ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

করোনার রমজানে খাবার ও প্রার্থনা কেমন হবে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:০১ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:০৭ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

করোনা আতঙ্ক নিয়ে এবার শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। এবার রমজান গোটা বিশ্বের কাছে বিশেষ ব্যতিক্রম। দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়া, চাল চলনে বিশেষ সতর্কতায় থাকতে হচ্ছে সবাইকে। আবার এই মহামারী থেকে মুক্তি পেতে ঘরে থেকে স্রষ্টার কাছে বিশেষ প্রার্থনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অবসরে থাকার কারণে মানুষ ঘরে বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে রমজানের সবগুলো দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সুতরাং এবারের রমজান এসেছে স্রষ্টার বিশেষ সন্তুষ্টি লাভের বিশেষ সময় নিয়ে।

ধর্মীয় বিধি মতে, মুসলমান প্রাপ্ত বয়স্ক হলে এবং শারীরিকভাবে সামর্থ থাকলে তার জন্য রোজা ফরজ বা অত্যাবশ্যক। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা আল্লাহ সচেতন হতে পারো।’

কী খাবেন, কী খাবেন না- 
প্রথমত, রমজান সংযমের মাস। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সুস্থ থাকার জন্য এসময় পরিমিত খাবার অভ্যাস করাই ভালো। চিকিৎসকদের মতে, সেহেরি ও রাতের খাবারে আমিষ জাতীয় খাবার কম খাবেন। তাই পরিমিত ভাত, সবজি ও ডাল খাবেন। সেহেরিতে প্রচুর পানি খাবেন। ইফতারে ভাজা-পোড়া কম খাবেন। ভাজা-পোড়া খাবার পেটে গ্যাস তৈরি করে, যা রোজাদারের জন্য অস্বস্থিকর। 

চিকিৎসকেরা মনে করেন, করোনা পরিস্থিতিতে ইফতার ও সেহেরিতি কোনোভাবে চর্বিযুক্ত ও গুরুপাক খাওয়া যাবে না। এসব খেলে স্বাস্থ ঝুঁকি বাড়বে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে, ভিটামিন ই ও সি–জাতীয় শাকসবজি খেতে হবে বেশি। তাই প্রতিদিনের ইফতার ও সেহেরির খাবারে টমেটো, লেবু, মধু, জাম্বুরা, মাল্টা, পেয়ারা, পেঁপে, কালো জিরা রাখুন। এসবে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) শক্তিশালি হলে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস জনিত রোগের প্রতিরোধ করা সহজ হয়। ইফতার ও সেহেরিতি অবশ্যই খেজুর রাখবেন। বিজ্ঞানীরা খেজুরকে বলে থাকেন ইন্সট্যান্ট এনার্জির ভাণ্ডার। মানে নিমিষেই প্রাণশক্তি। নিয়মিত খেজুর খেলে বাড়তি ভিটামিন খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। খেজুরে আছে ২৩টি অ্যামাইনো এসিড। যা আপেল, কমলা, কলার মতো জনপ্রিয় ফলেও নেই। এই অ্যামাইনো এসিড ‘কার্সিজেনিক’ নামের টক্সিনকে দেহের বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে। আবার আমাদের নবী করিম (সা.) খেজুর পছন্দ করতেন, তাই খেজুর খেলে আমাদের জন্য সুন্নত পালন করা হবে। 

বাংলাদেশি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও করোনা বিশেষজ্ঞ ড. বিজন কুমার শীল বলেন, এই মুহূর্তে প্রতিদিনের খাবারে আদা (জিঞ্জার) ও লবঙ্গ (ক্লোব) একসঙ্গে পিষে সেটাকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার সঙ্গে কিছুটা চা ও মধু দিয়ে ওটা এক কাপ মতো নিয়ে গড়গড়া করে খেতে হবে। দিনে অন্তত তিন-চারবার এক কাপ করে এটা খেতে পারেন। এর ফলে গলার ভেতরের কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। এতে কোষগুলো শক্তিশালী হবে। কোষগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোষগুলো সমর্থ হবে কোভিড-১৯ ভাইরাস যদি আক্রমণ করে, তাকে প্রতিরোধ করতে।

