ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

আতঙ্ক নয়, করোনায় সুস্থতার জন্য যা করণীয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:১০ পিএম, ১১ মে ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৯:১৯ পিএম, ১১ মে ২০২০ সোমবার

চিকিৎসা অবেহেলায় মৃত স্বামীর পাশে ক্রন্দনরত ওসি।

চিকিৎসা অবেহেলায় মৃত স্বামীর পাশে ক্রন্দনরত ওসি।

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে জরুরী সেবার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়টা সর্বাধিক মূল্যবান। তবে এই মহামারীতে, হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে অনেকেই সেই জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে ঘটছে মারাত্মক পরিণতি। রোববার (১০ মে) এমনই একটা ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। 

আবরার হোসেন, একটি সংবাদপত্রের সাবএডিটর। তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হয় তার। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢামেক হাসপাতালের সদ্য উদ্বোধিত করোনা ভাইরাস ইউনিটে নিয়ে আসেন মাকে। 

তিনি জানান, দু'সপ্তাহ আগে আমার মা জ্বরজ্বর বোধ করেছিলেন। আমাদের সবারই ফ্লুর মতো লক্ষণ ছিল, তবে দ্রুতই সেরে উঠি। তাই আমরা এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করিনি। গত কয়েকদিনে মায়ের জ্বরও কমে এসেছিল। আজ সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠে যথারীতি দিনের রান্নাবান্নার জন্য ঘরোয়া দিকনির্দেশনা দেন ... এবং তারপরে হঠাৎ করেই তার শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে। চেয়ারে বসে পড়েও শ্বাস গ্রহণে বেশ কষ্ট অনুভব করেন এবং ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তার শ্বাস নেয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তাদের তাজমহল রোডের বাড়িতে একটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নেন। তবে গাড়িটি পৌঁছতে ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় নেয়। আবরার বলেন, "সকাল দশটা ৩৫ মিনিটে, আমরা ঢামেকের জরুরী বিভাগে প্রবেশ করি এবং আমি মাকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার বা নার্সের সন্ধান করছিলাম। কিন্তু একজন নার্স আমাকে লাইনে দাঁড়িয়ে টোকেন নিতে বললেন।

আবরারের বর্ণনায়, "আমি কাউন্টারে গেলাম এবং একটি টোকেন নিয়ে ফিরে এলাম। তখন নার্স আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে রিসেপশনিস্টের সাথে কথা বলতে বললেন। সেখানে চারটি বুথ ছিল এবং সবার লম্বা লাইন ছিল। তা দেখে আমি মায়ের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম, এই বলে যে, আমার মায়ের জরুরী অবস্থা, আমাকে লাইনের সামনের দিকে জায়গা দিন প্লিজ। তারা আমার অভিযোগ শুনে আমাকে চতুর্থ তলায় একটি আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলে।"

আবরার বলেন, "আমি মাকে চতুর্থ তলায় নিয়ে গেলে সেখানে একজন নার্স তার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা কাজ করে না, কারণ মা তখন নিজে থেকে সঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। তারপর, নার্স তার ফাইলটি পরীক্ষা করে বলেন যে, ইকোকার্ডিওগ্রাম লাগবে কিন্তু প্রেসক্রিপশন করা নেই, যা ছাড়া তারা কোনও ওষুধও দিতে পারে না। নার্স তখন আমাকে বলেন যে, আশেপাশেও এমন কোনও ডাক্তার নেই যারা এই জাতীয় প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন।"

আবরার আরও যোগ করেন, ওই ফ্লোরের দূরবর্তী পাশে একজন চিকিৎসক ছিলেন, কিন্তু তার মায়ের কাছে উপস্থিত থাকা নার্স বলেছিলেন যে, তারা কোনও প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন না।

ওই সময় আবরার একটি ইসিজি প্রেসক্রিপশন যোগাড় করেন, কিন্তু তাতে প্রায় দু'ঘন্টা কেটে গেছে। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে যখন কোন জরুরী অবস্থার রোগীকে আনা হয়, তখনই তার জন্য প্রথম এবং তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে একটি হলো- ইসিজির ব্যবস্থা করা। 

আবরার বলেন, "কিন্তু এতটা সময় গেলেও তারা তাকে যথাযথ চিকিৎসা বা সিপিআর দেয়ার কোন চেষ্টাই করেনি। তারা তাকে অক্সিজেন দিয়েছিল কিন্তু সেটা দিয়ে কোনও কাজই হয়নি। কেননা মা নিজেই অক্সিজেন নিতে পারছিলেন না। পরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি তার মায়ের ইনটিউবেশনে সম্মত হন।

অতঃপর ইসিজিতে নেয়া হলে রিপোর্টে বলা হয় যে, তিনি মারা গেছেন। "আমি মনে করি হাসপাতালের বেডে থাকাকালীনই তার মৃত্যু হয়েছে," বলেছিলেন আবরার।

এদিকে, এ বিষয়ে জানতে বহু চেষ্টা করেও ডিএমসিএইচ পরিচালককের ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে একজন প্রবীণ চিকিৎসক বলেছিলেন যে, আবরারের মায়ের মতো রোগীদের জন্য গতকাল কোনও আইসিইউ বেড খালি ছিলো না।

