পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস বা ট্রেনের ছাদে জানালায় ঝুলে ঝুলে রিস্ক নিয়ে বাড়ি যায়। এছাড়া যদি লঞ্চের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবেন, লঞ্চে অতিরিক্ত লোকজন উঠানোর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে লঞ্চডুবির ঘটনা। অবশেষে প্রাণটা হারাতে হয়।
কেন ভাই আমরা কী সবাই এতই ব্যস্ত যে, সময় পাই না। একেবারে ইসরাফিল (আ:) এসে শিঙ্গায় ফু না দেয়া পর্যন্ত আমাদের টনক নড়বে না। আমি মনে করি, এ বিষয়ে যদি আমাদের মৌলিক কোনো ভুল থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে আমাদের পরিকল্পনার অভাব। আমরা সব কিছুই অনেক সময় নিয়ে করতে পারি। এই যেমন ধরুন-শপিং করা, রেস্তোরাঁয় আড্ডা দেয়া, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া অন্যান্য সব কাজ আমরা করছি। কিন্তু জীবনে চলার জন্য সবচাইতে প্রয়োজনীয় যা সেটা করি না। সেটা হচ্ছে পরিকল্পনা। আমাদের গায়ন বুদ্ধি সবই আছে কিভাবে চাল চুরি করতে হবে, গরিবের হক মেরে খেতে হবে কিন্তু ভালো কাজের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নাই।
আমরা জানি, আমরা এখন যে সমস্যার সস্মুখীন হতে যাচ্ছি সেটা হচ্ছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট। আমাদের দেশে তিন রকম আয়ের লোক আছে উন্নত, মাঝারি এবং নিম্ন আয়ের মানুষ। এই তিন শ্রেণির আয়ের মানুষের মধ্যেও আবার পার্থক্য আছে। যেমন-বেশি উন্নত আয়, মাঝারি উন্নত আয় এবং স্বল্প উন্নত আয়। এককথায় উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম মধ্যবিত্ত। ধরা যাক, উন্নত আয়ের মানুষের পারিশ্রমিক বেশি সেই অনুযায়ী তাদের ব্যয়ও বেশি, তারপরও তাদের হাতে বেশ সঞ্চয় থাকার কথা যেটা দিয়ে সে অন্তত ৬ মাস থেকে একবছর চালিয়ে নিতে পারবে এ পরিস্থিতিতে।
মধ্যবিত্তরাও আয়ের কিছু অংশ জমিয়ে রাখে সেটা দিয়ে ২ থেকে ৩ মাস চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত, যারা দিন আনে দিন খায়। তাদের তো কোনো সঞ্চয় নাই। এখন এই উচ্চ আয়ের মানুষগুলো যদি একটু এগিয়ে আসেন, একটু দানশীল হন তাহলে হয়ত বেঁচে যেতে পারে এই গরীব মানুষগুলো। বিত্তবানদের একমাসের খরচ যদি কোনো পরিবারকে দান করে তাহলে ওই গরীব পরিবারটি নিঃসন্দেহে তিন থেকে চার মাস চলতে পারবে। আর সরকারীভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের যে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হচ্ছে তা যদি সুষ্ঠুভাবে বন্টন হয় তাহলে তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। বন্টনের ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ, সেনাবাহিনীকে দিয়ে করানো। তাহলে হয়ত সবাই সুষ্ঠুভাবে ত্রাণসামগ্রী পাবে।
এবার আসি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কথায়। বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতিতে মালিক-কর্মচারি সবাই খারাপ সময় পার করছে। এই পরিস্থিতিতে মালিক-কর্মচারি উভয়কেই বুঝতে হবে দুজনের অবস্থা। হতে পারে কোম্পানির কোনো এক দুর্দিনে যেই কর্মচারি আপনার সাথে ছিল আজ আপনি এই ভয়াবহ বিপদে তাকে বের করে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনি কি খুঁজে দেখেছেন কর্মী ছাটাই ছাড়া আর কোনো পথ আছে কিনা? এই কঠিন সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। কারণ তার চাকরি না থাকলে সে কি করবে। তারও তো পরিবার-সংসার আছে। এসব বিষয়েও দরকার সুন্দর পরিকল্পনা। কেউ অনাহারে থাকার চাইতে তো আমরা সবাই মিলে তার পাশে দাঁড়াতে পারি। এক কথায় কর্মী ছাটাই না করে কিভাবে একজন কর্মচারিকে বাঁচানো যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
