প্রয়োজন সহমর্মীতা, মমত্ব ও ভালােবাসা
ফাহমিদা আই ফারিয়া
প্রকাশিত : ০৭:৪৮ পিএম, ১৫ মে ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ১০:৩৩ পিএম, ১৫ মে ২০২০ শুক্রবার
গোটা বিশ্ববাসীর ন্যায় বাংলাদেশের মানুষও আজ অন্যরকম এক ভয়ে-আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আতঙ্কিতরা করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষটিকেই জীবাণু মনে করতে শুরু করছে। আসলে করোনা আক্রান্ত মানুষটি তো জীবাণু নয়। সে আক্রমণের শিকার। করোনা আক্রান্তকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বা কবর দেয়া যাবে না। এটা কি ভাবা যায়, একজন মানুষ মারা গেছেন কিন্তু ভয়ে তার পরিবারের কোন সদস্য আপনজন বা সন্তানেরা তার অন্তিম যাত্রায় উপস্থিত থাকবে না। এই যদি বাস্তব হয়, তাহলে কি বলা যাবে আমরা সভ্য সময়ে আছি। কারণ আমরা তো জানি প্রত্যেক মানুষের জীবনে মৃত্যু অপরিহার্য। জন্ম নিলে মৃত্যু হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আবার পবিত্র কোরআন এ বলা হয়েছে, আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন, তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। এখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস চলছে। রমজানের অন্যতম শিক্ষা হলো সংযম, আল্লাহর প্রার্থনা এবং অসহায়ের দান। আমরা যদি রমজানের পরিপূর্ণ মুনাফা পেতে চাই তাহলে করোনা আক্রান্ত মানুষদের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। করোনা আক্রান্ত আজকে আমরা দেখি পৃথিবীর যেসব দেশের মানুষ তাদের মমত্ব দিয়ে বেশি এগিয়ে এসেছেন সেখানে করোনা তাড়াতাড়ি প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
বাঙালি বীরের জাতি, এখনকার মানুষের আর্থিক অভাব অনটন থাকতে পারে কিন্তু ভালোবাসার, মমতার কোন কমিত নেই। ১৯৭১ সালে দেশের সবচেয়ে বড় সংকটের সময় আমরা পরস্পরের আন্তরিকতা, ভালোবাসা আমরা দেখছি। কিন্তু এখন আমার কী দেখছি? স্বামী বিদেশ থেকে আসার খবর শুনে স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিদেশফেরত একজন মানুষকে সহজভাবে নিতে পারছে না এলাকার মানুষ। ঘর বাড়ি ভেঙ্গে দিচ্ছে। অথচ বিদেশ থেকে যে এসেছে সে আমাদেরই ভাই ,আমাদেরই বোন, আমাদেরই সন্তান। বিদেশে দুর্যোগ মহামারি দেখে ফিরে এসেছে আপনজনদের কাছে ভালোবাসার টানে। তারা বিদেশে যাওয়াতে তাদের উপার্জিত অর্থ আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছে। অতএব এই দুর্যোগকালে তাকে সামাজিক মমত্ব নিয়েই গ্রহণ করা উচিত। আপনজনকে ছেড়ে অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে যাচ্ছে সন্তান। স্বজনেরা কাছে আসতে চাইছে না। অনেক হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে চাইছে না। টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়লে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছেন বাড়িওয়ালা, এমনকি ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদেরও বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
বাস্তবতা হল- এ সময় আতঙ্ক কাটাতে প্রয়োজন সমাজিক মমত্ব, সহমর্মিতা, সচেতনা আর ভালোবাসা। আমরা চলাফেরার ক্ষেত্রে, বাইরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখব। কিন্তু আমাদের অন্তরের যে টান সামাজিক মমত্বের মধ্য দিয়ে এবং দুর্গত যে-ই হোক না কেন, যিনি-ই অসুস্থ হোক, তার প্রতি মমত্বের প্রকাশ আমরা যত ঘটাব, যত দেখাতে পারব, তত তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা, সুস্থ হওয়ার সুযোগ বাড়বে। মানুষের ভরসা পেলে তার ভেতরের ইমিউন সিস্টেমটা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন বাড়তে থাকবে। মানুষের মমতা, চিকিৎসকের মমতা, আত্মীয়ের মমতা, আপনজনের মমতা যে-কোনো রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আমরা যদি দেখি, বিশ্বের যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানেই তারা খুব সুন্দরভাবে করোনা মোকাবিলা বা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারছেন। এতো দুঃখ এতো বেদনার পাশেও আশার বাণী হচ্ছে- পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছেন। পৃথিবীতে এখনো সবাই শোষক নয়। সবাই অত্যাচারী নিপীড়ক নয়, সবাই ভোগী নয়, সবাই স্বার্থপর নয়। ত্যাগী মানুষও রয়েছেন এবং যেখানেই এই ত্যাগ আছে, যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানে তারা খুব সুন্দরভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছেন এবং মোকাবিলা করে যাচ্ছেন।
এখন যে ক্রান্তিকাল আমরা পার করছি তাতে স্বার্থপর মানুষের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবিক মানুষের। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন মানবিক মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল বলেই আমরা জয়ী হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সাথে যদি তুলনা করি তাহলে করোনা ভাইরাস যদি শত্রু হয় এবং চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, সাংবাদিক, ওষুধ শিল্প ও অন্যান্য জরুরি সেবার সাথে জড়িত ব্যক্তি যারা নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা হলেন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের পরম বন্ধু। আর ত্রাণচোর, বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাওয়া বাড়িওয়ালা, দাফন করতে অস্বীকৃতি জানানো মাওলানা, খাটিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানানো প্রতিবেশি, জরুরি সেবায় নিয়োজিতদের কাজে বা চলাচলে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তি, চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রাথমিক সাহায্য দিতে এগিয়ে না আসা স্বজন এদের বিচার স্রষ্টাই করবেন।
