করোনার প্রাদুর্ভাবে কয়েকটি ন্যাচারোপ্যাথিক প্রস্তাব
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:০১ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:০৩ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
গত ১৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে কলিকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় “কবি-রাজ রবীন্দ্রনাথ: পাঁচন দাওয়াই কি এখন করোনায় কাজ করবে?” নামে স্রবন্তী বন্দোপাধ্যায়ের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি তথ্য-সমৃদ্ধ ও সুলিখিত। বাংলাদেশের বিদগ্ধ পাঠকও এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন। রবিঠাকুর মাঝে মাঝেই গাছ-গাছড়া দিয়ে ছোটখাটো চিকিৎসা করতেন। সেগুলো নিজে খেতেন, সন্তানদের, এমনকি শান্তিনিকেতনের শিক্ষাথীদেরকেও খাওয়াতেন। সেগুলোতে কাজ হলে খুশি হতেন, সেই খুশির খবরটা অন্যদেরকে জানিয়েও আনন্দ পেতেন। তাঁর কাছে প্রকৃতি ছিল জ্ঞানের ভাণ্ডার, এমনকি চিকিৎসার ওষুধেরও। বিজ্ঞানকে তিনি প্রকৃতিরই অংশ মনে করতেন। এসব আমরা জানি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে প্রাকৃতিক চিকিৎসাকে আজ আমরা ‘ন্যাচারোপ্যাথি’ নামে অভিহিত করি, ভারতীয় সভ্যতায় রবিঠাকুরকে তার ‘উল্লেখযোগ্য গবেষক-সাধক’ নামে অভিহিত করলেও অতুক্তি হবে না। এ বিষয়ে বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছে রাখি। কিন্তু যেটা জানা ছিল না তাহলো- শান্তিনিকেতনে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে তিনি যে পাঁচনটি ব্যবহার করতেন তার ফর্মুলা এবং এটি যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসজনিত মহামারীর সময়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে রক্ষা করেছিল সেই তথ্যটি। স্রবন্তী বন্দোপাধ্যায়কে এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।
রবিঠাকুরের পাঁচনের বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে- নিমের এন্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য বৈজ্ঞানিকভাবে দেশে ও বিদেশে প্রমাণিত। নিশিন্দা আমাদের দেশে এখনও কবিরাজগণ ফুসফুসের প্রদাহ ও কাশিতে ব্যবহার করে থাকেন, আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণারও এতে দ্বিমত নেই। গুলঞ্চ যকৃত ও ত্বকের সমস্যায় আয়ুর্বেদের একটি মূল্যবান ভেষজ। কিন্তু এটি দিয়ে ফুসফুসের চিকিৎসা কিংবা ইমিউনিটির বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞান এখনো কিছু বলেনি। তেউরির ক্ষারীয় গুণ হয়তো জ্বরের ক্ষেত্রে এলকালাইজারের কাজ করে। থানকুনি আমাশয় কিংবা পেটের অসুখে কার্যকর, তারুণ্য ধরে রাখার বিষয়েও উন্নত দেশে গবেষণায় এর ইতিবাচক ফলাফল এসেছে। আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক ডঃ এ কে আজাদ চৌধুরী স্যারও গবেষণায় এর এন্টিএজিং গুণ পেয়েছেন। কিন্তু এখনো এর কোনো এন্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য অজানা। হতে পারে এটি আয়ুর্বেদের অনুপান-তত্ত্বের কারণে তখন ব্যবহৃত হয়েছিল। এগুলো নিয়ে গবেষণায় গেলে হয়তো বিশদ জানা যাবে।
কিন্তু করোনা ঠেকাতে এই পাঁচনটি ব্যবহার করা যাবে কিনা? রবিঠাকুরের ফর্মুলার নিশিন্দা, গুলঞ্চ, তেউরি এসময় সাধারণ্যে পাওয়া যাবে না। করোনা প্রাদুর্ভাব যেহেতু আরো কিছুদিন চলবে বলে মনে হচ্ছে, তাই নিম দীর্ঘদিন খেলে যকৃতে সমস্যা হতে পারে, সে কারণে এন্টিভাইরাল হলেও এই সময়ে এটি না খাওয়াই ভালো। তবে রবিঠাকুরের দেখানো পথে এগিয়ে আমরা ক্ষতিকর নয় এমন কিছু ঘরোয়া টোটকার কথা বলতে পারি।
এখনকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো গাছগাছড়ার কার্যকারিতার কথা এখনো শোনা যায়নি। কারণ এটা নতুন ভাইরাস বলে এর সম্পর্কে প্রায় অনেক জরুরি তথ্যই অজানা। তাছাড়া এটি ঘনঘন রূপ বদলাতে (মিউটেশন) পারে, যা আরো বড় সমস্যা। তাই এলোপ্যাথিই যেখানে একে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আয়ুর্বেদ বা গাছগাছড়া দিয়ে চিকিৎসার কথা ভাবাই যায় না।
