করোনা নিয়ে রকিবুল হাসানের কবিতা
রকিবুল হাসান
প্রকাশিত : ০৮:০২ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২০ শনিবার
পৃথিবী আর কবে কেঁদেছে এমন করে
পৃথিবীর এই এক রূপ কেউ কখনো দেখেনি একই কান্না
একই বেদনা মৃত্যুর মিছিল ঘরবন্দি বিবর্ণ জীবন
প্রিয়জনের নিঃসঙ্গ কী ভয়াবহ মর্মান্তিক বিদায়
পৃথিবী একই অন্তরে একই বেদনায় আর কবে কেঁদেছিল!
আর কবে কেঁদেছে এমন করে!
..........
এ কী ব্যাধি কী এক ব্যাধি প্রকৃতির নাকি মানুষেরই তৈরি!
পৃথিবী যে আজ মরণ শয্যায়
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কি মানবসভ্যতা!
এতো মৃত্যু মৃত্যুই যেন এখন একমাত্র শব্দ পৃথিবীর!
বিশ্বমানবতা জেগে ওঠো জাগো জাগো
...............
জেনেছি চিরকাল মহামারি মহাদুর্যোগে বাবা-মায়ে
ভাইায়ে-ভাইয়ে পরিবার-পরিজন জড়াজড়ি করে
এক সাথে লড়াই করে এক সাথে বাঁচা একসাথে মরা।
যুদ্ধ মানে জেনেছি মাঠে ময়দানে অস্ত্রের ঝংকার
যুদ্ধবিমান মারণাস্ত্রের বিশ্বকাঁপানো খেলা
যুগে যুগে যুদ্ধের কতো রূপ শত্রুর শক্তির মহড়া!
এসব কোথায় ভেসে গেল অদৃশ্য এক অনুজীবের
মরণ কামড়ে মৃত্যুকান্না পৃথিবী সমান-বেওয়ারিশ জীবন।
...............
যে বাবার গায়ের গন্ধে গন্ধমাখা প্রিয় সন্তানের শরীর
যে মা মৃত্যুযন্ত্রণা ভালোবেসে দেখিয়েছে পৃথিবীর আলো
কতো দীর্ঘপথ পেরিয়ে বাড়িতে যাবার অগ্নিবাসনা
মাকে বুকে জড়িয়ে ধরার সমুদ্রশান্তি
বাবার প্রশস্ত দুবাহুর ভেতর নিজের ক্লান্ত শরীর ছেড়ে
ভারহীন নিখাদ শান্তির বুকভরা সুঘ্রাণ নিঃশ্বাস
সব নিষিদ্ধ এখন বেদনায় কাতরায় পৃথিবীর মানচিত্র।
.............
নদী, তুমি কী সহস্রকাল আগে এ কালের মানুষের মতো
বুকের বেদনা আর চোখের জল আপন বুকে নিয়েছিলে তুলে!
এ জন্যেই কী তোমার বাঁধভাঙা বৈশাখীআবেগ
অগ্নিকা বুভুক্ষ বুকে বুক মিশে
স্বপ্নসৌধ তছনছ করে নিষ্ঠুরে আছড়ে পড়ো প্রবল তৃষ্ণায়!
..........
যে রমণী ভালোবেসে জবাফুলে খোঁপা করে নরোম সন্ধ্যায়
প্রেমের কবিতা হয়ে উঠতো হৃদয়ের উঠোনে,
বুকের ভেতওে হয়ে উঠতো আলোর গান সন্ধ্যা প্রদীপের মতো।
এখন এসব করোনাবাতাসে
কতো সহস্র যোজন যোজন দূরের স্বপ্নের অধিক স্বপ্ন।
............
যে সন্তান বেহেস্তের ফুল বাবার বুকের ’পরে
ঘুমায় গহিন রাত ফুলের ঘ্রাণ আর শোভায় ভরে থাকে
তৃষ্ণার্ত দীঘল বুক এমন স্বর্গসুন্দর
ডুবে যায় অচেনা নগরে দূর কোনো মাটির গহিনে;
বুকভাঙা আর্তনাদ অসহায় চোখ আকাশে ঈশ্বর খোঁজে।
..........
যে ভাই ভাইকে বুকে জড়িয়ে ভোরের আলো বুকে মেখে
দিনের কবিতা লেখে সবুজজমিনে বোনের মধুকণ্ঠে
সুধাময় স্রোতে ভাসা দিবস রজনী
কীভাবে যে কোথায় হারিয়ে গেল কী এক অজনা বিষে
ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যু জেনেও করোনাকে হাত পেতে তুলে নেয়
ক্ষুধার্ত মানুষের সারি তাদের মুখের খাবার রাতের তিমিরে
ঢোকে বিষাক্তগর্তে সুফলা সবুজের বুকে এতো শকুনের বাস !
নগ্ন শকুনেরা করোনার কালে আর এক নতুন করোনা
ঘরে ও বাইরে মৃত্যুএখন সবখানেই
.............
রবীন্দ্রনাথ, তোমার কুঠিবাড়ি থেকে ধার করে আনা জবাফুল
আমার বাড়িতে লিখে দিয়েছিলো চিরকালের যৌবনের গান
করোনাবিষের কষ্টে শুকিয়ে গেছে জীবনমৌতাত
অচেনা অদ্ভুত এক মৃত্যুপত্র অনিবার্য পাঠ প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
জানি না আবার কবে যে তোমার যৌবনের গানে
বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবো নতুন আলোতে দাঁড়াবো বুক ভরে!
