ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

করোনা অবরোধ শিথিলীকরণ-ধাপসমূহ

সেলিম জাহান 

প্রকাশিত : ১০:০৪ এএম, ২৮ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:১৩ এএম, ২৮ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে বিভিন্ন দেশ করোনাকালীন অবরোধ শিথিল করছে। আংশিক অবরোধ তুলে দেয়া হচ্ছে ইতালি, স্পেন ও জার্মানিতে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় নানান অবরোধ শিথিল করে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নানান অঙ্গরাজ্যও কোন কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুইডেনে প্রথম থেকেই সীমিত অবরোধ প্রক্রিয়া বলবৎ ছিল। আজ নিউজিল্যান্ড নিজেকে করোনামুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। 

এত সব ঘটনাবলীর সঙ্গে সঙ্গে যেসব দেশে এখন পর্যন্ত কঠোর অবরোধ বলবৎ আছে, সেসব দেশের সরকারের ওপরে নানান মহল থেকে চাপ বাড়ছে অবরোধ তুলে নেয়ার জন্যে। বৃটেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। করোনা-প্রণোদিত অবরোধ তুলে দেয়ার পেছনে যে যুক্তি সবচেয়ে জোরালোভাবে কাজ করছে, তা হচ্ছে করোনা-আরোপিত অর্থনৈতিক ধস ও মন্দা। সেই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে অবরুদ্ধ থাকার কারণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপরে শারীরিক ও মানসিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার তুলে ধরা হচ্ছে। 

নিশ্চিতভাবে অবরোধ তুলে দেয়ার ব্যাপারে আবেগ একটা বড় ভূমিকা পালন করে, কিন্তু সেখানে মূল ভূমিকা হওয়া উচিত বিবেকের। অবরোধ তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ক’টি বিষয় মনে রাখা দরকার:

প্রথমত: পূর্ব নির্ধারিত কিছু নির্ণায়ক এ সিদ্ধান্তের চালিকা শক্তি হওয়া উচিৎ। যেমন, সংক্রমনের হার একটি ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছানো, হাসপাতালে করোনা রোগীর ভর্তি একটি নির্ধারিত স্তরে নেমে আসা, মৃত্যুহার তাৎপর্যহীন সংখ্যায় হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত: অবরোধ শিথিলীকরণ হতে হবে ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে, পর্যায়ক্রমে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনার সঙ্গে এ কাজটি করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনীতি নয়, অকারণ বীরত্ব দেখানো নয়, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধার নয়, কায়েমী স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার নয়, বরং জনগণের মঙ্গলই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। 

তৃতীয়ত: প্রতিটি দেশের অবরোধ শিথিলীকরণ হতে হবে সে দেশের বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সময়ের প্রেক্ষিতে। যেমন, যে দেশগুলোতে করোনা সংক্রমন আগে হয়েছে, অবরোধ শিথিলীকরণও সে সব দেশে আগে হবে সঙ্গত কারণেই। যেকারনে স্পেন ও ইতালিতে সে কাজটি আগে হয়েছে। তেমনিভাবেই কোন কোন ক্ষেত্রে বা কোন কোন খাতে অবরোধ শিথিল করা হবে, সেটাও সে দেশের বাস্তবতার নিরিখেই করতে হবে। সুতরাং স্পেন ‘ক’ খাতকে অবমুক্ত করে দিয়েছে বলেই যে জার্মাানকে তা করতে হবে এমনটা। এ ব্যাপারে ‘হুজুগের’ শিকার হওয়া যাবে না কিছুতেই। এটা প্রতিযোগিতারও বিষয় নয়, লোক-দেখানোরও নয়।

চতুর্থত: করোনা-উদ্বুদ্ধ অবরোধ শিথিলীকরনের ব্যাপারে তুলনামূলক বিচার করার সময়ে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। যেমন, প্রায়শ:ই নিউজিল্যান্ড আর সুইডেনের উদাহরণ তুলে আনা হয় অন্য দেশের প্রেক্ষিতে। যেমন, নিউজিল্যান্ডের লোকসংখ্যা ৪.৮মিলিয়ন এবং সেখানে জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ৪৬ জন। সেখানে বৃটেনের জনসংখ্যা ৬৬ মিলিয়ন ও জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে৬৫০ জন। সুতরাং করোনা ব্যাপারে নিউজিল্যান্ডে যা কাজ করেছে, বৃটেনে তা কেন কাজ করবে না, এ প্রশ্ন অসঙ্গত। তেমনি সুইডেনে এ পর্যন্ত ১৯,০০০ মানুষ করোনা-আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যের সংখ্যা ২,১০০। দেশের ভেতরেও সরকার কর্তৃক অনুসৃতনীতি নিয়ে এখনও বিতর্ক হচ্ছে। সুতরাং সুইডেনের ব্যতিক্রমধর্মী পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে শেষ কথা বলার এখনও সময় আসেনি। 

পঞ্চমত: অবরোধ শিথিলীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচনা হওয়া উচিৎ যে এ সংক্রমনের দ্বিতীয় দফা যাতে না আসে।অবরোধ সময়ের আগে শিথিল করে দিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হোল যাতে দ্বিতীয় তরঙ্গের মতো করোনা সংক্রমন ও মৃত্যু শুরু হয়ে গেল তবে সেটা নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের মতোই হবে। বর্তমানের অসময়ের হঠকারী কাজ যেন পরবর্তী সময়ের দুঃখের কারণ না হয়।

যেসব দেশগুলো আগামী দিনগুলোতে করোনা-অবরোধ শিথিলীকরণের কথা ভাবছে, তারা উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো মেনে নিয়ে কী কী করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে লিখবো আগামীকাল। 

এমবি//