আমদানি-রফতানি বন্ধে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জামাল হোসেন, বেনাপোল (যশোর) থেকে :
প্রকাশিত : ০৬:৩৬ পিএম, ৩ মে ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৬:৫২ পিএম, ৩ মে ২০২০ রবিবার
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে লকডাউনের মধ্যেই পেট্রাপোল-বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রফতানির কাজ শুরু করলেও ফের তা ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
রবিবার সকালে ভারতের বনগাঁর ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়তের পেট্রাপোল সীমান্ত লাগোয়া জয়ন্তীপুর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাসহ এই স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের শতাধিক শ্রমিক এদিন যশোর রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি সীমান্তের ওপারে বেনাপোলেও বহু মানুষ করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে সংবাদ মাধ্যমে।
এই অবস্থায় ওপার বাংলার শ্রমিকরা এপার বাংলার কাজে যুক্ত থাকলে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াবে সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলিতেও। তাই রফতানি হোক বা আমদানি কাজ শুরু হলে করোনা সংক্রণ কোন ভাবেই ঠেকানো যাবে না। ফলে এলাকাবাসীদের স্বার্থে বন্ধ রাখতে হবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বাণিজ্য। এদিকে বিক্ষোভের খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনিক আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভ তুলে নেন গ্রামবাসীরা।
একদিকে বাণিজ্য করিডর খোলার নির্দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। অন্যদিকে সীমান্তে শিথিলতা দেখাতে রাজি নয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ সীমান্তের সমস্ত বাণিজ্য করিডর দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অত্যাবশ্যক পণ্য চলাচল শুরুর নির্দেশ দিলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। দফায় দফায় আমদানি-রফতানি চালুর বিষয়ে আলোচনা করা হলেও রাজ্য সরকার থেকে কোন সুফল বার্তা না পাওয়ায় চালু করা যাচ্ছে না আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। ২৩ মার্চ থেকে ভারতে লকডাউনের কারণে এ পথে আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেওয়া যায়। পেট্রাপোল বন্দর এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার ট্রাক পণ্য নিয়ে আটকে রয়েছে। ভারতীয় রফতানিকারীরা চাইছেন, অন্তত ওই ট্রাকগুলি বাংলাদেশে পাঠানো হোক।
গত ২৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লা রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, নেপাল, ভুটানগামী অত্যাবশকীয় পণ্য আটকে রাখার ফলে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন হচ্ছে। কোনও রাজ্য একতরফা সীমান্ত বন্ধ করতে পারে না। তাই বাণিজ্য করিডরগুলি জ্বালানি, এলপিজি, খাদ্য সামগ্রী, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহণের জন্য খুলে দেওয়া হোক। বাংলাদেশ সীমান্তের যে ক’টি করিডর দিয়ে পণ্য পরিবহণ হয়, সেগুলিও খুলতে বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান সীমান্তে বাণিজ্য করিডর খুললে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না। ফলে সীমান্তে শিথিলতা দেখাতে রাজি নয় রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র এবং নিরাপত্তা অধিকর্তা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে পেট্রাপোল, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও শিলিগুড়ির সীমান্ত পরিস্থিতি খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের রিপোর্টেও এখনই অবাধ বাণিজ্য চালু না-করার কথা বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ঘোষণায় রফতানিকারকরা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখলেও লকডাউনের শুরু থেকেই পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যত বন্ধ। কেন্দ্রের লকডাউন নির্দেশিকায় সীমান্ত দিয়ে অত্যাবশক পণ্যের যাতায়াত চালু রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে তা কার্যত বন্ধ।
ওপারের সূত্র জানায়, লকডাউন শুরু হতেই রাজ্যের বাইরে থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাক পেট্রাপোল থেকে দ্রুত ফিরিয়ে দিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। এখন আটকে থাকা পণ্য ভর্তি ট্রাকের রফতানিকারীরা প্রায় সকলেই স্থানীয়। রাজ্যের বাইরের রফতানিকারী সংখ্যায় কম। অভিযোগ, বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট মহল লকডাউনের মধ্যে বাণিজ্যের কাজ শুরু করতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ীদের বন্ধ রাখতে বলা হয় বেসরকারি ভাবে। কোনও লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
