অহংকার বনাম ক্যান্সার
আউয়াল চৌধুরী
প্রকাশিত : ০৪:২৮ পিএম, ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৫:৩৯ পিএম, ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার
ক্যান্সার এমন একটি রোগ যা মানুষের জীবনকে কুরে কুরে শেষ করে দেয়। কারো দেহে এ রোগ দেখা দিলে তার বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে। তেমনি কোনো মানুষের অন্তরে অহংকার দেখা দিলে সেটি ক্যান্সারের মতো ধীরে ধীরে তার জীবনী শক্তি শেষ করে দেয়। শুধু উপরের সুন্দর দেহটি থাকে কিন্তু ভেতরের অন্তর শেষ হয়ে যায়।
অহংকারকে বলা হয়ে থাকে সকল পাপের জননী। এটি মানুষের অন্তরকে দূষিত করে ফেলে। সকল নেক আমলকে বিনষ্ট করে। ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক সাম্য নষ্ট করে। একে অপরের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে। ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ায়। কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের প্রভু হতে পারে না। অহংকারীরা নিজেদেরকে খুবই ক্ষমতাবান মনে করে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে আলাদা। ফলে তাদের মধ্যে মানসিক ক্যান্সার বিরাজমান থাকে।
মূলত অহংকার হলো সৃষ্টিকর্তার একমাত্র ভূষণ। তিনিই শুধু অহংকার করতে পারেন আর কেউ পারে না। সুতরাং কোনো মানুষ সৃষ্টির্তার এ চাদর নিয়ে টানাটানি করলে তাকে সুস্থ বলা যাবে না। আল্লাহ পাক চান না তার কোনো বান্দা অহংকারী হোক। কাউকে হেয় করুক। কথা দিয়ে তাকে ছোট করুক। কাজ দিয়ে তাকে তুচ্ছ করুক। ছোট থেকে ছোট এমন বিন্দু পরিমাণ রিয়া বা অহংকার থাকলে আল্লাহ তাকে শেষ বিচারের দিন কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করবেন। বয়সে ছোট বড়, ধনী গরিব যে যাই হোক তার বিন্দু মাত্র অহংকার করার সুযোগ নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) বলেছেন- ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।’ এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলঃ যদি কেউ সুন্দর জামা আর সুন্দর জুতা পরিধান করতে ভালবাসে? তখন নবী করীম (সা) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার মানে হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা।’
পবিত্র কুরআনে কারিমের দৃষ্টিতে অহংকার হলো আত্মা এবং খোদা থেকে দূরত্ব সৃষ্টির প্রধান উৎস। এটি একটি মহা পাপ ও ভূল। শয়তানের বন্ধু হয়ে যাওয়ার মাধ্যম এবং বিচিত্র অন্যায় কাজে নিজেকে জড়িয়ে দুষিত হয়ে ওঠার কারণ। সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অহংকার। এটি হলো এক মহাব্যাধী। যা মানুষ বা পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে।
মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সূরা লোকমানে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা যমীনে দম্ভভরে চলো না। তুমি দাম্ভিকতা দেখিয়ে না জমিনকে চিরে ফেলতে পারবে, না তোমার উচ্চতা কখনও পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে।’
তাই দুনিয়ায় কোনো মানুষকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমার দেখতে পাই অহংকারীরা সব সময় অন্যের কাছ থেকে সম্মান আশা করে। তারা কারো উপদেশ গ্রহণ করতে চায় না। সবার সঙ্গে জোর গলায় কথা বলে। কারো পরামর্শ শুনলে মাথা গরম হয়ে ওঠে। অন্যের কথাকে মূল্য দিতে চায় না। অন্যদের হীন বা নীচ চোখে দেখে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলে। সমাজে এ ধরনের অহংকারী ব্যক্তি আমরা সবাই কম-বেশি দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অহংকার হলো এক ধরনের মানসিক রোগ। যা ক্যান্সার সমতুল্য। এ রোগ শরীরে লুকিয়ে থাকলে এক সময় প্রকাশ পায়। মানুষ তখন চিকিৎসা নিতে পারে। কিন্তু অহংকার এমন একটি রোগ মানুষ মনেই করে না যে তার মধ্যে অহংকার আছে। রোগের অনুভূতিই যদি না থাকে তাহলে এর চিকিৎসা হবে কিভাবে। এ রোগটি ধীরে ধীরে একজন মানুষের অন্তরকে কালীমাময় করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
সুতরাং অহংকার নামক এই ঘাতক ব্যাধী থেকে বাঁচার কী কোনো উপায় নেই? আছে। এ ক্যন্সার থেকে বাঁচতে হলে হতে হবে বিনয়ী। এটিই একজন মানুষকে এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি শোকর আদায় করতে হবে। পরম মমতা নিয়ে সিজদাবনত হতে হবে। তার নেয়ামতকে মনে প্রাণে স্বীকার করে নিতে হবে। ছোট বড় সকল মানুষের সঙ্গে বিনয়ীভাবে আচরণ করতে হবে। অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ছোট্ট একটি কথার কারণে কেউ কষ্ট পেল কি না ভাবতে হবে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অহমিকাও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে হবে। তাহলেই আল্লাহ ওই বান্দার ওপর খুশি হবেন এবং তাকে জান্নাত দান করবেন।
সবশেষে আল্লাহর রাসূল সা. এর একটি হাদিস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তিনি কখনো অশ্বারোহী অবস্থায় কাউকে তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দিতেন না। তিনি বরং বলতেন ‘তুমি অমুক জায়গায় যাও! আমি আসছি, ওখানে আমরা একসঙ্গে মিলিত হবো’।
বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অশ্বারোহীকে পাশে নিয়ে হাঁটতে চাইতেন না। কারণ উপরে থাকার কারণে এতে মনে অহংকার তৈরি হতে পারে। আর যিনি হেঁটে যাচ্ছেন তার অন্তরে হীনমন্যতা বা ছোট ভাব তৈরি হতে পারে। অথচ তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ। তাঁর পায়ের ধূলি নেওয়ার জন্য মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। আর তিনি কি না এক পা উপরে থাকায় আরেকজন ভাই কষ্ট পেতে পারে বলে নিজে সতর্ক হলেন সবাইকে সতর্ক করলেন। বিশ্ববাসিকে তিনি শিখিয়ে গেলেন এমন কাজ করা যাবে না সেটি যত ক্ষুদ্রই হোক। এইসব থেকে অহংমুক্ত হওয়ার শিক্ষা আমাদের নিতে হবে। তাহলেই অহংকার নামক ক্যান্সার ব্যাধী থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো।
এসি