অন্যদিকে, মাংস, মসলাজাত খাবার, চিনি, পিজ্জা, সাদা রুটি, প্যাকেটজাত ফলের রস, সিরিয়াল, ভাজা খাবার, পেস্ট্রি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আঠালোযুক্ত খাবার, কম ফ্যাটযুক্ত দই, লো-কার্ব ডায়েট, আইসক্রিম, ক্যান্ডি বার, প্রক্রিয়াজাত মাংসসহ এ জাতীয় খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মতে, উল্লেখিত খাবারগুলো এসময়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। 

যেহেতু এই রমজান মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছিলো, এজন্য স্বয়ং আল্লাহর কাছেও এই মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ জন্য রমজান মাসকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। আমরা জানি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন রমজানে যেকোন সুন্নাত কাজের আমল ফরজ কাজের সমান করে দেন। আর একটি ফরজের সওয়াবকে ৭০টি ফরজের সমান করে দেন। তাই করোনার এই মহামারির এই বিশেষ সময়ে মহান আল্লাহর রহমতের আশায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এ সময়ে আমরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দৈনন্দিন প্রার্থনার পাশাপাশি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে গুরুত্ব দিবো। আর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করবো। সবাইকে সুস্থ করার জন্য দোয়া করবো। 

করোনায় আতঙ্কিত অনেক মানুষ এখন মৃত্যু ভয় বা বাঁচার তাগিদে হা-পিত্যেশে অস্তির হয়ে আছেন। অর্থাৎ এখন কী করা গুরুত্বপূর্ণ সেটাই ঠিক করতে পারছেন না। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখে অস্থির মানুষ এখন নিজের জীবন নিয়েই বেশি শঙ্কিত। যেন সবাইকে মৃত্যু তাড়া করে ফিরেছে। মনে রাখবেন, করোনার এই মহামারী থেকে রক্ষা পেতে আপনার বিশেষ সতর্কতা বিশেষ জরুরি। এর পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। খাওয়া-দাওয়া ও চাল চলনে সবধানতা অবলম্বন করলে আপনি নিরাপদ থাকতে পারবেন।

কার মৃত্যু কখন কোথায় হবে তা কেউ জানে না। এটা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন। হতে পারে তা আজই কিংবা আগামীর যেকোনো দিন। স্রষ্টা তার দিনক্ষণ এভাবেই স্থির করে রেখেছেন যে, কারও মৃত্যু সেই নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেও হবে না, একটু পরেও নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারও মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু তার মেয়াদ স্থিরীকৃত।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪৫) তাই আমরা মহামারীর এ সময়ে নিজেদের সুরক্ষা ও সুস্থ রাখতে এবং মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের রহমত পাওয়ার জন্য খাওয়া-প্রার্থনায় বিশেষ সতর্ক থাকবো। 

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের রোগ-বালাই এক রকমের বিপদ-মুসীবত। এসব থেকে মুক্তির জন্য এক আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। একমাত্র আল্লাহই পারেন এই মহাবিপদের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করতে। আল্লাহর কাছে রোগ থেকে পানাহ চাইতে হবে, দোয়া করতে হবে। সকলের উচিত আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা। তবেই আল্লাহ পাক সকলকে এ মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করবেন।’

একইসঙ্গে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজেকে সাহায্যের পাশাপাশি দেশ ও দশের প্রতি যার যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে বলে আহ্বান জানান তিনি। 

এ ক্ষেত্রে একটি হাদিস উল্লেখ করে সিনিয়র এই পেশ ইমাম বলেন, রাসূল (স.) বলেন, গোটা দুনিয়ার মানুষ এক আল্লাহর পরিবারতুল্য। তাঁর কাছে স্থান, কাল, পাত্র কোনও মুখ্য বিষয় নয়। তাই যারা দুনিয়ার মানুষের প্রতি সদয় হয়ে তাদের কল্যাণে কাজ করে, মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সদয় হন ও রহম করেন। তিনি বলেন, কাজেই সর্বাবস্তায় সকর্ত থেকে একে অপরকে সাহায্য করতে হবে এবং একইসাথে জমায়েত হওয়া পরিহার করতে হবে। আর আমরা বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই পারেন যে কোনও মহামারি বা বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে। 

একে/এনএস