ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ইসরাইলের অস্ত্র রপ্তানি মানবসমাজের জন্য হুমকি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৩৬ এএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৭:১৬ পিএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার

অস্ত্রসজ্জিত ইসরাইলি সেনাবাহিনী

অস্ত্রসজ্জিত ইসরাইলি সেনাবাহিনী

১৯৪৮ সালে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই রাষ্ট্রটি প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে খ্যাতি অর্জন করেছে। ইসরাইল প্রতিনিয়ত তার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে বিমান হামলাসহ পৃথিবীর বিছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। 

ইসরায়েল ২০১৮ সালে সামরিক খাতে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। দেশটি নিজেই সামরিক অস্ত্র তৈরি করে, তাই তেমন একটা আমদানি করতে হয় না। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির কাছ থেকে প্রায় ১০৩ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখ ১৫ হাজার। তাদের বহরে আছে ৫৯৫টি যুদ্ধবিমান, ১৪৬টি হেলিকপ্টার, ২৭৬০টি ট্যাংক, ৬টি সাবমেরিন।

প্রকাশ্যে ইসরায়েল থেকে অস্ত্র আমদানি করে এমন দেশের সংখ্যা ত্রিশটিরও বেশি। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলও রয়েছে। আর অপ্রকাশ্যে বা গোপনীয়তা রক্ষা করে ইসরায়েল থেকে অস্ত্র আমদানি করে এমন দেশের সংখ্যাও কম নয়।পাকিস্তানসহ আরও চারটি আরব দেশ মিশর, আলজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্বো অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করে আসছে বলে যুক্তরাজ্য সরকারের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম। প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসরায়েল থেকে রাডার সিস্টেম, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, হেড-আপ ককপিট ডিসপ্লে (এইচইউডি), যুদ্ধবিমানের স্পেয়ার পার্টস ও বিমানের ইঞ্জিন, অত্যাধুনিক লক্ষ্য নির্ধারণী সামরিক সরঞ্জাম, এয়ারক্রাফট ট্রেনিং সরঞ্জাম ও সামরিক ইলেকট্রিনিক সিস্টেম আমদানি করে রাষ্ট্রগুলো।

ইসরাইল শুধু প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে রাষ্ট্রগুলোতে অস্ত্র রপ্তানি করে না, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলোর কাছেও অস্ত্র বিক্রি করে আসছে। আর এই সব বিছিন্নতাবাদি সংগঠনের মধ্যে অধিকাংশ বিছিন্নতাবাদি সংগঠন হচ্ছে মধ্যেপ্রাচ্য ভিত্তিক। সিরিয়া ভিত্তিক বিছিন্নতাবাদি সংগঠন জাইশ আল-ইসলাম, আহরার আল-শাম, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস যারা বাশার আল আসাদ বাহিনী ও তার সহযোগী ইরান ও হিজবুল্লাহ সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এছাড়া কুর্দি বিদ্রোহী বা ওয়াইপিজি যারা আইএস ও তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই সব বিছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলোর কাছে অস্ত্রবিক্রি করে সিরিয়া ও তুরস্ব সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। লিবিয়া ভিত্তিক বিছিন্নতাবাদি সংগঠন জেনারেল খলিফা হাফতারের বিদ্রোহী বাহিনী লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ যারা জাতিসংঘ স্বীকৃত প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ ও বিভিন্ন শহর ভিত্তিক মিলিশিয়ারা একের অন্যের সাথে লড়াই করছে এবং এর মধ্যে ইসলামিক স্টেটের একটি অংশও আছে।

লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ কে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য দিচ্ছে ইসরাইল, সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান ও আরব আমিরাত এই সব বিছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে লিবিয়া সংকট আরও ঘনিভূত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী ও আবদারাবুহ মানসুর হাদির বাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে ইয়েমেন সংকট দীর্ঘস্থায়ী রুপ নিয়েছে। দক্ষিণ সুদানের প্রসিডেন্ট সালভা কির ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচার ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যেকার সংঘর্ষে সেখানে অনেক বেসামরিক মানুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর ইজরাইল দুই পক্ষের কাছেই ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র রপ্তানি করে আসছে। ইসরায়েলের ইংরেজি দৈনিক হারেৎজের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ধর্ষণ ও গণহত্যাসহ নানা ধরনের বর্বরতা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকারের কাছে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ বিক্রি বন্ধ করতে অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। এছাড়া ‘আইডিয়াল কনসেপ্টস’ নামে ইসরায়েলের একটি সামরিক বাহিনীর টিম মিয়ানমারের বিশেষ বাহিনীকে রাখাইন রাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত সামরিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার পর দ্বিতীয় দেশ হচ্ছে ইসরাইল, যে দেশ অস্ত্র রফতানি সবচেয়ে বেশি হারে সস্প্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন অভাবনীয় মাত্রায় বেড়েছে। সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র (এসআইপিআরআই) মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স কো-অপারশন ডিরেক্টরেট’ যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড ও ভারতের ওপর বিশেষ আলোকপাত করে ইসরাইলের অস্ত্র বাজার সম্প্রসারণের ব্যাপক পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এই ডিরেক্টরেট ইসরাইলের অস্ত্র উৎপাদন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রফতানি-সংক্রান্ত ব্যাপারটি দেখাশোনা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় ইসরাইলি অস্ত্রশস্ত্র কেন অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠল? এর কারণ ইসরাইলি অস্ত্র কেনার সাথে কোনো পলিটিক্যাল প্রাইস ট্যাগ থাকে না, অন্য কথায় কোনো রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয় না। এর অর্থ হচ্ছে ইসরাইল শর্তহীনভাবে যেকোনো দেশে অস্ত্র বিক্রি করতে প্রস্তুত, এমনকি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাহীন পক্ষের কাছেও খোলাখুলি কিংবা গোপনে অস্ত্র বিক্রি করতেও দেশটির কোনো আপত্তি নেই। এই অস্ত্র কিনে কারা, কোথায় ব্যবহার করল, তা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার হলো কিনা, তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলো কিনা, সেসব বিষয়ে ইসরাইলের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাদের একমাত্র কথা ‘ডলার দাও, অস্ত্র নাও’।

