ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

সোনালী সকালের সূচনা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:১২ পিএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৫:০২ পিএম, ৪ মে ২০২০ সোমবার

খাদিজার মৃত্যুর পর তাঁর ঘর হয়ে যায় অগোছালো। বাচ্চারা সব ছোট। আর তাদের দেখাশোনার কেউ নেই। নবীজী এসময় সওদা বিনতে জাময়াকে বিয়ে করলেন। সওদার বয়স ছিল তখন ৪০-এর ওপর। বিয়ের দেনমোহর ধার্য হয় ৪০০ দিরহাম। সওদা অবশ্য প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজীর পরামর্শে স্বামী সাকরান ইবনে আমর ইবনে আব্দ শামসের সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। মক্কায় ফিরে আসার পর এক পুত্র সন্তান রেখে তার স্বামী মারা যান। রসূলের এ বিয়ের মধ্য দিয়ে একদিকে মৃত সহযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীকে সামাজিক সম্মান প্রদান ও অপরদিকে নাবালক শিশুদের দেখাশোনার সমস্যার সমাধান হলো।

মেরাজের ঘটনা শোনার সাথে সাথে তাতে সন্দেহাতীত বিশ্বাস ব্যক্ত করায় নবীজী আবু বকরকে ‘সিদ্দীক’ অর্থাৎ ‘সত্যের সাক্ষী’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। আবু বকর ‘সিদ্দীক’ শব্দটি এতই পছন্দ করেন যে পরবর্তীতে এটি তার নামের অংশ হয়ে যায়। আত্মিক একাত্মতার পাশাপাশি সামাজিক একাত্মতাকে আরো গভীর করার মানসে নবীজী আবু বকরের কাছে তার কন্যা আয়েশাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করলেন। তিনি অত্যন্ত আনন্দিতচিত্তে এতে সম্মতি দিলেন। তখনই বাগদান হলো। দেনমোহর ধার্য হলো ৫০০ দিরহাম। দাম্পত্য জীবন শুরু করলেন মদিনায় হিজরতের পরে শাওয়াল মাসে।

আবু বকরের সাথে আত্মীয়তার মাধ্যমে শুধু যে সামাজিক একাত্মতা তা নয়, এ বিয়ের প্রস্তাবে নবীজীর দূরদৃষ্টির গভীরতাই প্রকাশ পায়। আয়েশা ছিলেন সাহসী, বুদ্ধিমতি ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। নবীজীবনকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। নবীজীর ওফাতের পরও ৫০ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। হাদিসের এক বিশাল সংগ্রহ আমরা পাই তার কাছ থেকে। তার কাছ থেকে বড় বড় সাহাবি ও তাবেঈন মুহাদ্দিসরা সরাসরি হাদিসের জ্ঞান লাভ করেছেন। শীর্ষ পাঁচ জন হাদিস বর্ণনাকারীর একজন হিসেবে আয়েশা আজো অমর হয়ে আছেন।

মেরাজ নবী-অন্তরকে আবারও নিশ্চিত করল, প্রভু কখনো তাঁকে ত্যাগ করবেন না। আবু বকরের নবী-বিশ্বাস এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিশ্বাসীদের অন্তরকে আপ্লুত করল স্রষ্টাপ্রেমে। স্রষ্টার জন্যে সবকিছু উৎসর্গ করার প্রত্যয়ে যুক্ত হলো নতুন উদ্দীপনা। অপরদিকে কোরাইশদের বিরোধিতাও পেল নতুন মাত্রা। মেরাজের পুরো বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অপপ্রচারের সয়লাব বয়ে গেল। মুসলমানদের হেনস্তা করার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করল। 

নবীজী একদিন দুপুরে যখন কাবার সামনে নামাজে সেজদারত ছিলেন, আবু লাহাব তখন তাঁর ওপর উটের পচা নাড়িভুঁড়ি আনিয়ে স্তুপাকারে ফেলার ব্যবস্থা করলেন। পুঁতিগন্ধময় নাড়িভুঁড়ির পরিমাণ এতটাই ছিল যে, এর ভারে নবীজী মাথাই তুলতে পারছিলেন না। শিশুকন্যা ফাতিমা এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে সাহসীকতার সাথে দু’হাত দিয়ে সব ময়লা সরানোর পরই তিনি মাথা তুলতে সক্ষম হলেন। সন্ত্রস্ত সদ্য মাতৃহারা শিশুকন্যার চোখের পানির প্রতিটি ফোঁটা একজন সন্তানবৎসল পিতার অন্তরে কী পরিমাণ দুঃখ ঢেলে দিতে পারে তা যে-কেউ অনুমান করতে পারেন। কিন্তু নবীজী তখন কন্যাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘ফাতেমা কেঁদো না। তোমার পিতার রক্ষাকারী হচ্ছেন আল্লাহ!’ নবীজীর প্রতিই যখন এই আচরণ, তখন তাঁর অনুসারীদের সাথে দৈনন্দিন আচরণ কত লাঞ্ছনাপূর্ণ হতে পারে তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

কিন্তু বিরোধীপক্ষের আচরণ যত হিংসাত্মক হোক না কেন তিনি বা তাঁর অনুসারীরা কখনো হিংসার আশ্রয় নেন নি। তারা কখনো ধনসম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতা বা রাজত্ব চান নি। তারা শুধু যা সত্য বলে জেনেছেন, তা বিশ্বাস করেছেন। নিজেরা সে সত্যের অনুসরণ করেছেন। পরিচিতজনদেরকে সে সত্যের পথে ডেকেছেন। যারা তাঁর প্রতি অন্যায়-অত্যাচার করেছে তিনি তাদের জন্যে প্রার্থনা করেছেন— যাতে তারা পৌত্তলিকতার জোয়াল থেকে মুক্তি পায়, অনৈতিকতা ও প্রতিহিংসা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

