করোনা থেকে বাঁচতে শ্বাসকষ্টের রোগীদের করণীয়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:২৬ পিএম, ৫ মে ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৫৯ পিএম, ৫ মে ২০২০ মঙ্গলবার
কোনও ব্যক্তি যদি মনে করে যে সে যথেষ্ট ভাল করে ও আরামদায়কভাবে শ্বাস নিতে পারছে না, তাহলে তার সেই অনুভূতি হওয়াকে শ্বাসকষ্ট বলে। শ্বাসকষ্টের বিভিন্ন অনুভূতির মধ্যে আছে- শ্বাস নেওয়ার জন্য কাজ করতে হচ্ছে এরকম অনুভূতি, বুক চেপে আসা এবং বাতাসের ক্ষুধা (অক্সিজেনের অভাব হয়েছে এমন অনুভূতি)।
অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম করলে স্বাভাবিক শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা যায়। কিন্তু যদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিংবা সামান্য পরিশ্রমেই যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তাহলে তাকে রোগের উপসর্গ হিসেবে গণ্য করা হয়। ৮৫% ক্ষেত্রেই শ্বাসকষ্টের পেছনে হাঁপানি রোগ (অ্যাজমা), ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া), হৃৎ-রক্তাভাব (কার্ডিয়াক ইস্কিমিয়া), অঙ্গগহ্বরীয় ফুসফুসীয় ব্যাধি জড়িত।
নিঃশ্বাস ছাড়া মানুষ স্থবির, মৃত। শ্বাসকষ্ট মানুষের নিঃশ্বাস কেড়ে নিয়ে তাকে মৃত্যুর কোলে ফেলে দেয়। তাই যাদের শ্বাসকষ্ট রয়েছে, তাদের উচিত বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করা। শ্বাসকষ্টের লক্ষণগুলো হলো—শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে না পারা, শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া, রেসপিরেটরি ডিসট্রেস নামেও পরিচিত। এই অসুবিধার সঙ্গে মানসিক অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিও সম্পর্কযুক্ত। এই অনুভূতির কোনো শারীরবৃত্তীয় কারণ না থাকলেও শ্বাসকষ্টের কারণে একজন ব্যক্তির এমন অনুভূতি হতে পারে।
কারণ-
♦ হাঁপানি বা অ্যালার্জি।
♦ ঠাণ্ডা লাগার ফলেও অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
♦ অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া।
♦ সাইনোসাইটিস, হার্ট ফেইলিওর, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ।
♦ ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)।
বর্তমানে মহামারিতে রূপ নেয়া করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে আড়াই লাখের বেশি মানুষের। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। মৃত্যু হয়েছে ১৮৩ জনের। চলমান বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে অদৃশ্য ভাইরাসটি। এমনই বাস্তবতার মধ্যে আজ বিশ্ব অ্যাজমা দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- 'অ্যাজমায় অনেক মৃত্যু'। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যেমন অন্যদের তুলনায় বহুগুণ বেশি, তেমনি মৃত্যুহারও অত্যধিক।
এ বিষয়ে বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আলী হোসেন বলেন, শ্বাসকষ্ট বা হাপানি রোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের করোনা ভাইরাসে সংক্রমণজনিত জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশেরই শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা ছিল। ভাইরাসটি শ্বাসক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্ট্রাকচার ও টিস্যুতে আক্রমণ করে। জটিলতার মধ্যে শুধু তীব্র নিউমোনিয়া নয়, অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমও (এআরডিএস) বেড়ে যেতে পারে। এআরডিএসের কারণে ফুসফুসের টিস্যু পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। যেসব ফুসফুসীয় রোগ করোনা জটিলতার উচ্চ ঝুঁকি বহন করে, তাহলো- অ্যাজমা ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। সিওপিডির মধ্যে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস ও এল্ফিম্ফসেমা উভয়ই রয়েছে। সিওপিডির প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান। তাই যারা বছরের পর বছর ধরে ধূমপান করে আসছেন, তাদের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট জটিলতার বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে।
অ্যাজমা, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি কতটুকু সে বিষয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে মোট ৪২ জনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমও (এআরডিএস) থাকায় তাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। বর্তমানে ১০ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে দু'জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। আট জনের অবস্থা স্থিতিশীল।
বয়স অনুযায়ী বিভাজন করলে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশ ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের ২৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১৯ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৭ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের ৩ শতাংশ এবং ১০ বছরের নিচে ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। তবে তাদের মধ্যে কত শতাংশ অ্যাজমা, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন, সে সম্পর্কে পর্যালোচনা এখনও চলছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্রঙ্কোলজি অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল পালমনোলজি (বিএবিআইপি) মহাসচিব ডা. সাইদুল ইসলাম বলেন, অ্যাজমা রোগীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই যাদের অ্যাজমা আছে, তাদের করোনা হোক বা না হোক, সেলফ কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও বাসাবাড়িতে চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অ্যাজমা রোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে তাদের বাসাবাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সংক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব হাসপাতালে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে, সেখানে ভর্তি করতে হবে। যাতে করে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে নিয়ে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছে। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার মোট ৭ শতাংশ, অর্থাৎ এক কোটি ১২ লাখ মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত। তবে দেশে অ্যাজমা রোগীর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ লাংস ফাউন্ডেশনের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত বলে জানানো হয়। এর মধ্যে সাত দশমিক দুই শতাংশই শিশু।
করোনায় আরও যাদের ঝুঁকি বেশি:
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে করোনা ভাইরাস ১০ গুণ বেশি প্রাণঘাতী। বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, অ্যাজমার মতো ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
করণীয়-
♦ ধূমপান পরিহার করুন। পরোক্ষ ধূমপানও শ্বাসকষ্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই ঘরে বা আশপাশে অন্যদের ধূমপান করা থেকে বিরত রাখুন।
♦ হাঁপানি থাকলে চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হোন।
♦ অ্যালার্জি থাকলে অ্যালার্জি সৃষ্টি করে এমন বস্তু (যেমন—ধুলাবালি, মাইট) ও খাবার (যেমন—গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, বাদাম ইত্যাদি) এড়িয়ে চলুন।
♦ সঠিক ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজনের কারণেও শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পেতে পারে।
♦ ঘর গোছানোর সময় বা বাইরে গেলে ডাস্ট মাস্ক পরে বের হোন।
♦ ঘরে বেশি পশমওয়ালা পশু পালন করবেন না।
♦ ঘরবাড়ি সব সময় পরিষ্কার ও ধুলামুক্ত রাখুন।
♦ অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
এনএস/