আমি বাবাকে পাই প্রতি মুহূর্তে : ফাল্গুনী নন্দী
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:১০ পিএম, ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার
শিল্পীর মৃত্যু নেই। শিল্পীরা শুধু চোখের আড়াল হয়। দেহ চলে যায়, আত্মা মানুষের মাঝে বিরাজ করে! সুবীর নন্দী চলে গেছেন এক বছর হলো। গত বছরের এই দিনে তিনি সিঙ্গাপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কখনো মনেই হয়নি যে, তিনি আমাদের মাঝে নেই! কারণ সুবীর নন্দী বেঁচে আছেন গানের মাঝেই, যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন এভাবেই।
এদিকে শিল্পীর একমাত্র কন্যা কণ্ঠশিল্পী ফাল্গুনী নন্দী বাবার প্রয়াণ দিবসে স্মৃতিচারণ করে মনের শূণ্যাতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন-
‘আজ বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তার অগণিত ভক্তের জন্য হয়তো আজ বিশেষ দিন। কিন্তু বাবাকে হারানোর হাহাকারে আমার, আমাদের বিগত ১ বছরে সব ক’টা দিনই কেটেছে তার শূন্যতায়। আজ স্মৃতিচারণ করতে বলা হলে পুরোটা তো সম্ভব না। বাবা-মেয়ের স্মৃতিস্মারক হয় মহাগ্রন্থ! তবুও যদি ব্যক্তি সুবীর নন্দীর কথা বলি, বাবা ছিলেন খুবই ঘরোয়া টাইপের। খুব বেশি বাইরে আড্ডা দেওয়ার স্বভাব তার কখনোই ছিল না। তবে ফোনে যোগাযোগ রাখতেন সবার সঙ্গে। সেই স্বভাবে বাবার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন কথা হতো লীনু বিল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, সুজয় শ্যামসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা সবাই আমার সম্পর্কে কাকু। এছাড়া বাবার খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলেন শ্রীমঙ্গলে থাকেন, তার নাম কাজল দত্ত। তার সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাতেন।
রিটায়ারমেন্টের পর বাবা সারাদিন গান শুনতেন। সেগুলোর বেশিরভাগ ধর্মীয় গান ও ক্লাসিক্যাল। বাবা বলতেন, গানটা শোনার ভেতরেই নাকি তার রেওয়াজের কাজ হয়। সুবীর নন্দীর ব্যক্তিজীবন যদি বলি, পুরো পৃথিবীটা তার পরিবার নিয়েই ছিল। তবে তরুণদের ভীষণ উত্সাহ দিতেন। টিভি লাইভ বা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে গান শুনে কারোটা ভালো লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে অ্যাপ্রোশিয়েট করতেন। এটা প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা।
বাবার সঙ্গে খুব স্মরণীয় ভ্রমণ হয়েছে আমার ২০০৬ সালে, সিঙ্গাপুরে। একটা অনুষ্ঠানে আমি বাবার সঙ্গে যাই। অনুষ্ঠানের দিন বাদে বাপ-মেয়ে খুব ঘুরেছি। এতটা উচ্ছ্বল বাবাকে আমি খুব কম পেয়েছি। বারবার মনে পড়ে সেই ট্যুরটির কথা। শপিং বা কেনাকাটার কথা যদি বলি, সেক্ষেত্রে বাবা কলকাতায় বেশি এই কাজটা করতেন। কেনাকাটার ভেতরে ছিল তার হাফ হাতা গেঞ্জি, যেটা বাবা সবসময় পরতেন, পানের মশলা থেকে শুরু করে টিনের প্লেট পিরিচ, সংসারের খুঁটিনাটি কিনতেন। আর কিনতেন তার নাতির জন্য। অর্থাত্ আমার ছেলে হূদ্ধির জন্য। সবচেয়ে হাসি-খুশি সুবীর নন্দীকে দেখেছি হূদ্ধির জন্মের সময়। নাতিকে দেখে সে কী উচ্ছ্বাস তার! সালটা ২০১৩। আর সর্বশেষ একুশে পদক পাওয়ার পর দারুণ খুশি হয়েছিলেন বাবা। তার নিজের দেশ যে তাকে জীবিত অবস্থায় সম্মান দিয়েছে, এটা জেনে আত্মহারা আনন্দে ছিলেন তিনি বেশ ক’টা দিন। বাবা তখন আমেরিকায়। এরপর তো ঢাকায় চলে এলেন। তার সবচেয়ে প্রিয় শহর ছিল তার ঢাকা। এর বাইরে কিছুই ভাবতে পারতেন না। আমরা মাঝে মাঝেই ইনিয়ে-বিনিয়ে দেশের বাইরে থিতু হওয়ার জন্য বললে রেগে যেতেন। দেশের বাইরে কোথাও গেলে ওই শো বাদে দু-চারদিন পর ঢাকায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন তিনি।
বাবার অগণিত গানের ভেতরেই আমার বড় হওয়া। আমরা কয়েক প্রজন্ম তার গান শুনে বেড়ে উঠেছি। সেদিক দিয়ে দু-চারটে গান আলাদা করা খুব কষ্ট আমার জন্য। তবু যদি জীবনে খুব বেশি শোনা ৩টি গানের কথা বলি সেগুলো ‘ওই রাত ডাকে’, ‘পাখিরে তুই’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। আজ বাবা নেই। কিন্তু যেন আমার কাছে আরও বেশি থাকেন তিনি। প্রতি মুহূর্ত থাকেন। আগে সারাদিনে মাঝে মাঝে হয়তো খোঁজ নিতাম বা কথা হতো। আর এখন আমি বাবাকে পাই প্রতি মুহূর্তে। প্রতিক্ষণে কথা হয় তার সঙ্গে। যেকোনো অনুসঙ্গে। বাবারা এমনই। স্মৃতির আঁকড় রেখে চলে যান কোথায়! কোন আকাশে! আর সেই বাবার নাম যদি সুবীর নন্দী হয়, তবে তাকে হারানোর হাহাকার অনেক, অনেকের। বাবার জন্য প্রার্থনা। ভালো থেকো তুমি।’
বাবার সঙ্গে সন্তানের একটি মধুর সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে শূণ্যতা কাজ করবে এটাও অতি প্রাকৃতিক। কিন্তু ‘আমার এ দুটি চোখ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘চাঁদের কলঙ্ক আছে, দিন যায় কথা থাকে’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘হাজার মনের কাছে’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান যিনি উপহার দিয়েছেন তার সঙ্গে শ্রোতার নিবিড় সম্পর্ক, নিত্যদিনের। যার কণ্ঠে এত সুর, এত গান আছে তাকে কি শ্রোতারা ভুলে থাকতে পারেন?
এসএ/