কোনো নির্যাতন বা প্ররোচনার মুখেও তারা কোনো ধরনের হিংসার আশ্রয় নেননি। প্রতিহিংসার চেয়ে সত্যের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকে তারা শ্রেয় মনে করেছেন। তবে নিজেদের বিশ্বাস ও লক্ষ্যে অটল থেকেছেন সবসময়। চেতনার বিস্তারে ও আত্মমুক্তির অন্বেষায় অহিংসার এই সর্বাত্মক অনুসরণ নিঃসন্দেহে মানব ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। 

বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসী কোরাইশদের অব্যাহত নিপীড়নের কারণে মক্কাবাসীদের মধ্যে ইসলামের প্রচারের সুযোগ হয়ে গেলো একেবারেই সংকুচিত। নবীজী বুঝতে পারলেন এখন মক্কার বৈরী পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে হবে। এমন পরিমণ্ডলে যেতে হবে যেখানে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে আল্লাহর উপাসনায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। তিনি হজ ও মেলার সময়টাকে বেছে নিলেন। দূরদূরান্তের গোত্রপ্রধান ও সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসের বাণী পৌঁছাতে শুরু করলেন। বিভিন্ন গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সময় নবীজীর সঙ্গী ছিলেন আবু বকর। আবু বকর আরব গোত্রগুলোর ইতিহাস খুব ভালোভাবে জানতেন, জানতেন প্রতিটি গোত্রের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে। প্রত্যেক গোত্রকেই তিনি প্রশ্ন করতেন তাদের জনবল সম্পর্কে, তাদের আত্মরক্ষার সামর্থ্য সম্পর্কে। তাদের রণদক্ষতা সম্পর্কে। তারপর নবীজী তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন। কারণ শুধু ধর্মের দাওয়াত দেয়া নয়, শক্তিশালী গোত্রের সামরিক সুরক্ষা লাভও ছিল এই যোগাযোগের লক্ষ্য।

নবীজী সুস্পষ্ট ভাষায় তাদের বলতেন, ‘হে অমুক! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসুল। আল্লাহ নির্দেশ পাঠিয়েছেন, তোমরা শুধু আল্লাহরই উপাসনা করবে। তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। তাঁকে ছাড়া আর যা কিছুর উপাসনা করছ তা পরিত্যাগ করো। তোমরা আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করো। যাতে করে আমি আল্লাহর বাণী সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি।’ মিনায় আগত গোত্রপতিদের তিনি সুস্পষ্টভাবে বলতেন, ‘তোমরা আমার শিক্ষা অনুসরণ করো। আমাকে ‘সুরক্ষা’ দাও। তোমরা অচিরেই পার্শ্ববর্তী বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের মালিক হবে।’

অবশ্য আবু লাহাব সবসময় ছায়ার মতো পেছনে লেগে থাকত। নবীজী কারো সাথে আলাপ শেষ করতে না করতেই সে বলত, এ ক্ষেপাটে লোক। আমি ওর আপন চাচা। এর কথা তোমরা শুনো না। এ পিতৃপুরুষের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে বিচ্যুত করতে চাচ্ছে। তোমাদের অন্তর থেকে লাত ও ওজ্জাকে আসনচ্যুত করতে চাচ্ছে। তোমাদের গোত্রীয় সম্প্রীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে। ওর আসলে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এ কথায় আগন্তুকরা তাঁকে ছেড়ে চলে যেত। সাধারণভাবে তারা নবীজীকে বলত, ‘দেখুন আপনার আত্মীয়রা আপনাকে ভালো চেনে। আগে তাদের বোঝান। পরে না হয় আমরা বুঝব।’

নবুয়তের দশম বছরে নবীজী মিনায় বনু কিনদাহ, কালব গোত্রের বনু আবদুল্লাহ, বনু হানিফা, বনু আমির ইবনে সাসা, বনু ফাজারা, বনু ঘাসসান, বনু মুররাহ, বনু সুলাইম, বনু আবস, বনু নাদর, বনু বাক্কা, বনু উজরা, বনু শায়বান গোত্রপতিদের সাথে দেখা করে এই একই আহ্বান জানান। কিন্তু আবু লাহাবের বক্তব্যের পর ‘সুরক্ষা’ তো দূরের কথা সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অনেকেই দুর্ব্যবহার করে। ১৫টি গোত্রের মধ্যে বনু শায়বান গোত্রপতির বক্তব্য ছিল সবচেয়ে সম্মানজনক। তিনি বাস্তবতার উল্লেখ করে বলেন, আমার গোত্রের অবস্থান পারস্য সম্রাটের এলাকা সংলগ্ন। পারস্য সম্রাট অসন্তুষ্ট হন এমন কোনো কাজ সেখানে সম্ভব নয়। আমার মনে হয় আপনার বাণী পারস্য সম্রাট অপছন্দ করবেন। নবীজী তখন তাকে বললেন, আপনি যথার্থ সত্য বলেছেন। এ ঘটনার দশ বছর পর আবু বকরের খেলাফতকালে বনু শায়বান গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এদের দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা পারস্য সাম্রাজ্যের পতনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। 

এদিকে, পর পর ১৫টি গোত্রের প্রতিনিধিদের প্রত্যাখ্যান নবীজীর কর্মতৎপরতায় কোনো ধরনের প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। মেরাজের পর থেকে তিনি আরো নিশ্চিত হয়েছেন যে, নৈতিক ও মানবিক অবক্ষয়ের কারণে পারস্য ও বাইজেন্টাইনের পতন ঘটবে। নৈতিক ও মানবিক চেতনার পুনরুত্থান হবে। আর ইতিহাসের এই বাঁক বদলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যেই তিনি প্রেরিত হয়েছেন। তাই সত্যের বাণী নিয়ে তিনি আগন্তুকদের কাছে ছুটে গেছেন নিরলসভাবে।

