ট্রেন আর ডাহুকের ডাক আমাকে স্মৃতি কাতর করে
শামীম আজাদ
প্রকাশিত : ১০:৩২ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ১১:০৫ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার
আজও শেষ রাতে স্বরভঙ্গ নিয়ে ডাক দিয়ে গেল ট্রেন। যেন সে এক টিন এজার ট্রেন। বয়সের আনন্দেই প্রতিদিনের মত আজও সে স্বর ভেঙে ভেঙে পেরিয়ে যায় ক্যারোনার ভয়ে ভীত ঘরবন্দী ঘুমন্ত আমাদের এ্যাপার্টমেন্ট ও কাউন্সিল ফ্ল্যাটগুলো আর ওকের মত দাঁড়ানো লাইট পোস্টের লাইন।
ট্রেনের ডাক, জাহাজের ডাক, ডাহুকের ডাক আর কবির ডাক আমাকে উতলা করে দিয়ে বিষন্ন করে তোলে। আমাকে স্মৃতি কাতর করে দেয়। সে আমার শৈশব থেকেই। তখন রেল গাড়িগুলো ছিলো কয়লা চালিত। কতদিন ভোরে ফেনির রেললাইনের পাশ দিয়ে আব্বার হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখেছি আমারই বয়সের কিশোরী সেখান থেকে কয়লার টুকরো কুড়িয়ে নিচ্ছে। বাসায় ফিরে কেটলীতে চা জাল করা আম্মার কয়লার চুলোর পাশে টাল করা কালো কয়লা এবং চুলোর গনগনে লাল কয়লা দেখে আমারই মতো লালচুলো সে টোকাই মেয়েটির কথা মনে হত।
তখন ট্রেনগুলো দেখতে ছিল যেমন তেমন। কিন্তু এমন বিকট হুংকার দিতো যে একবার ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম আরকি! ছোট ছিলাম বলেই না সবে মাত্র পৃথিবীর শব্দ সনাক্ত করতে শুনতে শুরু করেছি বলেই কানের কাছে সবই হুংকার মনে হত জানিনা।
এখন আমি যখন সেই ঝুমুর ডাঙা কালের পরিবর্তে বর্তমানের বর্ষিয়ান এই ভঙ্গুর কালে ঘুমিয়ে থাকি তবু ট্রেনপ্রেম যায় না। শেষ রাতের প্রায় জনমানুষহীন ট্রেনটা তার লোহা আর ইষ্পাতে তৈরী দেহটা নিয়ে যখন আমাদের পেরিয়ে যায় তখন ফ্রক পরাকালের জামালপুরের বন্ধু মিষ্টি মন্টি ও ঝুনুর কথা মনে পড়ে যায়। এরা ছিল আমার ছোট ছোট ষ্টেশন।
গরমের ছুটিতে সিলেটে গ্রামের বাড়ি যাবার পথে ভোররাতে ট্রেনের বিকট চিৎকারে ঘুম ভাঙলেই শুনতাম ‘চা গ্রম চা গ্রম’ ধবনি। দেখতাম আব্বা অন্য কম্পার্ট্টমেন্ট থেকে নেমে দ্রুত সে লোকের কাছ থেকে ফ্লাস্কে চা ভরে ‘এ্যাই ডিম এ্যাই ডিম’ওলার কাছ থেকে ডিম ও লবন ও লোফওলার কাছ থেকে ছোট ছোট মিষ্টি রুটি কিনে নিচ্ছেন। আমাদের কামরার দরজায় মেয়েদের ছবি দিয়ে লেখা জানানা। পরে আরো কিছুদিন ‘মহিলা’ লেখা ছিলো। আম্মা খালামনি আমাদের কম্পার্টমেন্টে সেগুলো জুত করার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিত। উধাও হয়ে যাওয়া আব্বা আবার পরের ষ্টেশনে আবির্ভূত হয়ে দ্রুত জানালা দিয়ে নিয়ে যেতেন নিজের ভাগ। আর আর শুবু আর আমি জানালা দিয়ে দূরে মিলিয়ে
যাওয়া তাকে আবিষ্কার করে করে ঐ যে আমাদের আব্বা ঐ যে আমাদের আব্বা করতাম।
আব্বা মিলিয়ে গেলে সকাল হত। খড়খড়ি উঠানো জানালায় মাথা দিয়ে আমি আর শুবু বেঁকে যাওয়া অজগরের লেজ দেখতে চেষ্টা করতাম। মাথা উঁচিয়ে কয়লার কুন্ডলির হাতীর শূঁড় দেখতাম। ভাইয়া বগির মাথার উপরের খাঁচায় খাকি হোল্ডলের উপর পাতা বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আমাদের বাহাদূরী দেখাতো। আমাদের কামরায় রবীন্দ্রনাথের লেখা ইষ্টার্ণ রেল ওয়ের বিজ্ঞাপনের সেই লাইনগুলোর- মত রয়ে যেতো ‘ কামরার গাড়িভরা ঘুম’।
ছোটবেলা কত সরল সুখী থাকে মানুষ!
