ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

লকডাউন শিথিলে যেভাবে বাড়বে আক্রান্ত 

ড. শাফিউন নাহিন শিমুল

প্রকাশিত : ০৪:৪৪ পিএম, ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৪৬ পিএম, ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও সাধারণ ছুটি (লকডাউন) পালন করছে। যদিও অনেকে মনে করেন থাকেন এই ধরণের লকডাউন পশ্চিমা আইডিয়া, এবং এই ধরণের ব্যবস্থাপত্র বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে খুব একটা কার্যকর নয়। 

তবে গুগল মবিলিটি ডাটা বলছে বাংলাদেশে লকডাউন ভালই পালন হচ্ছে যদিও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তা ঠিকমত পালন করছে না বলে প্রতীয়মান হয়। সরকার ঘোষণা করেছেন ঈদের কেনা-কাটার জন্য দোকানপাট ১০ মে থেকে সীমিত আকারে খোলা রাখা যাবে। তার উপর আজ থেকে শর্ত সাপেক্ষে মসজিদ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। 

সরকার হয়তো ব্যবাসায়ীদের চাপে পড়ে বা ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে অথবা আমাদের অর্থনীতির কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এটা আমরা জানি যে ইতিমধ্যে গার্মেন্টসগুলো সীমিত আকারে হলেও চালু করেছে। অনেকে রসিকতা করে বলছেন তার মানে কি দেশ থেকে করোনা চলে গেল। সেই রসিকতার মধ্যে রসের চেয়ে শঙ্কাই বেশি। এই ধরণের সিদ্ধান্ত কতটা সুচিন্তিত সেটা বলা মুশকিল। তবে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ডাটা দিয়ে সে বিষয়ে একটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে। চলুন দেখা যাক ডাটা ও গাণিতিক মডেল কী বলে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রজেকশন নিয়ে একটা হাহাকার দেখা গেছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোফাখের হোসেন এ বিষয়ে আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছেন। আমাদের করা সেই প্রজেকশনে ছিল যে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা মে মাসের ৪ তারিখে দশ হাজার অতিক্রম করবে। কাকতালীয় হলেও সেটা মিলে গেছে। 

যেহেতু সে প্রজেকশন গণমাধ্যমে প্রকাশ করানি, তাই এই বিষয়ে হয়তো অনেকের না জানারই কথা। পরে এক জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম সরকার বলছে মে মাস শেষে বাংলাদেশে ৪৮,০০ থেকে ৫০,০০০ আক্রান্ত হতে পারে, যা আমাদের ২০ তারিখে করা প্রজেকশনের সাথে মিলে যায়। 

আমার সহকর্মী সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ওই প্রজেকশনের একটা পরিমার্জিত ভার্সন দিয়েছিল। যদিও জানিনা সরকার সেটা আমলে নিয়েছিল কিনা।সেই একই রকম মডেল দিয়ে আমি ঢাকার জন্যও প্রজেকশন করেছি। সে আলোকে গার্মেন্টস ও দোকানপাট খুলে দেওয়াটা কতটা যোক্তিক তা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

এ জন্য আমি তিন ধরণের মডেলিং ব্যবহার করেছি। প্রথমত, এস-আই-আর মডেল দ্বিতীয়ত, টাইম সিরিজ (এক্সপোনেন্সিয়াল) মডেল এবং তৃতীয়ত, সিগমইডাল-টাইপ ডিস্ট্রিবিউশন মডেল। যদিও অন্যান্য মডেলিং দিয়ে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করেছি পাঠকের সুবিধার জন্য এখানে তিনটি মডেলই ব্যাখ্যা করা হলো।

এস-আই-আর মডেল

এটা একটা ইপিডেমিওলজিক্যাল মডেল যা পুরো জনসংখ্যাকে তিনভাগে ভাগ করেঃ সাসেপটিবল (এস)- অর্থাৎ যাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে , ইনফেক্টেড (আই)- ইতিমধ্যেই যারা সংক্রমিত হয়েছে এবং রিমোভড (আর)- অর্থাৎ যারা ইতিমধ্যেই সংক্রমিত হয়ে সুস্থ্য হয়েছেন বা মারা গেছেন (অর্থাৎ তাদের আর সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই)। 

মিলান বাতিস্তা নামে ইউনিভার্সিটি অব লুব্লিয়ানা, স্লোভেনিয়ার এক প্রফেসর এই মডেলটি করোনায় আক্রান্তদের ডাটা দিয়ে (ইম্পিরিকিলি) নির্ণয় করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন যা ব্যবহার করে সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম বিভিন্ন দেশের প্রজেকশন করেছে। সেটা কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানোও হয়েছিল। 