মনস্তাত্বিক যুদ্ধের অপর নাম হচ্ছে অপপ্রচার। কোরাইশরা সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে মুহাম্মদকে একঘরে করে নিঃসঙ্গ ও শক্তিহীন করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এবার পুরোদমে শুরু করলো অপপ্রচার। অপপ্রচারের একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রচারক সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য নিন্দাকারীই পৌঁছে দেয় সাধারণের কাছে। অপপ্রচারকারীর তৎপরতা ছাড়া হয়তো এই চিন্তা বা মতবাদ বা ব্যক্তি সম্পর্কে কোনোকিছুই হয়তো সে জানত না। যদিও প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক তথ্য সে পাচ্ছে। এতে প্রাথমিক বিরূপতা সৃষ্টি হলেও তার মনে জাগে কৌতূহল। বাড়ে আরো জানার আগ্রহ—আসল সত্য জানার আগ্রহ। আসলে প্রচারকের অর্ধেক কাজ করে দেয় অপপ্রচারকারীরাই। সত্য বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সবসময়ই শুভ ফল নিয়ে আসে।

নবীজীর ক্ষেত্রেও ঘটল তা-ই। অপপ্রচারের পরিণতিতে মক্কার বাইরে দ্রুত ছড়াতে লাগল ইসলামের বাণী। দাওস গোত্রের প্রধান আল তোফায়েল ইবনে আমর ছিলেন বিশিষ্ট জ্ঞানী ও কবি। তিনি মক্কায় এলে কোরাইশরা তাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিল। মুহাম্মদের জাদুকরী কথার প্রভাবে তার জীবন এবং তার গোত্রের জীবনও কোরাইশদের মতো বিপন্ন হতে পারে। তাই সে যেন মুহাম্মদের নিকটবর্তী না হয় এবং তাঁর কথা শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। একদিন তোফায়েলের মনে প্রশ্ন জাগল, আমি একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আমাকে ভুল কথা বলে আরেকজন কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে! আমার অবশ্যই তার কথা শোনা উচিত। কথাগুলো অযৌক্তিক হলে আমার বিবেকই তা প্রত্যাখ্যান করবে। আর কথা যুক্তিসঙ্গত হলে, তা গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায়? অন্যের কথায় নয়, আমি নিজে শুনে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব—এটাইতো যুক্তির কথা।

তোফায়েল ইবনে আমর একদিন মুহাম্মদের পেছনে পেছনে তার বাসায় গেলেন। নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। নবীজী ধর্মের কথা বললেন। কোরআন তেলাওয়াত করে শুনালেন। তোফায়েল সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। নিজের গোত্রে ফিরে গেলেন। গোত্রের অনেককেই ইসলামে দীক্ষিত করলেন। 

কোরাইশদের অপপ্রচারে আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের মধ্যেও কৌতূহল সৃষ্টি হলো নতুন ধর্ম সম্পর্কে জানার। বদরের গিফার গোত্রের তরুণ আবু জর মক্কায় এসে গোপনে নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। নবীজীর বক্তব্য শুনে তিনি এতটাই উল্লসিত হয়ে ওঠেন যে, কাবা প্রাঙ্গণে গিয়ে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। আর কোরাইশদের হাতে গণপ্রহারের শিকার হন। 

শুধু পৌত্তলিকরাই নয়—এ সময় আরবের খ্রিষ্টানদের মধ্যেও ইসলাম সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। ২০ জন খ্রিষ্টানের একটি প্রতিনিধি দল সত্য অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমণ করেন। তারা নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এবং কোরআনের বাণী শুনে তারা সবাই তৎক্ষণাৎ নবীজীর কাছে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কোরাইশরা খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলকে নানাভাবে হেনস্তা করে। মদিনার বিশিষ্ট অভিজাত সুওয়াইদ বিন সামিত মক্কায় হজ করতে এলে নবীজী তার সাথে দেখা করলেন। তাকে কোরআনের বাণী শোনালেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। একই সময় মদিনার বনু আবদাল আশহাল গোত্রের তরুণ ইয়াস ইবনে মুয়াজ হজ করতে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।

সোনালী সকালের আগমন সবসময়ই ঘটে গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে। মক্কায় যখন গাঢ় অন্ধকার, তখন ৫০০ কিলোমিটার দূরে মদিনায় দেখা দিল ক্ষীণ আলোর রেখা। মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে মদিনা এক সমৃদ্ধ মরুদ্যান। আউস এবং খাজরাজ গোত্রের বাস। আদিতে এক গোত্রই ছিল তারা। কাল প্রবাহে দুই প্রধান গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের তিনপাশে ইহুদিদের বড়োসড়ো গোত্র বনু নাজির, বনু কায়নুকা, বনু কোরাইজা। এখানে এক শতাব্দী আগে এদের সমবেত হওয়ার কারণ হচ্ছে, তাদের কিতাবে লেখা ছিল তাদের শেষ নবী এখানে এসে রাজ্য স্থাপন করবেন।

