রমজান এবং অসহায়ের দান
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৫১ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৩৩ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২০ শনিবার
নিজের সর্বস্ব দান করছেন ভিক্ষুক নজিমুদ্দিন
মুসলমান ধর্মের রমজান মাস শুরু হয়েছে। এ মাসে পবিত্র কোরআন মজিদ নাজিল হয়। তাই এ মাসের গুরুত্ব মানুষের কাছে অপরিসীম। এ মাসে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য বিশেষ প্রার্থনা, কোরআনে মনোযোগ এবং দান করার কাজে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এমাসে একটা নফল ইবাদত ফরজ আদায়ের সমান। আবার একটি ফরজ সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান। যেহেতু এ মাসে পবিত্র কোরআন নাযিল হয় তাই এ মাসে যে কোন ভালো কাজের সওয়াব এতো বেশি। রমজানের এ মাসে আমরা এবার খুব সহজে বড় সওয়াব লাভ করতে পারি যদি একটু সচেতন হই। গোটা বিশ্বের ন্যায় আমরাও করোনা মহামারীতে আক্রান্ত। এসময়ে আমরা যদি একটু সহমর্মিতা নিয়ে আমাদের চারপাশের অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই তাহলে লাভ করতে পারি স্রষ্টার সন্তুষ্টি। পাশাপাশি এই রমজানে অসুস্থ অসহায় মানুষদের জন্য দোয়া করি, তাহলে আমরাও স্রষ্টার বিশেষ সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি।
ভাবুন সেই ভিখারী শেরপুরের নজিমুদ্দিনের কথা, যিনি তার ভিক্ষার সমস্ত অর্থ তুলে দেন করোনায় অসহায়দের সাহায্যের জন্য। ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গান্ধীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ভিক্ষুক নজিমুদ্দিন। ঘর মেরামতের জন্য তার সঞ্চয়কৃত ১০ হাজার টাকা অসহায় কর্মহীনদের জন্য করোনা তহবিলে তুলে দেন।
রাসুলুল্লাহ (স) এই মাসে অনেক বেশি বেশি দান করতেন। বোখারী শরীফ এবং মুসলিম শরীফের হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন যে, নবীজী (স) আমাদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল ছিলেন, আর রমজান মাসে তার দানশীলতা আরও বেড়ে যেত।
রাসুলুল্লাহ (স) রমজান মাসে কারও উপকার করা, কারও কল্যাণ করা, কারও সমস্যা দূর করা, কারও অভাব মোচন করার জন্যে কাজ করাকে এতেকাফের চেয়েও অনেক অনেক বেশি সওয়াবের কাজ বলে বর্ণনা করেছেন। আমরা হাদিস গ্রন্থ থেকে বুঝতে পারি- রমজান মাসে অভাবীর প্রয়োজন পূরণে, বিপদগ্রস্তের প্রয়োজন পূরণে দান করা সাহায্য করা এগিয়ে আসা বেরিয়ে পড়া মসজিদে বসে ১০ বছর এতেকাফ করার চেয়েও বেশি পুণ্যের, বেশি সওয়াবের।
আজকের করোনা আক্রান্ত পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের সেই অসহায়দের কথা চিন্তা করুন, লকডাউনের ফলে কাজের অভাবে যারা কোনোদিন ভিক্ষায় নামেনি, তারাও সন্ধ্যার পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাতের জন্যে কান্না করছে। সেই মানুষগুলোর কথা স্মরণ করুন- যারা আসলে না খেয়ে থাকলে কাঁদতেও পারবে না, আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে যারা দিন আনে দিন খায়, কাজ না থাকলে যাদের ঘরে ভাত থাকে না, তাদের কথা চিন্তা করুন এবং সমস্ত বাহুল্য বর্জন করুন।
