করোনায় `ঘৃণার সুনামি` বন্ধের আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৫ পিএম, ৯ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৪:৪৭ পিএম, ৯ মে ২০২০ শনিবার
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শুক্রবার আবার কড়া ভাষায় মনে করিয়ে দিয়েছেন করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বের নানা দেশে "বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার সুনামি'' বয়ে এনেছে।
কোন একটি দেশকে বিশেষভাবে চিহ্ণিত করেননি গুতেরেস। কিন্তু এই পরিস্থিতি রুখতে তিনি "সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা" গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। তারা এই মহামারিতে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত। তার ওপর তাদের "ভাইরাসের উৎস বলে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে এবং তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না"।
জাতিসংঘ প্রধান, সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা যেন "বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী ও অন্যান্য ধরনের ঘৃণা উদ্রেককারী ও ক্ষতিকর মন্তব্য সরিয়ে নেয়"। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানান বর্তমানে অনলাইনে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পটভূমিতে তারা যেন ডিজিটাল জগত সম্পর্কে শিক্ষার ওপর মনোযোগ দেয় এবং শিক্ষার্থীদের শেখায় কীভাবে ভুয়া তথ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার না করতে হয়।
তিনি বলেছেন "অনলাইনে এবং পথেঘাটে দৈনন্দিন জীবনে বিদেশিদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে। ইহুদী বিদ্বেষী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো হচ্ছে, এবং কোভিড নাইনটিনকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।"
গুতেরেস তার টু্ইটার অ্যাকাউন্টে বিশ্ব ব্যাপী 'ঘৃণা ও বিদ্বেষের সুনামি' মোকাবেলায় সবশক্তি প্রয়োগ করার এই আহ্বান জানান।
গুতেরেস কোন দেশের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেননি। তবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এধরনের বিদ্বেষ ও ঘৃণার নানা ঘটনা নিয়ে খবর হয়েছে।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মার্চ মাসে তাবলীগ জামাতের সদর দফতরে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ থেকে অসংখ্য মানুষের ভেতর করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেওয়ার পর গোটা বিষয়টি তীব্র সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।
মসজিদটিকে ভারতে মহামারি ছড়ানোর অন্যতম 'হটস্পট' বলে চিহ্নিত করে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ শুরু হয়ে যায়। এটাকে ''তালেবানি মাপের অপরাধ'', ''ক্ষমার অযোগ্য পাপ'' বলে মন্তব্য করেন রাজনীতিকরা।
দিল্লিতে 'মারকাজ নিজামুদ্দিন' নামে পরিচিত মসজিদে ধর্মীয় সমাবেশের পর মাস্ক পরা কিছু মুসল্লিকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়। সর্বভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও তাবলীগ তথা মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করে একের পর এক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। তার কোনওটির নাম দেয়া হয়, "ধর্মের নামে এ কোন প্রাণঘাতী অধর্ম?" অথবা, "করোনা-জিহাদ থেকে দেশকে বাঁচাও!"