মদিনার খেজুর ছিল সারা আরবে জনপ্রিয়। আর খেজুরই ছিল তখন আরবদের মূল খাবার। অন্যদিকে, মদিনার মূল শক্তি ছিল আউস ও খাজরাজরা। কিন্তু তারা ছিল শতাব্দীকাল ধরে পরস্পর যুদ্ধমান। মাঝে মাঝেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো তাদের মধ্যে। সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে বুয়াসের যুদ্ধ। এতে উভয়পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ বহু হতাহত হয়। এই যুদ্ধের পরিণতিতে ইহুদিরা মদিনার প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বিজয়ী ও বিজিত উভয়পক্ষই অনুভব করে তাদের বিয়োগান্ত পরিণতি। হতাহতের ভয়াবহতায় উভয়পক্ষের লোকজনই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে ভাবতে থাকে।

কিন্তু ইহুদিরা সবসময়ই দুই পক্ষের বন্ধু সেজে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখত। এতে ইহুদিদের সুবিধা ছিল দ্বিবিধ। ইহুদিদের আদি ব্যবসা হচ্ছে অর্থলগ্নি- সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেয়া। যুদ্ধমান দুই পক্ষকেই যুদ্ধ ব্যয়ের জন্যে তারা টাকা ধার দিত। দ্বিতীয়ত, অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত তারা। তাই ক্রমাগত সংঘাত লাগিয়ে রাখতে তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। অর্থ ও অস্ত্রে প্রবল হলেও যেহেতু তারা সংখ্যালঘু, তাই তাদের সাথে যে-কোনো ঝগড়া-বিবাদে তারা আউস ও খাজরাজদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করত। ইহুদিরা বলত, তাদের প্রতিশ্রুত নবীর আগমনের সময় হয়ে গেছে। তিনি পুরো আরবভূমি জয় করবেন। তখন তোমাদের মজা বোঝাব!

আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকজন তাই আরবে একজন নবীর আগমন সম্পর্কে ইহুদিদের কাছ থেকে আগেই জেনেছিল। তারা অন্যান্য আরবদের মতোই কাবায় যেত তীর্থযাত্রায় জিলহজ্জ মাসে। খাজরাজ গোত্রের একদল যুবক তীর্থযাত্রায় এসে মিনার কাছে তাঁবুতে অবস্থান করছিল। নবীজী স্বভাব-সুলভভাবেই নবাগতদের খুঁজতে খুঁজতে সেখানে উপস্থিত হলেন। তাদের আলাপ শুনেই নবীজী বুঝলেন এরা ইহুদিদের প্রতিবেশী। নবীজী তাদের কোরআনের আয়াত শোনালেন। ধর্মের ব্যাখ্যা দিলেন। তাদের কয়েকজন অন্যদের বলল, ‘নিশ্চয়ই ইনি সেই নবী যার উল্লেখ করে ইহুদিরা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। তারা যেন আমাদের আগে এই নবীকে অনুসরণ করতে না পারে, আমাদের সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

মদিনার আরবরা ইহুদি ধর্মকে নিজেদের পৌত্তলিক ধর্মের চেয়ে উন্নত মনে করত। তাই একত্ববাদ গ্রহণ করতে তাদের সময় লাগল না। আসাদ ইবনে জুরারাহ, আউফ ইবনে হারিস, রাফি ইবনে মালিক, কুতবা ইবনে আমির, উকবা ইবনে আমির এবং জাবির ইবনে আবদুল্লাহ—খাজরাজ গোত্রের এই ছয় জন ইসলাম গ্রহণ করলেন নবুয়তের ১১তম বছরে। শতাব্দীব্যাপী গোত্রীয় সংঘাতে বিক্ষুব্ধ বায়াতকারীরা মন্তব্য করল, আল্লাহ যদি আপনার মাধ্যমে আমাদের দুই গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করেন, তবে আপনি হবেন আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ। 

খাজরাজ গোত্রের এই ছয় জন যুবককে নবীজী আহ্বান জানালেন, নিজ গোত্রের সবার কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে। তারা ফিরে গিয়ে প্রবল উৎসাহে মদিনায় ইসলামের কথা বলা শুরু করল। আসলে হিংসা ও সহিংসতায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মদিনার অধিবাসীরা শান্তির জন্যে উন্মুখ হয়ে ছিল। ইসলামের বাণীর মধ্যে তাদের শত বছরের হানাহানির অবসানের সম্ভাবনা দেখতে পেল। ঘরে ঘরে ইসলাম নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করল। অনেকেই উন্মুখ হয়ে উঠল নবীজীকে দেখার জন্যে। আর এই দেখা সম্ভব শুধু জিলহজ্জ মাসের তীর্থযাত্রার মৌসুমে।

বার্ষিক হজের মাসে মদিনার খাজরাজ গোত্রের ১০ জন এবং আউস গোত্রের দুই জনসহ মোট ১২ জন মক্কার কাছে আকাবায় নবীজীর সাথে গোপনে মিলিত হলেন। তারা নবীজীর কাছে বায়াত করলেন অর্থাৎ শপথ করলেন যে, যে-কোনো প্রতিকূলতার মুখে তারা নবীজীর সাথে থাকবেন। এটাই আকাবার প্রথম বায়াত বা শপথ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত। নবীজী মদিনায় ইসলামের প্রচারের জন্যে ১২ জন বায়াতকারীর সাথে মুসআব ইবনে উমায়েরকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করলেন। মুসআব ছিলেন নবীজীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী, কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী এবং নবাগতদের সাথে আলাপচারিতায় দক্ষ। প্রচারক হিসেবে তিনি অসাধারণ সাফল্য লাভ করলেন। নবীজী তাকে খাজরাজ এবং আউস উভয় গোত্রের প্রতি মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