তবে বার্ড ফ্লু বা সোয়াইন ফ্লুর চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত অসেলটামিভির ওষুধটি সুইজারল্যান্ডের ওষুধ কোম্পানি হফম্যান লা রোশ কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে বিরিয়ানিতে ব্যবহৃত মশলা স্টার এনিস থেকে, এটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই মশলাটি তারার মতো দেখতে বলে এর এমন নাম এবং খুব সুন্দর গন্ধযুক্ত। বার্ড ফ্লুর ভাইরাসও বর্তমান করোনাভাইরাসের পরিবারভুক্ত বলে এদের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। চীনে ও অন্যান্য দেশে তাই এবারের করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় অন্যান্য ওষুধের সাথে এই অসেলটামিভির ওষুধটিও ব্যবহৃত হয়েছে এবং উপকারও পাওয়া গেছে। তাই এখনকার এই সংকটকালে যদি ওষুধটির মূল উৎস এই মশলাটি আমরা চায়ের মতো দিনে কয়েকবার খাওয়া শুরু করি তাতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই।
এই চা যখন বানাবো তখন আরো কিছু উপাদান এর সাথে দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নেয়ার পর যে চা পাওয়া যাবে সেটাই রবিঠাকুর বা আয়ুর্বেদের ভাষায় বলে ‘পাঁচন’ বা ‘রস’। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ‘এক্সট্রাক্ট’। দিনে কয়েকবার এই চা খাওয়া ভালো বলে মনে করি। এর সাথে ন্যাচারোপ্যাথির মতে যে জিনিসগুলো মেশানোর প্রস্তাব করছি সেগুলো হলো- আদা, তেজপাতা, লবঙ্গ, দারুচিনি ও এলাচি। এর সবগুলোই ঠান্ডা লাগা, সোর থ্রোট, গলা ব্যথা ও প্রদাহে কিছু কাজ করে বলে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। সাথে চা পাতাও দেয়া উচিত কারণ এতে থাকা ক্যাফেইন, থিওব্রোমিন ও থিওফাইলিন কিছুটা ব্রংকোডাইলেটর অর্থাৎ ক্ষুদ্র শ্বাসনালীগুলোকে এরা কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বলে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া সহজ করে। এই এক্সট্রাক্ট বা পাঁচন বা চা গরম গরম খেতে হবে। কারণ গরম পানিরও কিছুটা এই ব্রংকোডাইলেটর গুণ আছে। কাশি থাকলে যাদের ডায়াবেটিস নেই তারা মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। তাতে গলার খুসখুসি কমার কথা। আমরা কাশির ওষুধেও মধু ব্যবহার করে থাকি। সাথে লেবুর রস মেশালে স্বাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভিটামিন সি পাওয়া যাবে যা এই সময়ে খুব প্রয়োজনীয় বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন।
তবে মনে রাখতে হবে, এই কঠিন সময়ে কেউ যেন আমার প্রস্তাবিত এই পাচনকে এলোপ্যাথি ডাক্তারের পরামর্শের বিকল্প ভাববেন না। এটা একেবারেই একটা ঘরোয়া চিকিৎসা, যা নিয়মিতভাবে আমরা ব্যবহার করে কিছু উপকার পেতে পারি। তবে কাজ হচ্ছে না মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে। সর্দি ও নাকবন্ধ হলে গলা ও নাকের গোড়ার ফোলা জায়গায় গরম স্যাক দেওয়া এবং গরম পানির ভাপ দিনে কয়েকবার নিলে কাজ হতে পারে। উল্লিখিত জিনিস কোনো কোনোটা ঘরে না থাকলে এগুলো বাদ দিয়েই অন্য উপাদানগুলো দিয়ে এই পাঁচন বানানো যাবে। তবে সবগুলো থাকলে ভালো হয়।
সর্দি বা গলাব্যথা হলে আরো একটা জিনিস এর সাথে যোগ করা যায়। তাহলো হলুদের গুঁড়া, আধা চা চামচের কম। হলুদে থাকে কারকিউমিন যা প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিকের মতো। আমাদের লোক-চিকিৎসার ঐতিহ্যে ঠান্ডা লাগার এরকম সমস্যায় হলুদ খুব কাজে দেয়। খুব ভালো হয় যদি দিনে কয়েকবার গরম লবণ-পানি দিয়ে গড়গড়া করা যায়। এতে গলার ব্যথা, ফোলা ও চুলকানি কমার কথা। তবে কখনোই ঠান্ডা কিছু খাওয়া যাবে না। ঠান্ডা পানিও না। হালকা গরম পানিই খেতে হবে। মনে রাখতে হবে মজা লাগার চাইতে বেঁচে থাকাটা জরুরি।