.............
মাতৃচোখে চেয়ে আছে পৃথিবীর সব পথ কখন ফিরবে
বুকভরা সন্তানেরা উৎসবের রঙে!
কবিতা উৎসব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া আর প্রাণখুলে আড্ডা
কর্মব্যস্ত ক্লান্ত পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যাকুল তৃষ্ণা মুঠো মুঠো সুখ
সবই তো আজ অদৃশ্য দানব দস্যুর দখলে।
মানবতা জেগে ওঠো জাগো জাগো
............
চিরকাল জানি ইতালি চীন জাপান অস্ট্রেলিয়া স্পেন আমেরিকা লন্ডন
স্বর্গসুন্দর দেশ কেউ তো ভাবেনি কখনো
এমন সুন্দর একদিন ঢেকে যাবে লাশের স্তুপে মৃত্যু উপত্যকা!
কে কবে চেয়েছিল এই পৃথিবী পৃথিবীর এমন বীভৎস ছবি!
.................
হয়তো কাল কিংবা কালের মতোই কোন এক সময়
আমিও মরে যাবো জানি না কোথায় কীভাবে দাফন হবে!
নাকি গোপন আগুনে পুড়িয়ে বাতাসে ধোঁয়া করে
আকাশে উড়াবে নিশ্চিহ্ন ঠিকানাহীন
অজস্র বেনামি কবরের ভেতরে হয়তো হারিয়ে যাবো কিংবা
যাবো আকাশের ধোঁয়ায় হারিয়ে মেঘে মেঘে।
..........
বুকভরা সন্তান পৃথিবীসমান তৃষ্ণা; প্রিয়তমা স্ত্রী
অপেক্ষার আগুন চোখে স্বপ্ন্ঋষী হিমালয় উঁচু বাবা-চোখ ভরা জলে
পদ্মা মেঘনা যমুনা নদীতিকা সহস্র জননী
জীবনজড়ানো ভাইবোন আত্মায়বন্দি হৃদয়ের কতো সুহৃদ স্বজন
কেউই জানবে না কোনখানে কীভাবে আছি অথবা আমিও
জানবো না কখন চিরঘুমে ডুবে গেছে আপন বুকের মানিক
হায় পৃথিবী! এমন কতো মৃত্যু এখন তোমার বুক জুড়ে
কঠিন আর্তনাদে আছড়ে পড়ে জননী ভুবন
মৃত্যু ছাড়া আর সব শব্দ দ্রুত নিভে যাচ্ছে নিভে যাচ্ছে
ভয়ঙ্কর অন্ধকারের থেকেও অধিক অন্ধকারে
...................
আকাশে ভাসবে বিবর্ণ চোখেরা
অসহায় হাতগুলো অদৃশ্য শূন্যতায় ডুবে যাবে
এখানেই হয়তো কোথাও আছে প্রিয়জন এখানেই কোথাও ...
..............
কেউ জানবে না, কোনোদিন জানবে না
বুকভরা শেষ বাসনা আমার আমাকে আমার মায়ের পাশে কবর দিও
করোনাকঙ্কাল
জীবন এখন অদ্ভুত বিবর্ণ দিগন্তের বিকেলের গানে
মরণ নিঃশ্বাসে কাতরায় পৃথিবীর অলিগলি রাজপথ
তপস্বা তিমিরে গহন আকুতি ঈশ্বরপ্রার্থনা
নিরুপায় ভাঙা পুতুল করোনা আক্রান্ত পৃথিবী
................
রাতের শরীরে যৌবনা গন্ধ হাসনাহেনা মৌতাত
মাতাতে পারে না পূজো আর অগ্নিকাহৃদয়
ভুল হিসেবে কতো নদী ও সমুদ্র
মরু হয়ে মরে গেছে
মরুভূমির থেকেও বেশি প্রাণহীন লাবণ্যপূজারি পৃথিবী
...........
মৃত্তিকা শরীর সহস্র দিবসে পোড়ে যদি আবার আষাঢ়
আসে অভিমান ভাঙা কৃষ্ণের ব্যাকুল বাঁশরি কান্নায়
হিসেবি জীবন ছিঁড়ে
অবাধ্য রৌদ্রের গাঢ় চুম্বনে জীবনপঙক্তির মুগ্ধ কবিতা
বিশ্ব মানচিত্রে আবার উচ্চারিত হবে অপার্থিব সুন্দরে
..........
সতেজ পাপড়ি মনকাড়া মাতাল গন্ধে যমুনা যৌবন
মৃত্তিকা শরীরে পূর্ণিমার আলো
অন্ধকার ভেঙে নতুন আলোয় উপচে পড়বে প্রমত্ত ঢেউয়ে
মানবতার একই সুর একই সঙ্গীত হবে পৃথিবীর মঞ্চে
...............
সবুজ জমিনে জীবনের গানে মৃত্যু যতোই আসুক
হারবে মৃত্যুই সবুজ পাতার বুকে নতুন আলোয়
ফিরবে নতুন দিন রঙধনু স্বপ্নরঙিন জীবন ফিরবে আবার
সময়ের রশিতে থাকবে বাঁধা ইতিহাসে করোনাকঙ্কাল
এমবি//