‘সূরা ফীল’র মর্মবাণী ও ঐতিহাসিক পটভূমি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:০৪ পিএম, ১১ মে ২০২০ সোমবার
মাহে রমজানে আমরা বেশি বেশি কোরআন পাঠ করব। চেষ্টা করব অর্থ বুঝে তবেই পাঠ করার। সব সময় কোরআনের সঙ্গে থাকব। কারণ এ মাসেই আল্লাহ মহা পবিত্র আল কোরআন নাজিল করেছেন। এই কোরআন মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি বা পথপ্রদর্শক।
আজ আমরা পবিত্র কোরআন শরীফের ১০৬ নম্বর সূরা ‘সূরা ফীল’ পাঠ করব। সেই সঙ্গে জেনেনিব এর ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে।
১০৫. সূরা ফীল
পারা ৩০, আয়াত ৫, রুকু ১ (মাক্কী)
বাংলা উচ্চারণ
আলাম তারা কাইফা ফা’আলা রাব্বুকা বিআসহা-বিল ফীল। আলাম ইয়াজ’আল কাইদাহুম ফী তাদলীল ওয়া আরছালা ‘আলাইহিম তাইরান আবা-বীল। তারমীহিম বিহিজা-রাতিম মিন ছিজ্জীল। ফাজা’আলাহুম কা’আসফিম মা’কূল।
মর্মবাণী
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
(হে নবী!) তুমি কি জানো না, হস্তিবাহিনীকে তোমার প্রতিপালক কীভাবে পর্যুদস্ত করেছিলেন? ২. তিনি কি ওদের চক্রান্ত পুরোপুরি ব্যর্থ করে দেন নি?
৩-৫. তিনি হস্তিবাহিনীর মোকাবেলায় পাঠালেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আর ওরা নিক্ষেপ করল কঙ্কর। পরিণামে হস্তিবাহিনী মাটিতে মিশে গেল পশুর চিবানো ভুষির মতো।
ঐতিহাসিক পটভূমি
রাসুল (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সময় এক বিরাট ঘটনা ঘটে, যাকে কুরআন চির স্মরনীও করে রেখেছে। সেটি হচ্ছে হাতি ও হাতি ওয়ালার ঘটনা।
হাবশা (বর্তমান ইথিয়োইপিয়া) সম্রাটের কাছ থেকে যখন ইয়ামনের একজন সরদার ইয়ামনের গভর্নর হবার পরোয়ানা হাসিল করে তখন হাবশী সৈন্যরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। তারা আবরাহাকে তার জাগায় গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করে। আবরাহা ছিল হাবশার আদুলিস বন্দরের একজন গ্রীক ব্যবসায়ীর ক্রীতদাস। নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে সে ইয়ামন দখলকারী হাবশী সেনাদলে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। হাবশা সম্রাট তাকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায়। কিন্তু এই সেনাদল হয় তার সাথে যোগ দেয় অথবা সে এই সেনাদলকে পরাজিত করে। অবশেষে হাবশা সম্রাটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী তাকে ইয়ামনে নিজের গভর্নর হিসাবে স্বীকার করে নেয়।পরে সে ধীরে ধীরে ইয়ামনের স্বাধীন বাদশাহ হয়ে বসে। ৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সদ্দে মাআরিব এর সংস্কার কাজ শেষ করে সে একটি বিরট উৎসবের আয়োজন করে। এই উৎসবে বিভিন্ন দেশ থেকে লোক আসে। সদ্দে মাআ’রিবে আবরাহা স্থাপিত শিলালিপিতে এ সম্পর্কিত পূর্ণ আলোচনা সংরক্ষিত রয়েছে।
সে ইয়ামনের রাজধানী সান্আ'য় একটি বিশাল গির্জা নির্মাণ করে। আরব ঐতিহসিকগণ একে ‘আল কালীস’ বা ‘আল কুলীস’ অথবা ‘আল কুল্লাইস’ নামে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, এ কাজটি সম্পন্ন করার পর সে হাবশার বাদশাহ্কে লিখে জানায়, আমি আরবদের হজ্জকে মক্কার কা’বার পরিবর্তে সানআর গীর্জার দিকে ফিরিয়ে না দিয়ে ক্ষান্ত হবো না। সে মক্কা আক্রমণ এবং কুরাইশদেরকে ধ্বংস ও সমগ্র আরববাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দিতে সফলকাম হতে পারবে বলে মনে করছিল। আবরাহার কাছে যখন এ খবর পৌঁছুল যে কাবার ভক্ত-অনুরক্তরা তার গীর্জার অবমাননা করেছে তখন সে এ রকম কসম খায় যে, ‘কা'বাকে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমি স্থির হয়ে বসবো না’।