মুসআব সেভাবেই কাজ শুরু করলেন। আউস গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সাদ ইবনে মুয়াজ, উসায়েদ ইবনে হুযায়র ইসলাম গ্রহণ করলেন। সাদ ইবনে মুয়াজের নেতৃত্বে আবদুল আশহাল গোত্রের সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর বনু নাজ্জার গোত্রও ইসলাম গ্রহণ করলেন। বছর শেষে হজ মৌসুমে মুসআব মক্কায় ফিরে এসে নবীজীকে জানালেন যে, মদিনার এমন কোনো ঘর নেই যেখানে কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ করেন নি।

মদিনার ভৌগোলিক অবস্থান ও জনবসতির সামাজিক বুনন সম্পর্কেও মুসআব নবীজীকে সুস্পষ্ট ধারণা দিলেন। নগরীর পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে আগ্নেয়শিলার পাথরের পাহাড়, যা অতিক্রম করে আক্রমণ করা কোনো বাহিনীর পক্ষে প্রায় অসাধ্য। শহরে শুধু উত্তর দিকের সমতল ভূমি দিয়েই আক্রমণ করা সম্ভব। অন্যান্য সবদিকেই খেজুর বাগান। অসংখ্য খেজুর গাছ, যার ভেতর দিয়ে কোনো বাহিনীর পক্ষেই আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব নয়। ভৌগোলিক দিক থেকে মদিনা অনেক বেশি সুরক্ষিত। আর আউস ও খাজরাজ গোত্র সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে সারা আরবে খ্যাত। তাই মদিনা কখনো বাইরের কোনো বাহিনী দ্বারা অধিকৃত হয়নি বা কোনো আক্রমণকারী বাহিনীকে করও দিতে হয়নি। আর সামাজিক বুননে মুসলমানদের বাইরে একটা বড় অংশ থাকবে পৌত্তলিক। কিন্তু তারা কোরাইশদের মতো কট্টরবিরোধী হবে না। আর ইসলাম সম্পর্কে এখনো ইহুদিদের দৃষ্টিভঙ্গি অস্পষ্ট, যদিও তারা তাদের নবীর আগমনের জন্যে অপেক্ষমাণ।

মক্কায় নবীজী তখন পার করছিলেন এক দুঃসহনীয় সময়। কোরাইশদের অসহিষ্ণুতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছিল। বনু হাশিম বা বনু মুত্তালিবরা হয়তো তাকে দৈহিক নির্যাতন থেকে কিছুটা রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু মুসলমানদের উচ্ছেদে সামগ্রিক কোরাইশি আগ্রাসনের মোকাবেলায় তারা কোনো সুরক্ষা দিতে পারবে না। সন্দেহ নেই, ধর্মবিশ্বাস একজন মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তি এবং সবচেয়ে মূল্যবান অন্তর্সম্পদ, যার জন্যে সে তার সম্পত্তি, শান্তি, স্বাধীনতা এমনকি জীবনও বিসর্জন দিতে পারে। এটাও সত্য যে, দৈহিক নির্যাতন প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই ধর্মবিশ্বাসকে প্রজ্বলিত ও দৃঢ় করে। তারপরও সত্য হচ্ছে- ক্রমাগত দৈহিক আঘাত, কষ্ট, নির্যাতন, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা বিশ্বাসীর কাছ থেকে কেড়ে নেয় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যান, অন্তর্দৃষ্টি ও সাধনার সুযোগ। এই সাধনাই আসলে একজন ধার্মিককে চূড়ান্ত সত্য সম্পর্কিত সচেতনতার গভীরতর স্তরে নিয়ে বিশ্বাসকে ত্বরীয় আনন্দে ভূষিত করে।

চূড়ান্ত সত্যকে সচেতনতার গভীরে উপলব্ধি করার মানসেই নবীজী ইতঃপূর্বে তাঁর অনুসারীদের আবিসিনিয়ার নিরাপদ পরিবেশে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন, আত্মিক উন্নয়নের জন্যে প্রয়োজন নিরাপদ ভূখন্ড। যেখানে কোরাইশরা নির্যাতন চালাতে পারবে না। এখন মক্কায় অবস্থানরত অনুসারীদেরও একইভাবে বাইরে পাঠানো প্রয়োজন। নবীজী স্পষ্টত বুঝলেন, এই লক্ষ্যে গোপন নিশ্চিত প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই। তাই আস্থায় নিতে হবে মদিনার নতুন অনুসারীদের।

গোপন বৈঠকের তারিখ ঠিক হলো হজের শেষ রাত। স্থান হবে প্রথম বায়াতের স্থান আকাবায়। মক্কায় নবীজীর ধর্মপ্রচারের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। বৈঠকে অংশ নিলেন আউস ও খাজরাজ গোত্রের ৭৩ জন পুরুষ ও দুই জন মহিলা। মোট ৭৫ জন। বৈঠক সফল করার জন্যে সব ধরনের গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। সময় নির্ধারিত হয় মধ্যরাতে। সর্বদক্ষিণের জনমানবহীন পাহাড়ি গিরিপথকে স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। যাতে মধ্যরাতে হঠাৎ কেউ উঠে পড়লেও কাউকে দেখতে না পায়। মদিনার বায়াত গ্রহণকারীরা একজন/ দুইজন করে সেখানে আসে, যাতে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক না হয়। চাচা আব্বাস ঘটনাস্থলে নবীজীর পাশে অবস্থান নেন। গিরিপথের মুখে অবস্থান নেন আলী। বৈঠকের রাস্তায় পাহারাদার হিসেবে অবস্থান নেন আবু বকর।

এই তিনজন ছাড়া মক্কার কোনো মুসলমানই এই বায়াতের বিষয় জানতেন না। বায়াত নেয়া ৭৩ জনের মধ্যে ৭০ জন বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অর্ধেকের বেশি সংখ্যক নবীজীর সাথে সকল যুদ্ধে অংশ নেন। এক তৃতীয়াংশ বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদ হন। 