নিজের খাবার এই রমজান মাসে তিন আইটেমে সীমিত করে ফেলুন। সেখান থেকে যা বাঁচে... ঈদের খরচ যাই করতেন, সমস্ত খরচ বাঁচান। যারা হজের নিয়ত করেছিলেন...এমনকি যারা হজের নিয়ত করেছেন, হজ এবার হওয়ার সম্ভাবনা আল্লাহ্ই ভালো জানেন। আগামী বছর যাবেন বলে এই টাকাটা যদি ধরে রাখেন... আপনি জানেন না আগামী বছর আপনি বেঁচে থাকবেন কি না। কিন্তু যারা ওমরায় যেতে পারেন নি, এই টাকা, যদি অসহায় দুস্থ মানুষের কল্যাণে আপনি দান করেন, কারও অভাবকে মোচন করেন, কোনো এতিমের মুখের খাবার আপনি যোগান, তাহলে হয়তো এই অসিলায় সারাজীবনের পাপ মাফ পেয়ে যাবেন এবং মহামারী থেকেও আপনি আল্লাহর সাহায্য পেতে পারেন।
হয়তো এই অসিলায় পরম করুণাময় করোনা আতঙ্ক থেকে, করোনার বালা-মুসিবত থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের জাতিকে তিনি করুণা করতে পারেন, তিনি ভয়-আতঙ্ক থেকে মুক্ত করে দিতে পারেন। আসলে আমরা যদি দেখি করোনায় যত লোক মারা গেছে, প্রত্যেকের জন্যে আমরা দুঃখিত। কিন্তু কাজ না থাকার কারণে যত মানুষ কষ্ট পাবে, তাদের কষ্ট দূর করার জন্যে আমাদের যাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে এই সামর্থ্য নিয়ে যদি আমরা এগিয়ে আসি, তাহলে পরম করুণাময় অবশ্যই আমাদেরকে এই বালা এবং এই মুসিবত থেকে মুক্তি দেবেন।
মুচি আহমেদ আশফাকের গল্প: আমরা জানি, এলমে মারেফাতের একজন খুব বড় বুজুর্গ ছিলেন জিন্নুন মিসরি। হজ শেষ করে আরাফাতের ময়দানে তিনি ধ্যানে ডুবে গেলেন এবং ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি জানতে পারলেন এবছর কেবল একজনের হজ কবুল হয়েছে। একথা উপলব্ধি করার সাথে সাথে তিনি দুঃখিত ও চিন্তিত হলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এত এত হাজীদের মাঝে শুধু একজনের হজ কবুল হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই আমার হজ কবুল হয়নি। এই ভাবনার মাঝে যখন তিনি ডুবে গেলেন, তখন তিনি জানতে পারলেন যে, সেই হাজীর হজ কবুলের অসিলায়, সকল হাজীর হজ কবুল হয়েছে। তখন নতুন ভাবনা যে, এত এত হাজির মাঝে যার হজ কবুল হয়েছে, তিনি নিশ্চয়ই খুব কামেল, নিশ্চয়ই খুব ধার্মিক, তার সাথে একবার অবশ্যই দেখা করা দরকার। তিনি এবারে হজে আসেনই নি। ধ্যানমগ্ন অবস্থায়ই জানতে পারলেন যে, এবছর হজ কবুল হয়েছে এমন একজনের যিনি হজেই আসেন নাই।
তিনি একজন মুচি, থাকেন দামেস্কে। বুজুর্গ জিন্নুন মিসরির কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। তিনি দামেস্কে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরে সেই আহমেদ আশফাক, সেই মুচির খোঁজ পেলেন। তিনি দেখলেন খুব সাধারণ মুচি, সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু তিনি কারণ খুঁজে পেলেন না যে, কেন তার হজ কবুল হলো। জিজ্ঞেস করলেন তাকে যে, "আসলে কী কী ঘটেছিল তোমার এসময়ে?" ঘটনা খুলে বললেন মুচি আশফাক - "যে আমার উপার্জন খুব সামান্য। সংসারের খরচ মিটিয়ে যা বাঁচে তা একটু একটু করে জমিয়ে ৪০ বছর ধরে হজের খরচ যোগাড় করেছিলাম। যাওয়ার জন্যে যখন সবকিছু ঠিকঠাক, তখনই এক ঘটনা আমার সমস্ত চিন্তাকে ওলটপালট করে দিল।" যেদিন রওনা করব সেদিন সকালে তার ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এসে জানাল অমুক প্রতিবেশীর বাড়িতে সে গিয়েছিল মাংস রান্নার গন্ধ পেয়ে একটু মাংস খেতে চেয়ে।