অতঃপর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে সে ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩টি হাতি (অন্য বর্ণনা মতে ৯টি হাতি) সহকারে মক্কার পথে রওয়ানা হয়। পথে প্রথমে যু-নফর মানক ইয়ামনের একজন সরদার আরবদের একটি সেনাদল সংগ্রহ করে তাকে বাধা দেয়। কিন্তু যুদ্ধে সে পরাজিত ও ধৃত হয়। তারপর খাশ'আম এলাকায় নুফাইল ইবনে খাশ'আমী তার গোত্রের লোকদের নিয়ে তার পথ রোধ করে। সে-ও পরাজিত ও গ্রেফতার হয়ে যায়। সে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আবরাহার সেনাদলের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে বনু সকীফ অনুভব করে যে এত বড় শক্তির মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং এই সংগে তারা এ আশঙ্কাও করতে থাকে যে হয়তো তাদের লাত দেবতার মন্দিরও তারা ভেঙে ফেলবে। ফলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবরাহার সাথে দেখা করে। তারা তাকে বলে, আপনি যে উপাসনালয়টি ভাঙতে এসেছেন আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখাবার জন্য আপনাকে পথ প্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি।
আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে বনু সাকীফ আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তিকে তার সাথে দিয়ে দেয়। মক্কা পৌঁছতেই যখন আর মাত্র তিন ক্রোশ পথ বাকি তখন আলমাগান্মাস বা আল মুগান্মিস নামক স্থানে পৌঁছে আবু রিগাল মারা যায়।এরপর সে মক্কাবাসীদের কাছে নিজের একজন দূতকে পাঠায়। তার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে এই মর্মে বাণী পাঠায়ঃ আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি এসেছি শুধুমাত্র এই ঘরটি (কাবা) ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। যদি তোমরা যুদ্ধ না করো তাহলে তোমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পত্তির কোনো ক্ষতি আমি করবোনা। তাছাড়া তার এক দূতকেও মক্কাবাসীদের কাছে পাঠায়। মক্কাবাসীরা যদি তার সাথে কথা বলতে চায় তাহলে তাদের সরদারকে তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়।
(রসূলুল্লাহ্-এর দাদা) আবদুল মুত্তালিব তখন ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বড় সরদার। দূত তার সাথে সাক্ষাৎ করে আবরাহার পয়গাম তার কাছে পৌঁছয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘আবরাহার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই।’ এটা আল্লাহ্র ঘর; তিনি চাইলে তার ঘর রক্ষা করবেন। দূত বলে, ‘আপনি আমার সাথে আবরাহার কাছে চলুন।’ তিনি সম্মত হন এবং দূতের সাথে আবরাহার কাছে যান।
তিনি এতই সুশ্রী, আকর্ষণীয় ও প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে আবরাহা তাকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে সিংহাসন থেকে নেমে তার সাথে এসে বসে। সে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি চান?’ তিনি বলেন, ‘আমার যে উটগুলি ধরে নেয়া হয়েছে সেগুলি আমাকে ফেরত দেয়া হোক।’ আবরাহা বলল, ‘আপনাকে দেখে তো আমি বড় প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নিজের উটের দাবী জানাচ্ছেন, অথচ এই যে ঘরটা আপনার ও আপনার পূর্ব পুরুষদের ধর্মের কেন্দ্র সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না, আপনার এ বক্তব্য আপনাকে আমার দৃষ্টিতে মর্যাদাহীন করে দিয়েছে।’
প্রত্যুত্তরে তিনি বলল, ‘আমি তো কেবল আমার উটের মালিক এবং সেগুলির জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আর এই ঘর। এর একজন রব-মালিক ও প্রভু আছেন। তিনি নিজেই এর হেফাজত করবেন।’ আবরাহা জবাব দেয়, ‘তিনি একে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।’
আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘এব্যাপারে আপনি জানেন ও তিনি জানেন ‘এ কথা বলে তিনি সেখান থেকে উঠে পড়েন। আবরাহা তাকে তার উটগুলো ফিরিয়ে দেয়।
আবরাহা সেনাদল কাছে থেকে ফিরে এসে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে বলেন, ‘নিজ-নিজ পরিবার-পরিজনদের নিয়ে পাহাড়ের ওপর চলে যাও, এভাবে তারা ব্যাপক গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে।’ অতপর তিনি ও কুরাইশদের কয়েকজন সরদার হারম শরীফে হাযির হয়ে যান। তারা কাবার দরজার কড়া ধরে আল্লাহ্র কাছে এই বলে দোয়া করতে থাকেন যে, তিনি যেন তার ঘর ও তার খাদেমদের হেফাজত করেন। সে সময় কাবা ঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। কিন্তু এই সংকটকালে তারা সবাই এই মূর্তিগুলির কথা ভুলে যায়। তারা একমাত্র আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করার জন্য হাত ওঠায়। ইতিহাসের বইগুলিতে তাদের প্রার্থনার বাণীগুলি উদ্ধৃত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হল নিম্নরূপঃ
