করোনাকালের তারুণ্য শিখা
মাহমুদ মুসা
প্রকাশিত : ১০:৪৫ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৯:৩৮ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার
ভাবুন তো, গ্রামের সেই মধ্যবয়স্কা নারীর কথা, দুই-তিনটা গরুর দুধ দিয়েই যার সংসার চলে। কিংবা যে সবজি বিক্রেতা বাজারে এসে বসে, এই সামাজিক দূরত্বের দিনে তার বাজার ই তো নাই হয়ে গেলো। কেমন আছে পরিচ্ছনতা কর্মীরা, দিনগেলে পাওয়া এক-দেড়শ টাকা মজুরিতে যাদের সংসার চলতো। আর শুধু কি নিম্নবিত্ত মানুষেরা? মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তো হাত ও পাততে পারে না। আর শুধু মানুষের কথাই বলি কেন, ধরুন ঢাকার রাস্তায় যেসব পথপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়, এই জনশূন্যতায় ওরাই বা কি খেয়ে বেঁচে আছে? তাদের কথা কি আদৌ কেউ ভাবছে?
করোনা গোটা দুনিয়াকে এক সমান্তরালে নিয়ে এসেছে। বাসা থেকে বের হলেই মৃত্যুর চোখরাঙ্গানি। বারবার বলা হচ্ছে, বাসায় থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো এদেশের মানুষের বড় একটা অংশের চলবে না। যারা দিন এনে দিন খায়, প্রতিদিন শ্রম বিক্রি না করলে তাদের সংসার চলবে না।
চারিদিকে যখন এমন একের পর এক দুঃখের গল্প, খুব নাটকীয় ভাবে বলাই যায়, কে দিবে তাকে আশা, কে দিবে ভরসা। ইতিহাস বলে, এদেশের বুকে এমন সকল সংগ্রামে, যুদ্ধে সবার আগে সাড়া দিয়েছে এদেশের তরুণেরা, যুবকেরা। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবাজ্জ্বল অধ্যায়, মুক্তিযুদ্ধের কথাই ভাবুন না। মনে পড়ে যায় সেই দুরন্ত ক্র্যাক প্লাটুনের কথা, হিট অ্যান্ড রান- এর মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ করে খোদ রাজধানীর বুকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর ভিত। এই করোনাক্রান্তিতে অবাক হয়ে খেয়াল করা গেল, সারাদেশে এমন অনেক তরুণ দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা তাদের আশেপাশের মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে চায়। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম (রুমী) বীর বিক্রমের আদর্শিক উত্তরাধিকার। অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী ও প্রাণবন্ত তরুণটির সেপ্টেম্বর ’৭১ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। কিন্তু নিশ্চিত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে সে পাড়ি জমায় মুক্তিযুদ্ধে। শহীদ হওয়ার মাধ্যমে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় স্বাধীনতার বেদিমূলে। ক্র্যাক প্লাটুনের এই মহান যোদ্ধার মতই আজকের বাংলাদেশের তরুণেরাও তাদের জীবন-জীবিকার চিন্তা উপেক্ষা করে মাঠে নেমে এসেছে। তারা সেইসব মানুষের দরজায় পৌঁছাতে চায়, যাদের কথা হয়তো আর কেউ ভাবছেও না। একটি মুখের হাসির জন্য এবার অস্ত্র হয়তো ধরতে হবে না, কিন্তু যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, তার ভয়বহতাও কোন অংশে কম নয়। কিন্তু তরুণদের হাতে হয়তো রসদ নেই ঠিকঠাক, ফান্ডিং হলেই তারা পারবে কিংবা কিছু দিকনির্দেশনা , ঠিক যেন মুক্তিযুদ্ধের মতই। একাত্তরের সেই স্পিরিট এ বলীয়ান হয়ে সেখান থেকেই যাত্রা শুরু বিকন বাংলাদেশ (বাংলাদেশ ইমারজেন্সি একশন এগেইন্সট কোভিড-১৯) এর।
করোনায় সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষদের সাহায্য করতে, তরুণ উদ্যোগগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছিলো একটু পৃষ্ঠপোষকতা। এই গ্রুপগুলোর সাথে খুব নিবিড় যোগাযোগ থাকায় দুই বাল্যবন্ধু আশফাক কবির (ফাউন্ডার এবং লিড অরগানাইজার) এবং ফাহিম চৌধুরী (কো-ফাউন্ডার এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডিং এর ইন-চার্জ) ভাবতে থাকেন কীভাবে এই উদ্যোগগুলাকে আলোর মুখ দেখানো যায়।
