ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

একে একে নিভিছে দেউটি: সেলিম জাহান

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৯:১৩ পিএম, ১৫ মে ২০২০ শুক্রবার

আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব তাঁর শিক্ষার্থী ছিলেন। আমার অনেক অগ্রজেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। তবু সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। যু্ক্তি ছিল তাঁর একটাই - তাঁর কন্যার শিক্ষককে তিনি ‘তুমি’ বলতে পারেন না। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর কন্যা রুচি আমার শিক্ষার্থী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। বেনু এ নিয়ে অনুযোগ করত, “আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলেন, আর ওকে ‘আপনি’ বলেন কেন?” স্মিতহাস্যে তিনি বলতেন, ‘তুমি হলে গিয়ে কবীর ভাইয়ের মেয়ে। তবে তুমি চাইলে তোমাকেও ‘আপনি’ বলতে পারি’। বেনু বিব্রত হত।

বহু বলা-কওয়ার পরে স্যারের কাছে আমি ‘তুমি’ বাচ্য হলাম মাত্র দু’বছর আগে ২০১৮ সালে। সে বছর বইমেলাতে প্রকাশিত আমার ‘বেলা-অবেলা’ বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। একুশে ফেব্রুয়ারীতে রমেশ চন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে সে অনুষ্ঠানে অপূর্ব বলেছিলেন তিনি। সত্যি কথা বলতে, যে প্রশংসা করছিলেন তিনি আমার, তাতে আমি লজ্জাই পাচ্ছিলাম। কিন্তু সমালোচনা করতেও তাঁর যেমন কুন্ঠা ছিল না, প্রশস্তি করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। ২০১৮ এর ২১ ফেব্রুয়ারীতেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তার ক’দিন আগে গুলশানে তাঁর বাসায় গেলে গল্প জমে উঠেছিলে বেবী ভাবী আর স্যারের সঙ্গে। ভাবীর তাড়া থাকায় উঠে গিয়েছিলেন আগেই, কিন্তু স্যারের সঙ্গে তাঁর আমার পারিবারিক গল্প হয়েছিলে অনেক।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নাম প্রথম শুনি ষাটের দশকে কিশোর বয়সে। তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমীতে কোন এক সভায়। তাঁর লেখা প্রখম পড়ি ১৯৭২ সালে। লেখাটির নাম - মুনীর চৌধুরী, থিয়েটার পত্রিকার ‘মুনীর চৌধুরী’ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগদানের পরে পরবর্তী দু’বছরে তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হয়েছে। প্রতিবারে স্যার আমাকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর পান্ডিত্যে, বাচনে, ব্যক্তিত্বে। তবে সে সময়ে চেনা-জানা হলেও তাঁর সঙ্গে তেমন কোন নৈকট্য গড়ে ওঠেনি।

আনিস স্যারের সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ-বয়োকণিষ্ঠ সহকর্মীর একটি হৃদ্যতা গড়ে উঠলো আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমি উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশ থেকে ফিরে এলে। তিনটে কারণে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এক, তাঁর ও আমার প্রায়শ:ই যাতায়াত ছিল প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাড়ীতে। সুতরাং নানান গল্প-আলোচনায় আমাদের মাঝে একটি সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে।

দুই, আমার লেখালেখির কারণে আমি যখন-তখন তাঁর শরণাপন্ন হতাম। মনে আছে, একদিন বেশ রাতে তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ? বলে দিয়েছেন এক লহমায়। আরেকদিন কলা ভবনের সামনের পথে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর পেয়েছিলাম। এক জীবন্ত-চলন্ত বিশ্বকোষ ছিলেন তিনি। আর ঈর্ষণীয় ছিল তাঁর স্মরণশক্তি যার প্রমান তাঁর ‘কাল নিরবধির’ প্রতি পাতায়।

একদিন তাঁর বাড়ীতে কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে গেল যে বছর আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি সে বছর যশোর বোর্ডের বাংলার প্রধান পরীক্ষক ছিলেন আনিস স্যার। আমি জানালাম যে সে বছর বের্ডে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর ৮৪ পেয়েছিলাম। স্যার এক মুহূর্ত ভেবে বললেন, “আপনি দ্বিতীয় পত্রে ‘আমি, বেবী, মঞ্জু আপা’ নামে এক গল্প লিখেছিলেন”। আমি যুগপৎভাবে হতবাক ও বিব্রত। হতবাক তাঁর স্মরণশক্তিতে, বিব্রত কারণ রচনা লেখার বদলে সত্যিই এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ফেঁদেছিলাম অর্বাচীণ আমি। তার চেয়েও বড় কথা, গল্পের নামটি আমি চুরি করেছিলাম আমিনুজ্জামানের ‘আমি, বেবী, মঞ্জু আপা’ নামের ছোট গল্প থেকে। আমিনুজ্জামান আনিস স্যার চাচাতো ভাই, এবং ‘বেবী’ ভাবীর ডাক নাম। আমিনুজ্জামানের ছোট গল্পের ভিত্তিতে প্রয়াত সুভাষ দত্ত ‘আয়না ও অবশিষ্টের’ ‘অবশিষ্ট’ পর্বটি করেছিলেন, ‘আয়না’ পর্বটি ছিল প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের ছোট গল্প ‘রোকেয়ার মুখ’ অবলম্বনে।

তিন, আশির দশকে এরশাদ বিরোধী সংগ্রামের কালে নানান সামাজিক আন্দোলনে আমরা ঘণিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। মনে আছে, ‘নাগরিক কমিটি’ গঠিত হলে প্রয়াত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, আনিস স্যার ও আমি খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করেছি। নানান সময়ে নানান বিপদাশঙ্কায় তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বেনুকেও ফোন করতেন। একবার ‘স্বৈরাচারের স্বরূপ’ আমার একটি লেখার কারনে আমার বিপদ হতে পারে ভেবে তিনি আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় চলে এসেছিলেন গাড়ী নিয়ে আমাকে তাঁর বাসায় রাতে থাকার জন্য। বেনু রাজী হয় নি।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু আমার এক গুরু ছিলেন সর্ব অর্থেই। জীবন ও জগতের বহু শিক্ষা তাঁর কাছে, বহুভাবে তিনি ঋদ্ধ করেছেন আমাকে, তাঁর স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। আমার শিক্ষকতার পঞ্চমুখ ছিলেন তিনি - হয়তো রুচির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে; সর্রশংস পাঠক ছিলেন আমার লেখার - আমার ‘রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি-চিন্তার’ কথা কতজনকে যে বলেছেন; শুনতেন প্রতি পক্ষে ‘যা না বললেই নয়’ শীর্ষক আমার নিয়মিত বেতার কথিকার। যোগ্য ছিলাম না এর কোন কিছুরই, কিন্তু স্নেহ তো অন্ধ।

আজ যখন ভাবি, কোন একটি জায়গায় ঠেকে গেলে তাঁর পরামর্শ আর পাব না, কোন একটি জিনিষ জানতে চাইলে তাঁকে আর পাওয়া যাবে না, আমাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে তিনি আর থাকবেন না, তখন বড় অসহায় বোধ করি। আমার জীবনের এক মহীরুহ কাল ঝরে পড়ল - ‘একে একে নিভিছে দেউটি’।

এসি