“হে আমার রব! তাদের মোকাবিলায়
তুমি ছাড়া কারো প্রতি আমার আশা নেই,
হে আমার রব! তাদের হাতে থেকে
তোমার হারমের হেফাজত করো।
এই ঘরের শত্রু তোমার শত্রু,
তোমার জনপদ ধ্বংস করা থেকে
তাদেরকে বিরত রাখো।”
এ দোয়া করার পর আবদুল মুত্তালিব ও তার সাথীরাও পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরের দিন আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু তার বিশেষ হাতি মাহমুদ ছিল সবার আগে, সে হঠাৎ বসে পড়ে। কুড়ালের বাঁট দিয়ে তার গায়ে অনেকক্ষণ আঘাত করা হয়। বারবার অঙ্কুশাঘাত করতে করতে তাকে আহত করে ফেলা হয়। কিন্তু এত বেশি মারপিট ও নির্যাতনের পরেও সে একটুও নড়ে না। তাকে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব দিকে মুখ করে চালাবার চেষ্টা করলে সে ছুটতে থাকে কিন্তু মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই গ্যাঁট হয়ে বসে পড়ে। কোনো রকমে তাকে আর একটুও নড়ানো যায় না।
এ সময় আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষুদ্রাকৃতি পাখি ঠোঁটে ও পাঞ্জায় ‘পাথর কণা’ (কঙ্কর) নিয়ে উড়ে আসে। তারা সেনাদলের ওপর পাথর কণা (কঙ্কর) বর্ষণ করতে থাকে। যার ওপর পাথর কণা পড়তো তার দেহ সঙ্গে সঙ্গে গলে যেতে থাকতো। ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে, যার ওপরই পাথর কণা পড়তো তার সারা গায়ে ভীষণ চুলকানি শুরূ হতো এবং চুলকাতে চুলকাতে চামড়া ছিঁড়ে গোশত ঝরে পড়তে থাকতো। আবরাহা নিজেও এই অবস্থার সম্মুখীন হয়। তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তো এবং যেখান থেকে এক টুকরো গোশত খসে পড়তো সেখান থেকে রক্ত ও পুঁজ ঝরে পড়তে থাকতো। বিশৃংখলা ও হুড়োহুড়ি ছুটাছুটি মধ্যে তারা ইয়ামনের দিকে পালাতে শুরু করে। খাশ'আম এলাকা থেকে যে নুফাইল ইবনে হাবীব খাশ'আমীকে তারা পথ প্রদর্শক হিসাবে নিয়ে আসে তাকে খুঁজে পেয়ে সামনে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে ফিরে যাবার পথ দেখিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু সে সরাসরি অস্বীকার করে বসে। আবরাহা খাশ'আম এলাকায় পৌঁছে মারা যায়।
মূল বক্তব্য
ওপরের যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংযোজন করা হয়েছে সেগুলো সামনে রেখে চিন্তা করলে এ সুরায় কেন শুধুমাত্র আসহাবে ফীলের ওপর মহান আল্লাহর আযাবের কথা বর্ণনা করেই শেষ করে দেয়া হয়েছে তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। ঘটনা খুব বেশী পুরানো ছিল না। মক্কার সবাই এ ঘটনা জানতো। আরবরে লোকেরা সাধারণভাবে এ সম্পর্কে অবহিত ছিল। সমগ্র আরববাসী স্বীকার করতো আবরাহার এ আক্রমণ থেকে কোন দেবতা বা দেবী নয় বরং আল্লাহ কা’বার হেফাজত করেছেন। কুরাইশ সরদাররা আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দোয়া করেছিল। আবার এ ঘটনা কুরাইশদেরকে কয়েক বছর পর্যন্ত এত বেশী প্রভাবিত করে রেখেছিল যে, তারা সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করেনি। তাই সূরা ফীলে এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। বরং শুধুমাত্র এ ঘটনাটি স্বরণ করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এভাবে স্মরণ করিয়ে দেবার ফলে বিশেষ করে কুরাইশরা এবং সাধারণভাবে সমগ্র আরববাসী মনে মনে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা – ভাবনা করতে পারে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিষয়ের দিকে আহাবান জানাচ্ছেন সেটি অন্যান্য মাবুদদেরকে ত্যাগ করে একমাত্র লা শরীক আল্লাহর ইবাদাত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া তারা একথাটি ও ভেবে দেখার সুযোগ পাবে যে, এ হকের দাওয়াত যদি তারা বল প্রয়োগ করে দমন করতে চায় তাহলে যে আল্লাহ আসহাবে ফীলকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন তারা তাঁরই ক্রোধের শিকার হবে।
এসএ/