ঠান্ডা, সর্দি, নাকবন্ধ, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদিতে নাক ও মুখ দিয়ে ৫-৭ মিনিট ধরে গরম বাষ্প টেনে নিলে অর্থাৎ শ্বাস নিলে বেশ আরাম হয়- এটাও ন্যাচারোপ্যাথি। গরম বাষ্প পাওয়ার জন্য একটি পাত্রে পানিকে জ্বাল দিয়ে ফোটাতে হবে। পানি ফুটতে শুরু করলে ঢাকনাটি একটু সরিয়ে দিলে ফাঁকা অংশটি দিয়ে যে সাদা বাষ্পটি গলগল করে বেরিয়ে আসবে সেটি একটু দূর থেকে (যাতে নাকে-মুখে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি তাপ না লাগে) নাক ও মুখ দিয়ে টেনে নিতে হবে। গরম বাষ্পের এই কিছুটা গরম কুণ্ডলীর মধ্যে এইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে বুকে জমে যাওয়া জমাট কফও বেরিয়ে আসতে সহায়তা হয়, ন্যাচারোপ্যাথির এই চিকিৎসায় আজকের এলোপ্যাথিরও সায় আছে।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের এই তাণ্ডবের মধ্যে এই গরম বাষ্প দিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কোনো কোনো বিজ্ঞানী মহলে নতুন করে আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তারা বলছেন যে, করোনাভাইরাসের আবরণ ৫৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মতো উচ্চ তাপমাত্রার সাথে উচ্চ আর্দ্রতায় নষ্ট হয়ে যায় বলে ভাইরাসটি মরে যায়। যার কারণে মরুভূমি এবং উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতার দেশের চাইতে শীতপ্রধান ও কম আর্দ্রতার দেশগুলোতে করোনার দাপট তুলনামূলক বেশি বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। গরম বাষ্পের তাপমাত্রা আরো বেশি, আর আর্দ্রতা প্রায় ১০০%। এ কারণে এক ঘন্টা পরপর ৫ মিনিট করে কয়েকবার এভাবে গরম বাষ্পের শ্বাস নিলে নাসারন্ধ্র ও সাইনাসে নাকি করোনা থাকতে পারে না। যদি তাই হয় তাহলে তো ভারী সুসংবাদ। যদি নাও হয় তবু ন্যাচারোপ্যাথি অনুযায়ী গরম বাষ্প নিলে ঠান্ডা লাগা, নাকবন্ধ এগুলো তো কমবে।
কিন্তু যত যাই হোক, যত ওষুধই খাই বা যত ন্যাচারোপ্যথিই রপ্ত করি না কেন, ঘরে থাকা অর্থাৎ ঘর থেকে একেবারেই না বেরুনো আজ সবচেয়ে জরুরি। বাঁচতে চাইলে ঘরে থাকতে হবে। কারণ ঘরে না থাকার কারণে অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলার কারণে আমাদের দেশে করোনার আক্রমণটা ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে। প্লিজ, আসুন আমরা সবাই ঘরে থাকি। বাইরে যাওয়া মানেই এই ঘনবসতির দেশে সামাজিক দূরত্ব রক্ষিত না হওয়ার আশংকা। সরকার বারবার লকডাউন বাড়াচ্ছেন মানুষকে ঘরে থাকার জন্য, বাইরে যাওয়ার বা আড্ডা দেওয়ার জন্য নয়। এখনো কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কৃত না হওয়াতে করোনার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সব ধরনের সাবধানতাই নিতে হবে, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঘরে থাকা। অতি সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্যতো বলছে ঘরে থাকতেই হবে, উপায় নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একবার করোনা-আক্রান্ত কেউ হাঁচি-কাশি দিলে এর মাধ্যমে নির্গত ভাইরাসটি বাতাসে কমপক্ষে কয়েক ঘন্টা বেঁচে থেকে ভেসে বেড়াতে পারে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি বলছে- ভাইরাসটি কয়েক ঘন্টা ধরে তো বেঁচে থাকেই, উপরন্তু বাতাসে ভেসে কমপক্ষে ২৭ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে। তাই বাইরে যাওয়া কী পরিমাণ ঝুঁকিপূর্ণ তা নিশ্চয়ই আর বলার দরকার নেই।
আসুন ঘরে থাকি। কিছুদিন নিজে নিজেই ঘরে বন্দী থেকে করোনা থেকে দূরে থাকি। আর ঠান্ডা যাতে একেবারেই না লাগে তার জন্য সবাই সচেষ্ট থাকি। প্রয়োজনে অন্যান্য চিকিৎসার সাথে সাথে ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে ন্যাচারোপ্যাথিও ব্যবহার করি। কাশি ও হাঁপানি রোগী এবং ধূমপায়ীদের জন্য এখন চ্ড়ূান্ত বিপজ্জনক সময়। তাদের ঘরে থাকা আরো বেশি জরুরি।
লেখক- পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এনএস/