করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং: আমরা কতদূর?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:০৫ পিএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৭:৩৭ পিএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার
নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর প্রাদুর্ভাব যা গত বৎসরের ডিসেম্বর এ চীনের উহান প্রদেশে প্রথম দেখা দেয় এবং আজ তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একইভাবে সংক্রমিত করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় সারে তিন লক্ষ মানুষ এর সংক্রমন জটিলতায় মারা গেছে। যেহেতু এটা সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাস তাই মানুষের শরীরে এর বিরুদ্ধে পূর্ব হতে কোন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমটা নেই এবং এর কারণেই অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষের দেহে কোন উপসর্গ দেখা যায় না। যাদের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে হচ্ছে জর, কাশি, পেট ব্যথা, ডাইরিয়া, অরুচি, গন্ধহীনতা ইত্যাদি। বয়স্ক রোগী যাদের আগে থেকে অন্যান্য রোগ যেমন- উচ্চরক্তচাপ, এজমা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রয়েছে তাদের মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বেশি। যদিও আমেরিকাতে দেখা গেছে হাসপাতালগুলোতে তীব্র উপসর্গসহ আক্রান্তদের বেশিরভাগের বয়স ৪০ এর নীচে।
গত এপ্রিলে দা জার্নাল প্রসিডিংস অফ দা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএনএএস) এ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যাতে বলা হয় যে তিনটি ভিন্নরূপী (ভ্যারিএন্ট) করোনা ভাইরাস পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সংক্রমিত করে চলেছে। এক প্রকার অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকায়, অন্য এক প্রকার চীনে এবং আর এক প্রকার ইউরোপ সংক্রমিত করে চলেছে। আর এ সবকিছুই জানা সম্ভব হয়েছে কোভিড-১৯ এর সম্পূর্ণ জিনোমে সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে।
জিনোমে সিকোয়েন্সিং হচ্ছে এমন একটা পদ্ধতি যার মাধ্যমে কোনো প্রাণী/উদ্ভিদ বা জীবাণুর জিনগত তথ্য যা ডিএনএ বা আরএনএ তে সংরক্ষিত থাকে তা জানতে ও বুঝতে পারা যায়। করোনা পজিটিভ রোগীর জিনোমে সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে আমরা বলতে পারবো এই রোগীর দেহে যে ভাইরাস তার উৎস কোথায়। যেমনঃ বাংলাদেশ এ যে করোনা ভাইরাস পাওয়া যাবে তার উৎস কি চীন, নাকি ইউরোপ,নাকি আমেরিকা তা এই জিনোমে সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে জানা সম্ভব হবে। কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি কারনে। যেমনঃ ভাইরাস সংক্রমণ বুঝতে এটা খুব জরুরি। যদিও কোভিড-১৯ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এর মত দ্রুত বদলায় না তথাপী বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানুষে মানুষে সঙ্ক্রমন এর সময় কোভিড-১৯ দুই মাস অন্তর অন্তর বদলায়। এটা বোঝার একমাত্র উপায় জিনোমে সিকোয়েন্সিং। টীকা ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য জিনোমে সিকোয়েন্সিং দরকার। ভাইরাস কিভাবে তার জিনগত বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে তা বুঝে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির জন্যও জিনোমে সিকোয়েন্সিং দরকার।
জিনোমে সিকোয়েন্সিং এর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কোভিড-১৯ হচ্ছে জানামতে সর্ববৃহৎ আরএনএ জিনোমবাহী (২৬.৪-৩১.৭ কেবি) ভাইরাস। সাধারণভাবে কোভিড-১৯ এর আরএনএ সংগ্রহ করার পরে একে প্রথমে ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত করা হয়। এরপর আরএনএ কে ডিএনএ তে রূপান্তরিত করা হয় এবং পিসিআর এর মাধ্যমে এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। এর পর প্রতিটি ছোট ছোট টুকরোগুলোকে আলাদাভাবে নির্ণয় করে পরিশেষে একত্র করে সিকোয়েন্সিং সম্পূর্ণ করা হয়।
যদিও আগে শুধু বড় বড় পরীক্ষাগারে করা হতো কিন্তু উন্নত প্রজুক্তির কারনে ছোট ছোট পরীক্ষাগারেও জিনোমে সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে। কিছু ইন-হাউস সিকোয়েন্সিং ডিভাইস যেগুলো স্মার্টফোন বা স্যুটকেস এর আকারের এবং এর মাধ্যমে ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পারে যায়।
বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারিতে বিভিন্নদেশের বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করছেন। ডব্লিউএইচও একটি ডাটাবেস তৈরি করেছে যার নাম জিআইএআইডি যেখানে বিজ্ঞানিরা ১১ হাজারের অধিক কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং আপলোড করেছেন। এটা একটি ওপেন সোর্স ডাটাবেস যে কেউ নিবন্ধন করে সেখান থেকে তথ্য বের করে বিশ্লেষণ করতে পারে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের বিজ্ঞানীরাই কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালের বিজ্ঞানিরা পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ এর কেউ এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন কিনা জানা নেই। এটা জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। আমরা দেখেছি এবং দেখছি বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয়হীনতা। যেমন- কোভিড-১৯ টেস্ট এর জন্য যে আরটি-পিসিআর করা হয়, এর অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ডাক্তার বা টেকনোলজিস্ট এর নেই; তা সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের (বায়োকেমিস্ট/মাইক্রোবায়োলজিস্ট) কাজে লাগানো হয়নি। যদিও এখন তারা একাজে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের যে সব সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে যেমন: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি; রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, যেখানে অনেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা/ডাক্তার কর্মরত আছেন। যদিও তারা কতটুকু গবেষণা করেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আমার জানা নেই এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়গণ কি করছেন। আমরা জানি সরকার যে অর্থ বরাদ্দ দেন তা দিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা খুব কঠিন। আশাকরি সরকার গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে ভবিষ্যতে গবেষণা খাতে আরও অর্থ বরাদ্দ দেবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়গণও লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি ছেড়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন। আমার জানা মতে দেশের কয়েকটি ল্যাবে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা সম্ভব এবং আশা করি খুব দ্রুত কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হবে। আমরা যারা দেশের বাহিরে গবেষণায় যুক্ত আছি তারাও এ কাজে এগিয়ে আসতে পারি। কিন্তু সবার আগে স্বাস্থ্য বিভাগকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করে এই যুদ্ধে জয়ী হবো এটাই কামনা।
লেখক: ড. মো. মনিরুজ্জামান (সজল), গবেষণারত, আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
Email: monirujj@ualberta.ca