সেই একই মডেল ব্যবহার করে আমি ঢাকার প্রজেকশন করেছি। প্রজেকশন বলছে যদি বর্তমান ধারা বজায় থাকে তাহলে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ঢাকায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আট হাজারের মত হবে। এই মডেলে মোট কতজন আক্রান্ত হতে পারে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আর-নট (জড়) এর মান। এর মানে হলো একজন সংক্রমিত হওয়ার পর সে কতজন কে সংক্রমিত করছে (বা করতে পারে)। 

লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে তা এক এর নিচে নিয়ে আসাই উদ্দেশ্যে থাকে। আর একের বেশি থাকা মানে সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনাও বেশি। বর্তমান ডাটা বলে সেটার মান ২.৪৩ যার মানে হলো ঢাকার পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে এমনকি আমাদের বর্তমান লকডাউন থাকলেও। আর লকডাউন খুলে দিলে তা আরও বাড়বে যার ফলে মে মাসের মধ্যেই ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৫-২০ হাজার এমনকি তারও অনেক বেশি হওয়া অসম্ভব নয় ।

টাইম-সিরিজ মডেল

এবার দেখা যাক টাইম-সিরিজ মডেল কী বলে। এখানে আমি ডাটা দিয়ে দেখতে চেয়েছি ঢাকার বৃদ্ধির হার কেমন। এটা দেখার জন্য এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন ব্যবহার করা হয়েছে। এই ফাংশনের এক্সপোনেনশিয়াল অংশের সহগ দেখে বুঝা যায় বৃদ্ধির হার কেমন ছিল বা হবে। সহগ যদি একের বেশি হয় তার মানে হলো আক্রান্তের সংখ্যা এক্সপোনেনশিয়ালি (চক্রবৃদ্ধি হারে) বাড়ছে। 

সহজভাবে বলতে গেলে ১ থেকে ২, ২ থেকে ৪ বা তার বেশি, ৪ থেকে ৮ বা তার বেশি- কিছুটা এরকম। সংক্রমন রোগের ক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। আর সামাজিক দূরত্বের উদ্দেশ্যই হলো এটাকে একের নিচে নিয়ে আসা। ঢাকার ডাটা দিয়ে আমি পেয়েছি যে সেই সহগের মান ১.২০ এর কাছাকাছি , তার মানে ঢাকাতে এখনও এক্সপোনেনশিয়ালি (চক্রবৃদ্ধি) হারে সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকা-নারায়নগঞ্জ বাদ দিলে সেই সহগ সারাদেশের জন্য এক থেকে সামান্য বেশি। 

সেই হিসেবে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় ঢাকা এখনো অনেক বেশি ঝুঁকিপুর্ণ। এই ধারা বহাল থাকলে এই মডেল অনুযায়ী মে মাসের মাঝামাঝিতে শুধু ঢাকাতেই ১৩-১৫ হাজার আর মাস শেষে ৩৫-৪০ হাজার লোক আক্রান্ত হতে পারে। ফেসবুক এনালেটিক্স টিম মেশিন-লার্নিং ভিত্তিক একটা প্রজেকশন টুল বের করেছে। সেই মডেল ব্যবহার করেও একই রকম প্রজেকশন পেয়েছি। 

এক্সপোনেনশিয়াল মডেলের সীমাবদ্ধতা হলো এই মডেল স্বপ­মেয়াদে ভাল প্রজেকশন দিলেও দীর্ঘমেয়াদে খুব একটা ভাল প্রজেকশন নাও দিতে পারে। কারণ একটা পর্যায়ে বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসবেই, যদিও এই মডেল দিয়েও তা ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে, তবে সেক্ষেত্রে অন্যান্য মডেল বেশি উপযোগী। সিগমইডাল টাইপ মডেল এই ব্যাপারটা আমলে নিতে পারে।

সিগমইডাল- টাইপ মডেল

বাস্তবে এই রকম সংক্রামক বিধির ক্ষেত্রে প্রথমে একটু ধীর গতিতে বাড়ে, একটা সময় অনেক দ্রুত ছড়ায়, আর শেষ মূহুর্তে আবার ধীরগতির হয়ে যায়। সময়ের সাপেক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা গ্রাফে প্লট করলে কিছুটা বাকা এস (S) এর মতো দেখায়। 