এদিকে, বায়াতগ্রহণকারী একজন নবীজীকে প্রশ্ন করলেন, মদিনায় এসে বিজয়ী হওয়ার পর আপনি যদি আবার আপনার কওমের মধ্যে ফিরে যান তখন আমাদের কী হবে? নবীজী হেসে বললেন, ‘এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো! তোমাদের রক্ত এখন আমার রক্ত। তোমাদের সম্মান আমার সম্মান। যে তোমাদের প্রতি অন্যায় করল, সে আমার সাথে অন্যায় করল। তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ করব। তোমরা যাকে সমর্থন করবে, আমি তাকে সমর্থন করব। তোমরা আমার। আমি তোমাদের। আর তোমাদের সকল সৎকর্মের পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত।’ ৭৫ জন মদিনাবাসী নবীজীর হাতে হাত রেখে আকাবার প্রথম বায়াতের মতো এক বাক্যে প্রতিজ্ঞা করলেন—আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করব না, চুরি করব না, গীবত করব না, মিথ্যা অপবাদ দেবো না, পরকীয়া-ব্যভিচার করব না, সন্তানদের হত্যা করব না।

তারা প্রতিজ্ঞা করলেন নবীজীর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যের। তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন মদিনায় চলে আসার এবং অবাধে ধর্মপ্রচারের। তারা শপথ করলেন আমরা যেভাবে আমাদের নারীদের রক্ষা করি একইভাবে আপনাকে সুরক্ষা দেবো। বায়াতের পর তিনি তাদেরকে ১২ জন প্রতিনিধি মনোনীত করতে বললেন। তারা আউস গোত্র থেকে তিন জন এবং খাজরাজ গোত্র থেকে নয় জন প্রতিনিধি মনোনয়ন করলেন। খাজরাজ গোত্রের প্রতিনিধিরা হলেন—আসাদ ইবনে জুরারাহ, সাদ ইবনে রাবি, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, রাফি ইবনে মালিক, আল বারা ইবনে মারুর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, উবাদা ইবনে সামিত, সাদ ইবনে উবাদাহ এবং আল-মুনযির ইবনে আমর। আর আউস গোত্রের ছিলেন উসায়েদ ইবনে হুযায়র, সাদ ইবনে খায়সামাহ ও রিফায়া ইবনে আল-মুনযির। নবীজী বললেন, ‘এই ১২ জনই হবে তোমাদের মাঝে আমার প্রতিনিধি।’

রাতের আঁধারে নির্জন পাহাড়ে অতি সংগোপনে নবীজীকে নিজেদের মধ্যে আশ্রয় দান এবং তাঁর সুরক্ষার জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করার বায়াত অনুষ্ঠিত হলো। তবে পাথরেরও কান আছে। বিষয়টি গোপন থাকল না। কিন্তু কোরাইশরা যখন নিশ্চিত হলো, মদিনার মুসলমানদের সাথে নবীজীর চুক্তি হয়ে গেছে, ততক্ষণে মদিনার সবাই মক্কা ছেড়ে চলে গেছে। তারা পথে শুধু সাদ ইবনে উবাদাকে পাকড়াও করতে সক্ষম হলো। তাকে মক্কায় এনে বন্দি করা হলো।

আকাবার দ্বিতীয় বায়াত মক্কার মুসলমানদের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করল। মুসলমানরা ছোট ছোট দলে গোপনে মদিনার পথে হিজরত করতে লাগল। নবীজী, আলী ও আবু বকরের সাথে মক্কায় রয়ে গেল শুধু শারীরিক কারণে সফরে যেতে অক্ষম মুসলমানদের কয়েকজন। কোরাইশরা পুরো ঘটনায় প্রমাদ গুণল। কাবা চত্বরে দারুল নাদওয়ায় বৈঠকে বসল তাদের প্রবীণরা। গুরুতর কোনো সমস্যায় পড়লে এখানে বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

একাধিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আবু জেহেল এবার বলল, আমার কাছে অব্যর্থ প্রস্তাব আছে। যা সকল সমস্যার সমাধান করে দেবে। প্রত্যেক গোত্রের অভিজাত পরিবার থেকে একজন করে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা যুবককে বাছাই করে প্রত্যেকের হাতে দিতে হবে শাণিত তলোয়ার। প্রত্যেক যুবক খোলা তলোয়ার নিয়ে একসাথে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করবে মুহাম্মদকে। ব্যস সব শেষ! খুনের দায় প্রতিটি গোত্রের ওপর সমানভাবে বর্তাবে। তাই নিহতের গোত্র আমাদের প্রত্যেক গোত্রের সাথে লড়াই করতে পারবে না। তাদের রক্তপণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর আমরা পর্যাপ্ত রক্তপণই প্রদান করব। সবাই একবাক্যে প্রস্তাবকে স্বাগত জানাল। সত্য অস্বীকারকারীরা এতটাই উৎফুল্ল হয়ে উঠল যেন, তারা ইতোমধ্যেই তাদের শত্রুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো আজ রাত শেষে প্রথম প্রভাতেই হত্যা-চক্রান্ত কার্যকর করা হবে।

এদিকে, নবীজী হিজরতের পুরো প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আগে থেকেই। সবাইকে একে একে নিরাপদে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। আবু বকর দুটি দ্রুতগামী উট যোগাড় করে ভালোভাবে যত্ন নিচ্ছিলেন। ঘটনার দিন দুপুরবেলা নবীজী আবু বকরকে বললেন রাতে প্রস্তুত থাকতে। সন্ধ্যায় ফিরে গেলেন ঘরে। চাচাতো ভাই আলীকে বুঝিয়ে দিলেন মক্কার অধিবাসীদের গচ্ছিত সম্পদ, যাতে পরদিন সবাইকে ফেরত দিয়ে দিতে পারে। (কী অসাধারণ সততা! যারা তাঁকে হত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের গচ্ছিত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মৃত্যুর মুখে আলীকে রেখে যাওয়া!)