শৈশবের জাম্পেশ জামালপুর এর বিকল্প এই পরিণত বয়সের এই বিদেশ ভুখন্ডের লীলাময় লিভারপুল হয় না| চার্চের চিমনীতে তুষার জমা হলেও হয় না বো চার্চ।
কিন্তু জামালপুর টু লিভার পুল! একটা যাত্রাধ্বনি আছে। বাহ্ এমন একটা লেখাতো লিখতে পারি! এর সরু এঁকে হেঁকে যাবার মধ্যে থাকবে লিভার পুল, না্রায়নগঞ্জ, কুলাউড়া, ফেনী, শায়েস্তাগঞ্জ বা মৌ্লবি বাজার, চাষাড়া ও বনানীর মানুষ ষ্টেশনগুলো। আমার হিউম্যান ষ্টেশনগুলোর মধ্যে থাকবে নারায়নগঞ্জের ফনী কাক্কার নিতাই গঞ্জের বাসার ফুল্কো লুচি তরকারী ও স্মৃতিময়দা’র কবিতা আবৃত্তির কথা। বুজানের শ্বশুরবাড়ী কুলাউড়ার নাড়ার আগুনে পোড়ানো বাঁশের চোঙা পিঠা আর হাঁসের মাংস ভুনার স্বাদের গল্প। ফেনীর ছোট্ট ষ্টেশনে বসে বন রুটি খেতে খেতে আব্বার অফিসের জিপ গাড়ির জন্য অপেক্ষা সময়।
তাতে থাকবে যাত্রা শেষের গল্পও।
মৌলবি বাজারে ব্রিটিশ আমলের সেই ঝক্কর লক্কর বাসে করে মনু নদের কাছে নামা। হঠাৎ গোলযোগে রোকেয়া হলের লক ডাউনে প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে রোকেয়া হল ছেড়ে নারায়গঞ্জের ট্রেন থেকে ভরা কচুরিপনা ডোবা ঘেরা চাষাড়া ষ্টেশনে নামা। মনে পড়ে চট্টগ্রাম যাবার জন্য আজাদ ও আমাকে ঈশিতার বিস্বস্ত ড্রাইভার শাজাহানের গাড়ী চালনায় বনানী ষ্টেশনের শীতল প্ল্যাটফরম এ নামা।
থাকবে কিংস ক্রস ষ্টেশনে স্নান, সাব্রীনার শার্লটের বাড়ীর পাশের একাকী যাত্রী ছাউনি।ডার্লিংটনের ডান্ডিলায়ন, সান্ডারল্যান্ডের সুরভিত পোয়েট্রি পাব, নিউক্যাসেলের নতুন ব্রীজ ও লিভার পুলের হারানো লাল সুটকেসের কথা। থাকবে আলো আঁধারে যাওয়া আসা। কেবল ভালবাসা।
কত মানুষ আমার শিল্পযাত্রার ট্রেনসঙ্গী হয়ে কবিতা কথকতা হয়েছেন! আজ এই দু:সহ করোনাকালে আলোর অজগরটি চলে গেলে ভাবি এই সব।
করোনা কাল
লন্ডন
২৪.৪.২০
এসি