এই ধরণের মডেল বা ফাংশনকে সিগমইডাল মডেল বা ফাংশন বলে। ইউনিভার্সিটি অব ওইয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভ্যালুয়েশন এই ধরনের মডেল ব্যবহার করে। বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের প্রজেকশনে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। 

দুই ধরণের সিগমইডাল মডেল ব্যবহার করে দেখেছি যে, বর্তমান গতিতে সংক্রমন চলতে থাকলে মে-মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় মোট ১০,০০০ লোক আক্রান্ত হতে পারে যা মাস শেষে গিয়ে ১৫,০০০ বা তারও বেশি হতে পারে। যদিও অন্য আরেকটা মডেল অনুযায়ী মে-মাস শেষে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় নয় থেকে দশ হাজারের মত। এখানে পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভাল এটা বর্তমান লকডাউন থাকবে তা ধরে হিসেব করা হয়েছে। বলা বাহুল্য লকডাউন উঠে গেলে সংক্রমণ, শঙ্কা, বিপদ- সবই বাড়বে।

সব মডেলের রেজাল্ট থেকে এটা পরিষ্কার যে ঢাকায় এখনো বিপদের শঙ্কা রয়েই গেছে এমনকি লকডাউন থাকলেও। কিছুদিন আগে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো আর ১০ই মে থেকে যদি দোকান-পাট ও শপিংমলও খুলে দেওয়া হয় তাহলে সে শঙ্কা আরও বহুগুণে বাড়বে। 

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। আর তাই এই দুই এলাকার ব্যাপারে সাবধানতা আরও বেশি প্রয়োজন। চিন্তার বিষয় হলো বেশির ভাগ গার্মেন্টস কারখানাও এই দুই জেলায় ও গাজীপুরেই অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান বলছে গতকাল তাদের আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২.৫ লাখে। অথচ প্রথম ৫০ দিনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজারের মত। আর বাংলাদেশে প্রথম পঞ্চাশ দিনে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে শঙ্কা এখনো রয়েই গেছে।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশে জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সরকার অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারপরেও আমাদের মত দেশ দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখার সামর্থ রাখেনা। প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনোমিস্টও বাংলাদেশ সম্পর্কে একই উপসংহার টেনেছে। তবে ভাবতে হবে আমরা কি এখনই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবো কিনা। 

ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থেই হোক বা চাপেই হোক অথবা অর্থনীতির কথা চিন্তা করেই হোক, গার্মেন্টস আর দোকানপাট যদি খুলতেই হয় তাহলে জোনিং সিস্টেম -এর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন যেসব এলাকায় বেশি আক্রান্ত সেইসব এলাকা এখনই না খোলা এবং সে এলাকার লোকদের অন্য এলাকায় ও শপিং মলে যাতায়াত সীমিত করা ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে মোবাইল লোকেশনের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। মানুষের বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী সবুজ, লাল ও হলুদ জোনে ভাগ করা এবং মোবাইলে এই মেসেজ পাঠানো এবং প্রবেশের ক্ষেত্রে তা দেখানো বাধ্য করা। 

ডিজিটাল বা ম্যানুয়াল কক্টাক্ট ট্রেসিং কার্যকর হতে পারে। কক্টাক্ট ট্রেসিং সিভিলিয়ান আর্মি গঠন করা যেতে পারে। আর দোকান-পাট খোলতে হলে সীমিত আকারে না খোলে পুরোপুরিভাইে (যদি সম্ভব হয় সকাল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত) খুলতে হবে। কারণ যদি সীমিত সময়ের জন্য দোকান-পাট খোলা হয়, তাহলে বাজারে একসাথে অনেক মানুষ ভিড় করবে যা করোনা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য ও আইটি বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে আরও ভাল পরামর্শ দিতে পারবেন। তাছাড়া গার্মেন্টসের জন্যও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা জরুরি। মনে রাখতে হবে ব্যবসা বা অর্থনীতির চাকা সচল করতে তাড়াহুড়ো করলে যদি ভয়াবহতা বাড়ে তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা বা অর্থনীতির ক্ষতিই বেশি হবে। 

আমি মনে করি, আতঙ্ক নিয়ে নতুন জামা পড়ে ঈদ করার চেয়ে পুরনো জামা পড়ে শঙ্কাহীন ঈদ অনেক বেশি আনন্দের।

সহযোগী অধ্যাপক
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল:shafiun.ihe@gmail.com

এমবি//