ব্রিটেনে পড়তে আসা সিঙ্গাপুরের এক শিক্ষার্থীকে একদল তরুণ লন্ডনের রাস্তায় নির্দয়ভাবে প্রহার করে। তাকে বলা হয়, "তোমার দেশের করোনাভাইরাস আমাদের দেশে চাই না"।
সিঙ্গাপুর থেকে আসা ছাত্র ২৩ বছর বয়স্ক জনাথান মক ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে যখন লন্ডন শহরের কেন্দ্রে অক্সফোর্ড স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছিলেন - রাত তখন প্রায় সোয়া ন'টা- তখন চারজন তরুণ চিৎকার করে তাকে গালি দেয়।
তারপর তারা তাকে মারতে শুরু করে। একজন ক্রুদ্ধ তরুণ তাকে লাথি মারতে মারতে বলে, তোমার দেশের করোনাভাইরাস আমাদের দেশে চাই না, বিবিসিকে জানান মক।
দ্বিতীয় তরুণ তার মুখে এমন ঘুঁষি মারে যে তার নাক ফেটে প্রচণ্ড রক্ত পড়তে থাকে। ঘুঁষির আঘাতে তার ডান চোখের পাশের হাড় ভেঙে যায়। বর্ণবাদী আচরণের দায়ে ১৫ ও ১৬ বছরের দুই তরুণকে পরে গ্রেপ্তার করা হয়।
চীনের গুয়াংঝু শহরে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর আফ্রিকানরা অভিযোগ করে তারা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছে। তাদের বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বলে তারা বিবিসিকে জানায়।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ওই শহরে আফ্রিকা থেকে পড়তে যাওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষায় তিনি নেগেটিভ আসার পরেও তাকে ও তার বন্ধুকে পুলিশ রাস্তায় আটক করে। তাদের বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। জোর করে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। ৯৮% আফ্রিকানকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছিল।
শুধু নিজেদের বাসাতেই নয়, রেস্তোরাঁতেও আফ্রিকানদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। চীন অবশ্য এসব অভিযোগ নাকচ করে দেয়।
গুয়াংঝু চীনের আফ্রিকান অধ্যুষিত শহর। সেখানে একসময় দু লাখের ওপর আফ্রিকান বসবাস করতেন। যদিও সে সংখ্যা এখন কমে এসেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানও অভিযোগ করেন তার বিরুদ্ধে তাইওয়ানের নেতারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদ্বেষপূর্ণ ও বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন ।
এপ্রিলের গোড়ার দিকে সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসুস বলেন, কয়েক মাস ধরে তিনি বর্ণবাদী মন্তব্য ও মৃত্যুর হুমকির শিকার হয়েছেন। তাইওয়ান যদিও সেসময় বলে যে তারা কোনরকম বৈষম্যের বিরোধী।
ড. টেড্রোস বলেন, "আমায় কৃষ্ণাঙ্গ, নিগ্রো এসব নামে ডাকা হচ্ছে, আমি যে কৃষ্ণাঙ্গ, আমি যে নিগ্রো তার জন্য আমি তো গর্বিত।"
আমেরিকার প্রেসিডেন্টও, ড. টেড্রোস ও সংস্থার বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেন এবং সংস্থা ও তার প্রধান চীনের প্রতি পক্ষপাত-দুষ্ট এমন মন্তব্য করে সংস্থাকে দেয়া আমেরিকান অর্থ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বন্ধ করে দেবার হুমকি দেন।
কোভিড নাইনটিন প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এই ভাইরাসকে "চীনা ভাইরাস" নামে ডাকতে শুরু করলে চীন তাতে প্রবল আপত্তি জানায়। মার্চের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এক টুইট বার্তায় লেখেন কোভিড নাইনটিন যে ভাইরাস থেকে হচ্ছে সেটার নাম "চীনা ভাইরাস"।
এই ভাইরাসের সঙ্গে কোন একটি বিশেষ দেশের নাম জুড়ে না দেবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আহ্বান জানায়, কিন্তু তারপরেও আমেরিকায় প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এই ভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বারবার এই ভাইরাসের প্রসঙ্গ টানার সময় একে "উহান ভাইরাস" বলে উল্লেখ করেন। চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা এটাকে "বর্ণবাদী ভাষা ও ভিনদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক" বলে বর্ণনা করে এবং বলে
এটা রাজনীতিকদের "দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ"।
ওদিকে, কোভিড নাইনটিন মহামারি শুরুর পর থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য এবং এর থেকে সরাসরি লাভবান ইহুদীরা হচ্ছে এমন তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টার অভিযোগ আনে ইসরায়েলিরা।
দেশটির একদল গবেষক এক রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেন, এই ভাইরাস নিয়ে দেশটির নামে এমন ভাষায় অভিযোগ আনা হচ্ছে যা প্রাচীনকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন বলা হতো ইহুদী মানেই তারা রোগ ছড়ায়, পুকুর বা কুয়ায় বিষ দেয় বা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আর কিছু তারা জানে না।
এসি