শ্রমিক সংকট কাটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধান কাটার উৎসব
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০২:০২ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলতি মৌসুমে হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যেই জেলার সদর উপজেলা,সরাইল, নাসিরনগর ও বিজয়নগর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে।
অন্যান্য বছর ধান কাটার মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর ধান কাটার শ্রমিক আসলেও চলতি বছর করোনা ভাইরাসের কারণে বহিরাগত শ্রমিকের সংখ্যা কম। এতে করে কর্মহীন অকৃষি শ্রমিক, ভ্যান-রিকশা চালক, বেকারী শ্রমিক, স্কুল ছাত্র, টেম্পুচালকসহ বিভিন্ন পেশার বেকার শ্রমিকরা ও অত্যাধুনিক ধান কাটা মেশিন ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে।
এদিকে বহিরাগত শ্রমিকের সংখ্যা কম থাকলেও ধান কাটায় কোন সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রবিউল হক মজুমদার।
তিনি জানান, ‘বহিরাগত শ্রমিক কম থাকলেও স্থানীয় অকৃষি শ্রমিক থাকায় ধান কাটায় কোন সমস্যা হচ্ছে না। এছাড়াও জেলায় ৪০টি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ধান কাটার ক্ষেত্রে কৃষকদেরকে সবধরনের সহযোগিতা করছেন।’
সরেজমিনে সরাইল উপজেলার ধরন্তি হাওর ও নাসিরনগর উপজেলার দাঁতমন্ডল হাওরে গিয়ে দেখা যায়, ধান কাটছেন অকৃষি শ্রমিকেরা। ধরন্তি হাওরে ধান কাটছেন বাবুর্চি হাসান, স্কুল ছাত্র মামুন, হকার মহরম ভূইয়া, রিকশা চালক ফজল মিয়াসহ অনেকে।
ধান কাটার ফাঁকে হাসান জানান, ‘তিনি ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। করোনার কারণে বর্তমানে হোটেল বন্ধ থাকায় তিনি গত একমাস ধরে নিজ বাড়ি সরাইলে আছেন। বেকার থাকায় সংসারের অভাব অনটনের কারণে বাধ্য হয়েই অন্যান্য লোকদের সাথে ধান কাটতে হচ্ছে।’
স্কুল ছাত্র মামুন জানায় সে উপজেলার জয়ধরকান্দি আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ। তাই বাবার সাথে সেও ধান কাটছে।
চট্টগ্রামে হকারের কাজ করা মহরম আলী ভূইয়া বলেন, ‘বর্তমানে বেকার হওয়ায় বাধ্য হয়েই ধান কাটতে নেমেছে। জীবনে আগে কখনো ধান কাটিনি, পরিস্থিতির শিকার হয়ে মাঠে নামতে হয়েছে।’
নাসিরনগর উপজেলার দাঁতমন্ডল এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ধান কাটার হিড়িক। ধান কাটা শ্রমিক প্রাণতোষ দাস বলেন, ‘এখনও হাওরে পানি আসেনি। যার কারণে মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ধান কেটে সংসারের খরচ চালাই।’
এদিকে ধরন্তি হাওরে জমির মালিক কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগে ধান কাটার মৌসুমে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ থেকে প্রচুর ধানকাটা শ্রমিক আসতো। করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছর আগের মতো প্রচুর শ্রমিক আসতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়েই এলাকার অন্যান্য পেশার কর্মহীন, বেকারদেরকে দিয়ে ধান কাটাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বাইরের পেশাদার ধান কাটার শ্রমিকদের চাইতে স্থানীয় শ্রমিকদের মুজুরি একটু বেশি।’
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রবিউল হক মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘চলতি বছর জেলায় ১ লাখ ১১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবাদ হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ পূরণ হয়েছে ‘
তিনি বলেন, ‘একভাগ কম হয়েছে রবি মৌসুমে কিছু জমিতে সরিষা, ভুট্টা ও সূর্যমূখীর চাষের কারণে। চলতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অঞ্চলে রোরো ধানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪শ ৫৮ মেট্টিক টন। প্রতি বছর বোরো মৌসুমে জেলায় প্রায় ১৬ হাজার ধান কাটার শ্রমিক ধাপে ধাপে আসতো। চলতি মৌসুমে করোনার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও ইতিমধ্যে ৬ হাজার ৭শ বহিরাগত ধান কাটার শ্রমিক জেলায় এসেছেন। তাদের সাথে আমাদের স্থানীয় অন্যান্য পেশার লোকজন ধানকাটায় এগিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে ৪০টি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ মেশিন দিয়েও ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তা বন্দি করা হচ্ছে।’
এ কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘বহিরাগত শ্রমিক যারা এসেছেন তারা সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ধান কাটছেন। বহিরাগত শ্রমিকদের এক জায়গায় রেখে ধান কাটার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা স্থানীয় শ্রমিকদের সাথে মিশতে না পারেন। কৃষকদের সাথে কথা বলেছি। তারা যদি অন্যান্য জেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিক আনতে চান তাহলে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া হবে। সকল প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে কৃষক তার ধান গোলায় তুলতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগে যেমন বহিরাগত শ্রমিকরা এই জেলায় এসে ধান কাটতেন, এবছরও তারা কাজ করবেন। হয়তো সংখ্যায় কিছুটা কম হবে। আমরা সকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। আশা করি ধান কাটা নিয়ে কোন সমস্যা হবেনা।’
এআই/