২০১৯ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’র ইসরাইলি শাখা একটি ইন-ডেপথ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ইসরাইলের অস্ত্র রফতানি বাজার পর্যালোচনা করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, ‘ইসরাইলি ডিফেন্স এক্সপোর্ট কন্ট্রোলস এজেন্সি’র প্রধান র্যাশেল চেনের দাবি হচ্ছে, ‘We will carefully examine the state of human right in each country before approving export licenses for selling them weapns.’ কিন্তু এ এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার। কারণ ইসরাইল অস্ত্র ফেরি করে বেড়ায় বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের কাছে। এদের তালিকায় আছে মিয়ানমার, ফিলিপাইন, দক্ষিণ সুদান,শ্রীলঙ্কা ও মধ্যেপ্রাচ্যের বিছিন্নতাবাদি সংগঠনগুলোর কাছে। র্যাশেল চেনের এই বক্তব্য যে  মিথ্যা তার প্রমাণ হচ্ছে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে ইসরাইল সফরের সময়ে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের দেয়া বক্তব্য। তখন ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিনকে দুতার্তে বলেছিলেন, ‘কোনো রেস্ট্রিকশন না থাকার কারণে এখন থেকে ফিলিপাইন শুধু ইসরাইল থেকেই অস্ত্র কিনবে’। এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল ‘টাইমস অব ইসরাল’-এ। দুতার্তে আরও বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভালো বন্ধু, তবে জার্মানি ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র আনতে হয় নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র দেয় শুধু এই বিবেচনায় যে, এগুলো অবাধে ব্যবহার হবে শুধু দখল করা ফিলিস্তিনের ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরবজাতির বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন যা-ই থাকুক না কেন।’ দুতার্তের এই বক্তব্যকে বিস্ময়করই বলতে হবে।

দক্ষিণ সুদানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও চরম দারিদ্র্যের শিকার হওয়া একটি দেশে যখন অস্ত্র পাঠায়, তখন সেই দেশটির সামান্যতম নৈতিক মান আছে বলে ধরে নেয়া যায় না। ইসরাইলের অস্ত্র রফতানি ও তথাকথিত বাকি দুনিয়ার ‘সিকিউরিটি টেকনোলজির অনন্য একটি দিক হচ্ছে, এগুলো সেখানেই প্রয়োগ করা হয়; যেখানকার মানুষ সবচেয়ে নিপীড়িত ও ভঙ্গুর। উদাহরণ টেনে বলা যায়, বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সরকারের ‘আনডকুমেন্টেড ইমিগ্র্যান্ট’ বিরোধী যুদ্ধে ইসরাইলি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পাশে সামনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। অধিকন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের বর্বর সামরিক কৌশলগুলো ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে মার্কিন সমাজের স্তরে স্তরে। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর সামরিকায়ন। হাজার হাজার আমেরিকান পুলিশ প্রশিক্ষণ নিয়েছে ইসরাইলে।

একইভাবে ২০১৮ সালে ইসরাইলি ‘যুদ্ধপ্রযুক্তি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিকিউরিটি অ্যাপারেটাসে। ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এ ধরনের একটি চুক্তি হয়েছে ইসরাইলি কোম্পানি ‘এলবিট’র সাথে। এই চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেয়া হবে মানববিহীন এয়ারক্র্যাফট সিস্টেম সার্ভিস। এতে ব্যবহার করা হয় ‘হারমিস ৯০০ ম্যারিটাইম পেট্রোল সিস্টেম’। এ ব্যবস্থায় ইউরোপিয়ান বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি ‘ফরটেক্স’ সুযোগ পাবে যুদ্ধকালীন শরণার্থী এবং ইউরাপীয় ভূখন্ডে প্রবেশে ইচ্ছুক অভিবাসীদের প্রতিহত করতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইইউ ইসরাইলের কাছ থেকে সেসব মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র কিনছে, যা ইসরাইলি সেনারা ২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় তথাকথিত প্রটেক্টিভ ওয়্যারের সময় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। 

এসআইপিআরআই এবং অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল যথার্থই বলেছে, ইসরাইলের রফতানি করা অস্ত্রের বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের হাতে। তবে মনে রাখতে হবে ইসরাইল হচ্ছে একটি দুষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ। আর ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে করা অপরাধের জন্য দেশটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এই দায়িত্ব বিশ্ববাসীর। আর তা করতে হলে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সবার আগে এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ, স্নাতক (সম্মান), আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস)।

এমএস/