নিজেরাই ক্ষুদ্র পরিসরে ফান্ডিং করে যাত্রা শুরু করেন এই সামাজিক উদ্যোগগুলোকে। যখন এই স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করে, তখন দেশ এবং দেশের বাইরের শুভানুধ্যায়ীরাও তাদের জায়গা থেকে অবদান রাখতে চাইলেন। সকলের কথা মাথায় রেখে মার্চ মাসের ২৫ তারিখ যাত্রা শুরু করে বিকন বাংলাদেশ। সামাজিক উদ্যোগের আবেদন বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে আসতে থাকে ফান্ডিং। এ যাত্রায় প্রথম মাসেই বিকন বাংলাদেশের কাছে আসে ১৯ লক্ষাধিক টাকা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে বিকন বাংলাদেশ পৌঁছে যায় সিরাজগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা, নারায়নগঞ্জ থেকে মানিকগঞ্জ, গ্রাম থেকে শহর এমনকি দুর্গম চরে। নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষ থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, বিধবা পল্লী থেকে শুরু করে প্রান্তিক খামারি- বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ৮ টি বিভাগের ৪৫টি স্থানে ১২ হাজার ৫০০ মানুষকে সরাসরি এবং ২৭ হাজার ৫০০ মানুষকে আংশিকভাবে অর্থায়ন করেছে বিকন বাংলাদেশ।
ভলান্টিয়ার গ্রুপের হাত হয়ে পৌঁছে গিয়েছে ৭ হাজার এরও বেশি খাবারের প্যাকেট। শুধু রেশন ই নয়, বাচ্চাদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে আর্ট-ক্র্যাফট সামগ্রী, যেন এই দুর্বিপাক তাদের মনস্তত্বকে আঘাত করতে না পারে। “পথপ্রাণীদের আহার সেবা” উদ্যোগ নেয়া মা-মেয়ের মাধ্যমে বিকন বাংলাদেশ রাস্তার প্রাণীদের কাছেও উপস্থিত হয়েছে। বিকন বাংলাদেশ ফান্ড করছে তরুণ উদ্ভাবকদেরও, যারা করোনার পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘ফেস শিল্ডে’র মত উদ্ভাবন নিয়ে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে। সামনের দিনগুলোতে বিকন বাংলাদেশ পৌঁছে যেতে চায়, বৃদ্ধাশ্রম, যৌনকর্মী, ট্রান্সজেন্ডার, মুচি সম্প্রদায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক আদিবাসীসহ এমন মানুষদের কাছে- যারা এখন পর্যন্ত সোশ্যাল সেফটি নেটের বাইরে রয়ে গেছেন।
বিকন বাংলাদেশের ফাউন্ডার এবং লিড অরগানাইজার আশফাক কবির বলেন, বিকন বাংলাদেশ এর কোর টিম, ভলান্টিয়ার এবং ডোনার - সবার কাজের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রস্ফুটিত করার তাগিদ ছিল। বিকন বাংলাদেশ আসলে শুধুমাত্র আরেকটি ফান্ড রেইজিং প্ল্যাটফর্ম হতে চায় না। সংগঠনটি তার কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি যুগোপযুগী বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালে বঙ্গবন্ধুর পাশে অবিচ্ছেদ্যভাবে যার ছবি ভেসে উঠে, সেই তাজউদ্দীন আহমদ এর একটি উক্তি আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। বঙ্গতাজ একদা বলেছিলেন "আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়, কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে।" বিকন বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, আমাদের সকল কাজের পেছনেই আমরা বাংলাদেশকে প্রতিফলিত করতে চাই। যে কারণে বিকন বাংলাদেশের ট্যাগ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে “স্পিরিট অফ ‘৭১”।
কথা হয় ফাহিম চৌধুরীর সাথে, যিনি সংগঠনটির কো-ফাউন্ডার এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডিং এর ইন-চার্জ। ফাহিম জানান, ২০টির ও অধিক ভলান্টিয়ার গ্রুপের সাথে কাজ করার সময় বিকন বাংলাদেশ মাথায় রেখেছে, শুধু ফান্ড করলেই হবে না, পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে তরুণদের সামনে। তাই বিকন বাংলাদেশের ফান্ডে আবেদন থেকে শুরু করে ডকুমেন্টেশন - এই অভিজ্ঞতা যেসব তরুণের হয়েছে, তারা ইতোমধ্যে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, ডোনার ফান্ডের জন্য আবেদন, বাজেটিং এসব দক্ষতা অর্জন করেছেন। এই গ্রুপগুলোর কাজের সমন্বয় এবং ট্রান্সপারেন্সি বজায় রাখতে প্রোজেক্ট কো-অরডিনেটর হিসেবে কাজ করেছে দীপ্ত সাহা, সালেহ রোকন, নাদিয়া আফরিন, মায়িশা আহমেদ নন্দিতা। এর পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ লিড হিসেবে রয়েছেন ফারাহ খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি দিককেও বিকন