তিনি বলেন, "এ ধরণের রোগীরা একটি গুরুতর পর্যায়ে হাসপাতালে পৌঁছেন। তাছাড়া কোনও বেড খালি না হলে আমি অক্সিজেন ছাড়া অন্য কোনও কার্যকর চিকিৎসা দিতে পারি না।"

একইভাবে হাসপাতালে জরুরি সেবার অভাবে মারা যান হাবিবা মেমির মামা। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে থেকেই তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। গত ৮ মে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাবিবার মামাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। 

হাবিবা বলেন, "আমার মামি এবং তার ছেলে তখন তার সাথে ছিলেন। তাদের জানানো হয় যে, যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা পরীক্ষা করতে পারবেন না। তারপর তারা আরও দুটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয় মামার শ্বাসকষ্ট ও ফ্লু জাতীয় লক্ষণগুলোর কারণে। আমরা অবশেষে তাকে ঢামেকে নিয়ে যাই, কিন্তু সিএনজি থেকে স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মারা যান। কিন্তু আমরা তিনটি ঘণ্টা ধরে জরুরি সেবার জন্য ঘুরেছি। মাত্র তিনটি মূল্যবান ঘণ্টা, যা তার জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ গোলাম শাহ তুহিন ব্যাখ্যা করেন যে, মেশিনটি নষ্ট হয়ে যায়নি, তবে গত কয়েকদিন ধরে এটি পর্যায়ক্রমে নির্বীজনকরণের মধ্য দিয়ে চলেছে।

তিনি বলেন, "আমরা এখনও অন্যান্য পরীক্ষাগারে নমুনা প্রেরণ করে পরীক্ষা করছি। তবে আমরা প্রতিদিন ২০০টি টিকিট দিচ্ছি। যখন আমাদের সক্ষমতা ছিল তখন আমরা ৫০০ জনেরও বেশি রোগী পরীক্ষা করেছি। আমার পুরো হাসপাতালটি রোগীতে ভরে গেছে এবং এখন কোনও সিট খালি নেই।"

তেমনি গত ৯ এপ্রিল যশোরে চিকিৎসক ও নার্সের অবহেলায় এক পুলিশ কর্মকর্তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ওসি পদমর্যদার ওই নারীর পুলিশ কর্তার অভিযোগ- অক্সিজেনসহ ওষুধপত্র না দেয়ায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি এ ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি দাবি করেন। অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি রোগী ভর্তির পর চিকিৎসকগণ চিকিৎসাপত্র দিয়েছেন। তবে খুব বেশি সময় পাওয়া যায়নি যে কারণে তিনি মারা গেছেন।

আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ঘরে থাকুন। বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পড়ুন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আতঙ্ক নয়, সতর্কভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। বারবার সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ধোবেন। টিস্যু, রুমাল ব্যবহার করুন। অপরিচ্ছন্ন হাত দিয়ে মুখ, নাক ও চোখ ছোবেন না। বাসা, বাড়ি এবং টয়লেট পরিষ্কার রাখতে হবে। কফ ও থুতুর মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। তাই যেখানে সেখানে থুতু-কফ ফেলবেন না।

- নিয়মিত কুসুম গরম পানি, আদা- চা এবং গরম স্যুপ পান করুন। লবণ মিশ্রিত কুসুম গরম পানি দিয়ে দিনে ৩-৪ বার গড়গড়া করুন, নাকে-মুখে গরম পানির ভাপ নিন।

-যে কোন ধরণের খুশ খুশে কাশি দেখা দিলেই আদা, লবন একসঙ্গে পিষে সেটা পানিতে সিদ্ধ করে সঙ্গে কিছুটা চা পাতি দিয়ে গড়াগড়া করে পান করুন দিনে ৩-৪ বার। এর ফলে গলার ভেতরের কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে, কোষগুলো শক্তিশালী হবে এবং কোষগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। যাদের কাশি নেই, তারাও এটা নিয়মিত দিনে অন্তত তিনবার খাবেন। আবার গরম পানিতে তেজপাতা, কালোজিরা, রসুন, আদা, লবঙ্গ মিশিয়ে পান করলেও বেশ উপকার পাবেন। আবার নিমপাতা রসের সঙ্গে গরম পানি মিশিয়ে তা গড়গড়া করে খেতে পারেন।

এর পাশাপাশি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ভিটামিন এ ও সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান। সবুজ শাক সবজি নিয়মিত খাবেন। পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, টক জাতীয় খাবার বাড়ান। লেবু, কমলা, ইত্যাদি বেশি করে খান। এছাড়া,নিয়মিত লেবুর শরবত বা লেবু দিয়ে চা খেতে পারেন।

-প্রতিদিন রসুন খেতে পারেন। রসুনে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ঠাণ্ডা লাগা ও ইনফেকশেন দূর করতে খুবই উপকারী। প্রতিদিন কিছুটা হলুদ খান। আর হোক সেটা কাঁচা বা রান্নায় ব্যবহার করে। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ মধু নিয়মিত খান। সব রোগের ওষুধ বলা হয় কালিজিরাকে। সাধারণ সর্দি-কাশি, নাক বন্ধ, গলা ব্যথা, জ্বর, যেকোনো ধরনের শারীরিক দুর্বলতা কাটাতেও কালিজিরার জুড়ি নেই। তবে ঠাণ্ডা জাতীয় পানীয় বা ফ্রিজে রেখে খাওয়া না খাওয়াই ভালো। আবার প্যাকেট জাতীয় খাওয়ার বা জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন।

এনএস/