সেই প্রতিবেশী মাংস তো দেয়ই নি, উপরন্তু তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেছে।শুনে আহমেদ আশফাক বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। এ কেমন কথা! এ কেমন কার্পণ্য! ছোট্ট একটি ছেলেকে সামান্য মাংস দেয় নি! মুচির চিৎকার শুনে প্রতিবেশী বেরিয়ে এল। খুব অনুনয় করে বলল- “ভাই! তোমার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক, বাচ্চাটাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে আমারও কম খারাপ লাগে নি। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম, জেনেশুনে তোমার ছেলেকে আমি মরা গাধার মাংস খেতে দেই কীভাবে! আমাকে ক্ষমা করে দিও।” খিদের জ্বালা মেটাতে মরা গাধা থেকে কিছু মাংস কেটে আনি। এবার আহমেদ আশফাকের অবাক হওয়ার পালা। “মরা গাধা! মানে কী! সব খুলে বল।” প্রতিবেশী তখন বলল, বেশ অনেক দিন ধরে কাজ যোগাড় করতে পারছি না। ঘরে যে খাবার ছিল, তাও ফুরিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন ছেলেমেয়ে নিয়ে একেবারে অনাহারেই ছিলাম।
অবশেষে খিদের জ্বালা মেটাতে আজকে সকালবেলা ঘর থেকে বেরোলাম। মাঠের ধারে দেখলাম একটা গাধা মরে পড়ে আছে। সদ্যমৃত, পচন ধরে নি। সেটারই খানিকটা মাংস ছুরি দিয়ে কেটে এনে স্ত্রীকে বললাম রান্না করতে।যখন মাংস হাড়িতে রান্না হচ্ছিল তখনই তোমার ছেলে এল। আমরা না হয় ক্ষুধার তাড়নায় মরা গাধার মাংস খেতে বাধ্য হচ্ছি, কিন্তু তোমার ছেলেকে তো তা খাওয়াতে পারি না। শুনে আহমেদ আশফাক দুঃখে-অনুতাপে সমবেদনায় কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলেন না। “এরপর আমার চোখ ফেটে পানি এল। প্রতিবেশীকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ভাই আমার! এত কষ্ট নিয়ে তুমি আছ, আমাকে তো একটু জানাতে পারতে।
দৌড়ে গেলাম বাড়িতে, এক ঝটকায় তুলে নিলাম টাকার থলিটা। ৪০ বছর ধরে যা আমি জমাচ্ছিলাম হজে যাওয়ার জন্যে। প্রতিবেশীর হাতে দিলাম। বললাম, “এই নাও আমার ৪০ বছরের সঞ্চয়, এটা দিয়ে কোনো ব্যবসা শুরু কর। হজে যাওয়ার চেয়েও তোমার দুঃখমোচন – এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” জিন্নুন মিসরি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন মুচি আহমেদ আশফাকের দিকে। তার সমমর্মিতায় তিনি আপ্লুত হলেন এবং বুঝলেন হজে বাস্তবে না যাওয়া সত্ত্বেও সশরীরে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও কেন তার হজ আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গেছে এবং সেই অসিলায় জিন্নুন মিসরির মতন বুজুর্গ এবং আরও হাজার হাজার হাজীর হজ কবুল হয়েছে। আসলে এই সমমর্মিতাই হচ্ছে রমজানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
রমজান মাস আমাদের পুরোটাই সংযম, ধ্যান, কোরআনের জ্ঞান, এবং দানের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের সবচেয়ে কল্যাণময় রমজান হোক- এই প্রার্থনা করে এই দোয়া করে আপনাদের সবার জন্যে মাহে রমজানের কল্যাণ কামনা করছি। আপনাদের জীবন সমস্ত ভয়-আশঙ্কা-বালা-মুসিবত থেকে মুক্ত হয়ে নিরাময় এবং কল্যাণে, সফলতায় আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠুক।
লেখক- ফাহমিদা ইসলাম ফারিয়া।