বাংলাদেশ ধারণ করতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জনমত গঠন, অর্থসহায়তা প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক আবেদন তৈরিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর হতে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভীত বিনির্মাণে ও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এর ভূমিকা। বিকন বাংলাদেশ যখন স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে সহায়তা করা শুরু করে, সবার আগে এগিয়ে আসেন প্রবাসী বাংলদেশীরা। তাঁদের এই অব্যাহত সমর্থন বিকন বাংলাদেশ স্মরণ করতে চায় কৃতজ্ঞতাভরে।
কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হচ্ছেন আমাদের সম্মানিত ডাক্তারগণ। বিকন বাংলাদেশ তাদের জন্য কিছু করতে চায়। ইতোমধ্যে সিলেটে করোনায় নিহত ড. মইনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সম্মান জানাতে সিলেটে মেডিক্যালে পৌঁছে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা সামগ্রী। ডাক্তারদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিকন বাংলাদেশ তার সামর্র্থ্যরে মধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে সুরক্ষাসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার। বিকন বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, পুরো জাতির এগিয়ে আসা উচিত সময়ের এই মহানায়কদের সুরক্ষায়। তাই তাদের যেকোন প্রয়োজন বিকন বাংলাদেশ সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।
কোভিড-১৯ তার ধ্বংসযজ্ঞ কবে শেষ করবে বলা কঠিন। কিন্তু মানবতার উদ্যোগ থেমে থাকতে পারে না, থেমে থাকতে পারে না বাংলাদেশের অপরাজেয় তারুণ্য। আর তাদের সমর্থন জানাতে বিকন বাংলাদেশ সদা প্রস্তুত। এই রমজান মাসে আরো অনেকরকম উদ্যোগ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে বিকন বাংলাদেশ। যদিও দীর্ঘদিনের অচলায়তন হেতু ফান্ড রেইজিং এ শ্লথগতির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু বিকন বাংলাদেশ তার সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে সবটুকু উজাড় করে দিতে চায়। যদি আপনি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষদের জন্য কিছু করতে চান, অথচ রিসোর্স হাতে নেই, বিকন বাংলাদেশ আপনারই অপেক্ষায়। আবার, যদি এমন হয় যে ডোনেট করতে চান, কিন্তু নেই পর্যাপ্ত লোকবল, তাহলেও বিকন বাংলাদেশের মাধ্যমে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায়।
পবিত্র রমজানে সামর্থ্যবান মানুষেরা জাকাত দিয়ে থাকেন। এবারের রমজান যেহেতু একটু বিশেষ পরিস্থিতিতে পালন করতে হচ্ছে, তাই এবার জাকাত পৌঁছে দেয়াটাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। একইভাবে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের হয়তো না খেয়েও রোজা রাখতে হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিকন বাংলাদেশ হতে পারে খুব ভালো একটি প্ল্যাটফর্ম। রমজান মাসে দ্রুততম সময়ে দেশব্যাপী রেশন কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা বিকনের আছে। তাই, নিজের আশেপাশের মানুষের বাইরেও কেউ যদি চান, তাঁর দেয়া জাকাত দেশের কোন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইফতার বা সেহরিতে কাজে লাগবে, বিকন বাংলাদেশ তবে আপনাদেরই অপেক্ষায়।
যে জাতি এক সাগর রক্তের দামে স্বাধীনতা কিনতে পারে, কোন সে মারী-মহামারী তাকে কাবু করতে পারে, বলেন তো! সময় আমাদের অপেক্ষায়।
ডোনেশন অপশন
(Via cheque/cash deposit/online transfer)
Bank: BRAC Bank
Account Name: Ashfaque Kabir
Account Number: 1501203562865001
Branch: Gulshan Branch
(Via Mobile Payment)
bKash (personal) # +8801770550132
(Online Contribution)
GoFundMe Link: https://www.gofundme.com/f/unitedyouthforcovidrelief
“Bangladesh Emergency Action Against COVID-19 (BEACON)” Facebook Group: https://www.facebook.com/groups/524743575106213/
আরকে//