রাত হতেই আলী ঘুমিয়ে পড়লেন নবীজীর বিছানায় নবীজীর কম্বল মুড়ি দিয়ে। রাত গভীর হলো। পাহারারত আততায়ীরা নবীজীর ঘরের প্রবেশ পথে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। নবীজী বেরিয়ে পড়লেন। মধ্যরাতে আবু বকরকে নিয়ে গন্তব্যের উল্টোদিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে জাবলে সূর গুহায় পৌঁছেই মরু পথপ্রদর্শকের হাতে উট দুটো দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন দূরে। বললেন, তিন দিন পরে উট নিয়ে আসতে। ফলে উট নিরাপদ রইল। আর উটের উপস্থিতি তাঁদের আত্মগোপনের পথে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত, তা থেকেও তাঁরা বেঁচে গেলেন।

আততায়ীরা ঘুমিয়েই ছিল। তাদের ঘুম ভাঙলে একজন আবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে পরস্পরকে নিশ্চিত করল যে, মুহাম্মদ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। ভোর হতেই দরজা ভেঙে ঢুকে একযোগে আঘাত করার জন্যে কম্বল ধরে টান দিতেই ওরা দেখল বিছানায় শুয়ে আছে আলী! বিস্মিত আততায়ীদের সমস্বরে প্রশ্ন, তোমার সঙ্গী কোথায়? আলীর নিরুত্তাপ জবাব, আমি কী জানি? মুহূর্তে শোরগোল পড়ে গেল। তথ্য জানার জন্যে আলীকে কাবাঘরে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করা হলো।

আবু জেহেল মৃত বা জীবন্ত অবস্থায় মুহাম্মদকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১০০ উটনী পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করল। সত্য অস্বীকারকারীরা দলে দলে নেমে পড়ল নবীজীর খোঁজে, ১০০ উটনীর লোভে। কোরাইশদের সন্ধানী ঘাতক দল যে শুধু মদিনার সোজা পথেই খুঁজতে শুরু করল, তা নয়। একটা দল এসে গেল সূর পাহাড়ে। খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো গুহামুখে। ভেতরে নবীজী আর আবু বকর। ঘাতক দলের উগ্র কথাবার্তায় নবীজীর নিরাপত্তা চিন্তায় আবু বকর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এখন কী হবে? আমরা তো মাত্র দুজন। নবীজী শান্তভাবে আবু বকরকে বললেন, ‘লা তাহযান ইন্নাল্লাহা মা আনা’ ‘দুশ্চিন্তা করো না! আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন।’

কিছুক্ষণ শোরগোল করার পর ভেতরে কেউ নেই ভেবে ঘাতক দল চলে গেল। গুহায় তাঁরা আত্মগোপনে থাকলেন তিন দিন। নিরাপত্তা ও আল্লাহর সাহায্যের পূর্ণ নিশ্চয়তা সত্ত্বেও তাঁর বাস্তবভিত্তিক নিখুঁত পরিকল্পনা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। দ্রুতগামী বলবান উটের ব্যবস্থা। সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর। সূর পাহাড়ে আত্মগোপনের বিষয়টি শুধু যারা পুরো পরিকল্পনার সাথে জড়িত তারাই জানতেন। আবু বকরের রাখাল আমির ইবনে ফুহাইরা সারাদিন পাহাড়ে মেষ চরাত। সন্ধ্যার দিকে অন্ধকারে গুহায় এসে খাবার দিয়ে যেত। আবু বকরের ছেলে আবদুল্লাহ সারাদিন মক্কায় সকল জটলায় ঘুরে বেড়াত। দিনের সব খবর ও প্রাপ্ত তথ্য সন্ধ্যায় গুহায় এসে পৌঁছে দিত। আবদুল্লাহ ফেরত যাত্রা করার পরে রাখাল আমির মেষ পাল নিয়ে সে পথে ফেরত আসত। ফলে আবদুল্লাহর পায়ের দাগ মুছে যেত। এইভাবে প্রত্যেকদিনে মক্কায় কোরাইশদের তৎপরতার খবর নবীজীর কাছে পৌঁছে যেত।

নবীজী জানতেন, মক্কা ত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়বে সারা আরবে। আর পুরস্কারের লোভে অনুসন্ধানকারীরাও ছড়িয়ে পড়বে সকল পথে। তাই তাঁকে যেতে হবে মরুভূমির সবচেয়ে দুর্গম এলাকা দিয়ে, লোকালয় থেকে দূরে অপ্রচলিত পথ ধরে। এজন্যে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এমন মরু পথপ্রদর্শক—যে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ। গাইড আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত মুসলমান ছিলেন না। তিনি বনু আল দায়েল গোত্রের প্রথাগত আরব পদ্ধতিতে পানির পাত্রে আঙ্গুল ডুবিয়ে যাত্রার পুরো গোপনীয়তা রক্ষার শপথ করেছিলেন। সততার কারণে তার ওপর নবীজী নির্ভরও করেছেন।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় আবদুল্লাহ তিনটা উট নিয়ে এলো। একটি নিজের। অপর দুটি হিজরতকারীদের। আবু বকর তনয়া আসমা নিয়ে এলো যাত্রাপথের খাবার। নবীজী একটি উটে আরোহণ করলেন। আবু বকর ও তার কর্মচারী আমির দ্বিতীয় উটে। বেদুইন আবদুল্লাহ ইবনে আরকাতের পথ প্রদর্শনায় জাবলে সূর থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ১৫ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। আল্লাহর ওপর নির্ভরতা কীভাবে করতে হয় তা-ই তিনি তাঁর উম্মতকে শিখিয়েছেন হিজরতের পুরো ঘটনার মধ্য দিয়ে। গোপনীয়তা, তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ সংগ্রহ, তাঁকে খোঁজার তুঙ্গ মুহূর্ত প্রথম তিন দিন আত্মগোপনে অবস্থান, লোকালয় বিবর্জিত পথে চলার জন্যে দক্ষ নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক সংগ্রহ থেকে শুরু করে তাঁর পক্ষে সম্ভব সবকিছু করার পর তিনি নিজেকে আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দিয়েছেন। আমার অংশ আমি করেছি এবার আল্লাহ তোমারটুকু তুমি করো! এটাই হচ্ছে তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ!