এখানে একটি বিষয় একটু উল্লেখ করছি। অকারণে আতঙ্কগ্রস্থ হওয়া, বেশি বেশি ওষুধ খাওয়া বা চিকিৎসকদের কাছে যাওয়া, পিপিএ পড়া, অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করাটা জরুরি নয়। বরং এসময়ে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সোপিওয়াটার ব্যবহারে সামাজিকভাবে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা যায়। অযথা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পেছনে না দৌড়ে পানির সাথে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্টের মিশ্রণে তৈরি সোপিওয়াটার ব্যবহার নিজে করা এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এসময়ে আরও প্রয়ােজন সবুজ ও টাকটা সবজি খাওয়া। বিশেষ করে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়া।
করোনাপূর্ব সময়ে কোথাও আগুন লাগলে বা অন্য কোনো দুর্যোগে মানুষ যেমন স্বেচ্ছায় দৌড়ে যেত তেমনি এসময়েও নিজস্ব পাড়া-মহল্লায় মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানো যেতে পারে। অযথা মহল্লার রাস্তা আটকে না রেখে বরং সকলের ঘরে খাবার, ওষুধ পৌঁছে দেয়ার জন্য ও সকলের খোঁজ নেয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হওয়া যেতে পারে।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে আতঙ্ক বা ভয় হলো একটি চরম দুর্ভোগ। ভয় আমাদের পরম সত্যের রূপ দেখতে দেয় না। আমাদেরকে ওপরের সোনার তীরে পৌঁছতে দেয় না। আমরা যখন অচেতনভাবে ভয় পোষণ করি, তখন তা হেসে আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে। আমরা যখন সচেতন হয়ে ভয় পোষণ করি, তখন তা বিজয়ীর ভঙ্গিতে আমাদের আলিঙ্গন করে। কিন্তু আমরা যখন আমাদের অন্তর্নিহিত সাহসের কথা ভাবি, তখন স্রােষ্টা তার মহৎ কান্না কাঁদেন, কারণ তিনি ভাবেন তিনি তার নির্বাচিত সঠিক ব্যক্তিকে পেয়েছেন।
একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে যে, একজন বৃদ্ধ পথ চলছিলেন এমন সময়ে একটি দড়ির ওপর তার পা পড়ল। আলো ছিল না। দড়িটিকে তার সাপ বলে ভ্রম হল। ভয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন এবং যত দ্রুত সম্ভব ছুটতে লাগলেন। দৌড়তে দৌড়তে তার পতন হল ও একটি পা তার ভাঙ্গল। নিকটবর্তী কিছু লোক চিৎকার ও আর্তনাদ শুনে লাঠিসোটা নিয়ে এসে হাজির। বৃদ্ধটি চেঁচিয়েই চলেছেন ওখানে একটা সাপ আছে। অন্ধকার অন্যেরাও ভাবল ওটি সাপ এবং তারা দড়িটিকে আঘাত করতে লাগল এবং দুর্ঘটনা বশত একে অপরকে আঘাত করতে লাগল। চেঁচামেচি ও মার চলতে লাগল যতক্ষণ না আর এক দল একটি আলো নিয়ে হাজির হল ও স্পষ্ট দেখল ওটি দড়ির টুকরো এবং সাপ নয়। আলো যখন এল তখন সত্য সুস্পষ্ট হল। তেমনি আমাদের জীবনে ও যখন জৈব অনুভূতির মধ্যে আলো প্রবেশ করে তখন সমস্ত ভয় দূর হয়ে যায়। কিন্ত আমাদের জ্ঞানের আলোর অভাব আছে। সেই জন্য সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের জীবনে প্রতি মুহূর্তে ভয় বিশাল আকারে আমাদের সামনে প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি যথেষ্ট ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে আমাদের চৈতন্যের গভীরে প্রবেশ করতে পারি এবং অনুভব করি যে হৃদয় ভিত্তিক সাহস আমাদের আছে তাহলে সেই অন্তর্নিহিত সাহস এর উদয় হবে প্রতি মুহূর্তে।
পরিশেষে, সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি প্রার্থনা দিয়ে শেষ করছি। তিনি যেন আমাদের মুক্তি দেন। কারণ এই পরিস্থিতি থেকে একমাত্র তিনিই আমাদের মুক্তি দিতে পারেন। তিনিই আলোর পথ দেখাতে পারেন।
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের যদি ভুল বা ত্রুটি হয়, সেজন্য আমাদের পাকড়াও করো না। প্রভু হে! আমাদের পূর্বসূরিদের ওপর যে-রূপ গুরুভার অর্পল করেছিলে, আমাদের ওপর তেমন ভার চাপিয়ে দিও না। প্রভু হে! আমাদের ওপর সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব দিও না। আমাদের ক্ষমা করো। দয়া করো। তুমিই আমাদের প্রভু। সত্য অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো।
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমাকে বিশ্বাস করেছি। সুতারাং তুমি আমাদের পাপমোচন করাে, ক্ষমা করো এবং কঠিন শাস্তি থেকে আমাদের রক্ষা করো। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপমোচন করো। সকল বাড়াবাড়ির জন্যে আমাদের ক্ষমা করো। বিশ্বাসে দৃঢ় রাখো। সত্য অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে বিজয়ে আমাদের সাহায্য করো। আমাদের প্রতিপালক যদি আমাদের দয়া না করেন, ক্ষমা না করেন, তাহলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যােতিকে পূর্ণতা দান করো ও আমাদের ক্ষমা করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
এসএ/