প্রশাসনেরও পাল্টা যুক্তি ছিল। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, বাংলাদেশের জেলাগুলিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বাণিজ্য চালু থাকলে এ দেশের ট্রাক চালকদের বাংলাদেশে পণ্য খালি করতে গিয়ে কয়েকদিন থাকতে হবে। কোনও ভাবে ওই চালক সংক্রামিত হলে এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়বে। তাই বিষয়টির গুরুত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এলাকার মানুষও সরকারে এই যুক্তিকে সমর্থন করেছেন।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ট্রাক চালক বাংলাদেশে গেলে, তারপর ফিরে আসলে তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে থাকতে হবে। এই বিষয়টা মাথায় রেখে কী ভাবে পণ্য রফতানি শুরু করা যায় তা নিয়ে আলোচনা চলে।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, আটকে থাকা ট্রাকগুলির মধ্যে প্রায় ৪০০টি ট্রাকে অত্যাবশ্যক পণ্য রয়েছে বলে কেন্দ্রের দেওয়া তালিকা থেকে জানতে পেরেছি। বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছি, অত্যাবশ্যক পণ্য নিয়ে ট্রাক চালকেরা যাবতীয় সুরক্ষা নিয়ে বেনাপোল যাক। দিনের দিন সেখানে পণ্য খালি করে চলে আসুন। চালকেরা ফিরে এলে তাদের যেন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো না হয়।
পেট্রাপোল এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, আটকে থাকা ট্রাকের মধ্যে মালপত্র নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘদিন ট্রাক আটকে থাকায় ট্রাকগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখনই ট্রাকগুলি বেনাপোলে পাঠাতে না পারলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পরবর্তী সময়ে তা নিতে অস্বীকার করতে পারেন। তাছাড়া পার্কিং-এ ট্রাক থাকায় রোজ ট্রাক প্রতি পার্কিং ফি বাবদ ১৪০০-১৫০০ টাকা করে রফতানিকারীদের দিতে হবে। ফলে আর্থিক ভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এ দেশের ট্রাক থেকে বাংলাদেশের ট্রাকে পণ্য তুলে নেওয়া হোক।
পরিতোষ বিশ^াস বলেন, প্রশাসনের কাছে আমরা আবেদন করেছি, যাবতীয় সুরক্ষা বজায় রেখে আটকে থাকা ট্রাকগুলিকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে যেতে দেওয়া হোক। যদিও জিরো পয়েন্টে পণ্য ওঠানো-নামানো কাজের পরিকাঠামো কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট মহল।
এদিকে ২৮ এপ্রিল পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে অত্যাবশ্যক পণ্য রফতানির কাজ শুরু করতে পেট্রাপোলে বৈঠক করেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী, বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার, রাজ্য সরকার নিযুক্ত উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নোডাল অফিসার সঞ্জয় কুমার থাড়ে, বনগাঁর মহকুমাশাসক কাকলি মুখোপাধ্যায়। ছিলেন শুল্ক দফতর ও বিএসএফের কর্তারা। বৈঠকে ডাকা হয়েছিল ক্লিয়ারিং এজেন্ট সংগঠনের প্রতিনিধি এবং পণ্য রফতানি ও আমদানিকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদেরও। বৈঠকে আটকে থাকা পণ্য কী ভাবে দ্রুত বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ দিনের বৈঠকে আলোচিত সমস্ত প্রস্তাব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। তারপরে দু’দেশের মধ্যে আলোচনায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, কী ভাবে বাণিজ্যের কাজ শুরু করা যায়, তা নিয়ে এ দিন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
অপরদিকে গত ২৯ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার জেলা প্রশাসক চৈতালি চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক পত্রে পেট্রাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষকে পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দর দিয়ে ইন্দো বাংলা বাণিজ্য করণ শুরু করার লক্ষে সর্বোচ্চ সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করনের কথা বলেছেন। মহামারির এই সময় লরি গুলো জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যাবে সেখান থেকে বাংলাদেশের লোক মালামাল বুঝে নেবে যাতে পশ্চিম বাংলার লোকের স্বাহ্য ঝুকি না থাকে। তার পরই শুরু হয় আমদানি বাণিজ্য। এ চিঠির পর ৩০ এপ্রিল ৩ ট্রাক ও ২ মে ৮ ট্রাক ভারতীয় পান, ভূট্রা, পাটের ও মেছতার বীজ নোম্যান্সল্যান্ডে ভারতীয় ট্রাক থেকে বাংলাদেশে ট্রাকে লোড করে দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে ভারত কোন পণ্য নেয়নি। জটিলতা কাটিয়ে উঠে কবে ফের আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হবে সে দিকেই তাকিয়ে দু‘দেশের ব্যবসায়ীসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা।
যখন এভাবে আমদানি কার্যক্রম চলছিল ঠিক সেই সময়ে মালামাল লোড আনলোড করতে না পেরে পেট্রাপোলের বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন ছয়ঘরিয়া নামক স্থানে বেনাপোল সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ এনে (বেনাপোলে করোগা রোগী পাওয়া গেছে, বেনাপোলের শ্রমিকদের থেকে করোনা ছড়াবে) রোববার সকালে বিক্ষোভ করে ওপারে।
ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়তের প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, বনগাঁ শহরসহ ছয়ঘরিয়ার সমস্ত গ্রাম এখনও পর্যন্ত করোনা মুক্ত রয়েছে। স্থানীয় মানুষের দাবি তাঁরা কোন ভাবেই কোন অবস্থাতেই চাইছেন না সীমান্ত পেরিয়ে করোনা সংক্রমণের আঘাতে তছনছ হোক মানুষের জীবন। তাঁরা রুজি-রুটি হারিয়েছেন ঠিকই তবে মানুষের জীবন বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। তাঁদের কথায় সরকারের নির্দেশ যেমন আছে থাক আপাতত এভাবেই কোন অবস্থাতেই সীমান্তে বর্হি বাণিজ্যের কাজ চালু রেখে মানুষের জীবন বিপন্ন করা যাবে না।
আরকে//