এবার আসি ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে। এবারের ধাক্কায় যদি নিজেদের সামলিয়ে নিতে পারেন তো ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করুন। জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য ফান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট তৈরি করুন। অন্তত ৫-৬ মাসের। তা না হলে মিনিমাম ২-৩ মাসের। শুধু উদ্যোক্তাই নয় সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকেই বাধ্যতামূলক ফান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়া থাকা উচিত। বিপদ চলাকালীন সময়ে অন্তত ৬মাসের ফান্ড সরবরাহ করতে হবে। দরকার পড়লে উন্নত দেশগুলোর মতো ইনকাম ট্যাক্স প্রক্রিয়া জোরদার করে জনগণের হেলথ অ্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্স, বেকার ভাতা, বিপদকালীন ভাতা সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে অতি সত্তর।
সর্বোপরি আপামর জনতার কাছে বেশি আয় বেশি ব্যয় না করে যতটুকু আয় তার থেকে কম ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দেখা যায় আমরা যে যাই করি কিন্তু ফুটানিতে আমাদের কমতি নেই। এই ফুটানি মনোভাব বন্ধ করতে হবে। আপনি মরে গেলে আপনার জন্য কেউ আসবে না। সত্যিকারে চোখের জল ফেলতে তখন সবাই আহ উহু শো অফ করে চলে যাবে। দুই দিন পর আপনাকে ভুলে যাবে। তাই সময় হয়েছে শো অফ এর জীবন থেকে বের হয়ে এসে ঈমান আমল ঠিক রাখা।
এই পরিস্থিতিতে বাসা-বাড়ি থেকে যে না বের হই। এটা আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরে যদি ১৫ দিনের খাবার মজুত থাকে তাহলে সেটাকে টেনে টুনে ১ মাস করুন। তিন বেলা খেতেন এখন লাগলে দুই বেলা খান। দশকের রোজা রাখুন। রোজা রাখার তিন উপকারিতা। ১. সৃষ্টি কর্তার সন্তুষ্টি লাভ ২. খাবার খরচ কম ৩. আমরা সবাই জানি ফাস্টিং বডি ইমুনে সিস্টেমকে বুস্ট আপ করে। ইমুনে সিস্টেম স্ট্রং থাকলে কোভিড-১৯ এর সাথে আপনার বডি ফাইট করতে সক্ষম হবে। এই পরিস্থিতিতে যারা অফিস করছে আল্লাহ না করুন কোভিড-১৯ হলে তাদের এবং তাদের পরিবারের জন্য কোম্পানি কী পরিকল্পনা নিয়েছে সেটাও ভাববার বিষয়। যেমন নিউজ চ্যানেল, প্রিন্টিং মিডিয়া এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছে, তাছাড়া ডাক্তার নার্স ওয়ার্ড বয় যাদের জন্য সরকার কে নিতে হবে সুদৃঢ় পরিকল্পনা।
পারলে চিড়া খেজুর কিনে রাখেন এই খাবারগুলো অনেক দিন থাকে, নষ্ট হয় না। ঘরে কিছু না থাকলে জরুরি অবস্থায় চিড়া খেয়ে ১ গ্লাস পানি খেলে ক্ষুধা কম লাগে। কারণ চিড়া পেটের ভেতর গিয়ে ফুলে স্টমাক ভরে যায়। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, খাওয়ার জন্য বাঁচা না বাঁচার জন্য খাওয়া। তাছাড়া পেটের এক অংশ খালি রেখে খাওয়া হজমের জন্য উত্তম।
আসুন আমরা এই দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সক্রিয় হই, জীবাণুর সাথে লড়াইয়ে যার যার অবস্থান থেকে করি সঠিক পরিকল্পনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাই ভালো রাখুক। সুস্থ রাখুক। আমীন।
লেখক: হেড অফ এইচআর, স্টার সিনেপ্লেক্স
এমবি//