তপ্ত মরুর দীর্ঘ দুর্গম লোকালয় বর্জিত যাত্রাপথে একবারই তিনি বিপদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। গোত্রপতি সুরাকা ইবনে মালিক সবচেয়ে নিখুঁত বল্লম নিয়ে শক্তিমান তেজী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বিশাল পুরস্কারের লোভে নবীজীকে খুঁজতে বের হয়েছেন। নবীজীকে বহনকারী উট দেখতে পেয়ে সুরাকা আনন্দে আত্মহারা। কাছাকাছি এসে বল্লম নিক্ষেপ করার আগেই তার ঘোড়ার সামনের দু-পা বালুতে দেবে গেল। সুরাকা আরবদের প্রচলিত প্রথায় শুভাশুভ নিরূপণ করে কাজ করায় বিশ্বাসী ছিল। সে তীর নিক্ষেপ করে দেখল যে, এই অভিযান তার জন্যে শুভ নয়। কিন্তু একশত দুগ্ধবতী উটনীর লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার। লক্ষণ অশুভ মনে করলেও ঘোড়া সামলে আবারও অগ্রসর হলো। নবীজীর উট বল্লমের নাগালে এসে গেছে। বল্লম নিক্ষেপ করার আগেই ঘোড়ার পা আবার বালুতে দেবে গেল। আবার নিজস্ব পদ্ধতিতে শুভাশুভ গণনা করে দেখল লক্ষণ অশুভ।

এবার সুরাকা ভালোভাবেই বুঝল তাঁকে হত্যা করা সম্ভব নয়। ভাবান্তর হলো তার। সে উচ্চস্বরে তাদের থামতে বলল এবং বলল সে তাঁদের কোনো ক্ষতি করবে না। শুধু একটু কথা বলতে চায়। নবীজী উট থামালেন। নামলেন উট থেকে। সুরাকা সামনে এগিয়ে এসে বলল, আমি নিশ্চিত আপনি একদিন বিজয়ী হবেন। সেদিন যাতে আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারি সেজন্যে আমাকে একটা ‘সুরক্ষাপত্র’ দিন। নবীজী আবু বকরকে ‘সুরক্ষাপত্র’ লিখে দিতে বললেন। তারপর হেসে সুরাকাকে জিজ্ঞেস করলেন, পারস্য সম্রাটের বাজুবন্ধ পরতে তোমার কেমন লাগবে? বিস্মিত সুরাকা নবীজীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ দিয়ে একটি শব্দই বেরুল, পারস্য সম্রাটের! ফিরে আসার পথে অন্যান্য অনুসন্ধানকারীকে বললেন, আমি ওদিক থেকেই আসছি। ওদিকে খোঁজার কিছু নেই। কিছুক্ষণ আগেও যাকে হত্যা করার জন্যে তিনি ছুটছিলেন, ফেরার পথে তিনিই হয়ে গেলেন তাঁর রক্ষক।

[মক্কা বিজয়ের পর সুরাকা তার ‘সুরক্ষাপত্র’সহ নবীজীর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর খলিফা ওমর পারস্য জয়ের পর গণিমতের মালের মাঝে সম্রাটের সোনার বাজুবন্ধও পান। তখন সুরাকাকে সেটি উপহার হিসেবে পাঠিয়ে ১৫ বছর পর নবীজীর প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা প্রদান করেন।]

মরুভূমির সবচেয়ে দুর্গম ও অচেনা পথে ৫৩ বছর বয়সে ৪৯০ কিলোমিটার অতিক্রম করে নবীজী কুবায় পৌঁছান ২৩ সেপ্টেম্বর। কুবা মদিনার উপকন্ঠে, ১০ কিলোমিটার দূরে। নবীজীর আগমনের আগে কুবায় মুসলমানদের জামাতে ইমামতি করছিলেন সালিম। তিনি ক্রীতদাস ছিলেন। আবু হুজাইফা তাকে মুক্ত করে দেন। মক্কা ও মদিনার অভিজাত মুসলমানদের জামাতে তার ইমামতির কারণ হচ্ছে- কোরআন সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন। নবীজী সবসময় জ্ঞান ও ধর্মপরায়ণতাকে জাতপাতের ঊর্ধ্বে কতটা স্থান দিয়েছেন এ ঘটনা তারই প্রমাণ।

কুবায় তিনি চার দিন অবস্থান করলেন। প্রথম মসজিদ নির্মাণ করলেন। প্রথম জনতার সামনে ভাষণ দিলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দাও, অভুক্তকে খাবার দাও, যখন মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে তখন ইবাদতে নিমগ্ন হও। তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’

এনএস/