আবাসন ও চিকিৎসা সংকটে পুলিশ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০১:৪২ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০১:৫৩ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার
মহামারি আকার ধারণ করা এই করোনা ভাইরাসের মাহামারিতে মানুষ যখন গৃহবন্দী তখন বাংলাদেশের একমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ সদস্যরাই জনগণকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করছে, খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, মানবিক কাজ করছে। এই সময়ে পুলিশ যখন সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে তখন তারা ব্যারাক সংকটে, হাসপাতাল সংকটে, ভাল চিকিৎসার অভাব, করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সামগ্রীর অভাবের সম্মূখীন।
চুরি-ডাকাতি রোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনী দায়িত্বে বাংলাদেশ পুলিশ অংশগ্রহণ করে থাকে। মানবিক কাজও করে থাকে পুলিশ। দেশের এ করোনাকালে যারা প্রাণঘাতি ভাইরাসটি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে পুলিশও রয়েছেন। জীবন বিপন্ন করে তারা মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই পুলিশ শব্দটির সাথে মানুষের বহু রকম আবেগ-অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে। রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-আহাজারি, ঘৃণা যেমন আছে একদিকে; তেমনি মুদ্রার উল্টো পিঠে গর্ব, ভালবাসা ও সম্মানও আছে। যুগে যুগে পুলিশ বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা যেমন দিচ্ছে, ঠিক তেমনই শৃঙখলা রক্ষার কাজও করছে। তবে এর বিপরীতে তাদের অন্ধকার দিকও রয়েছে। পুলিশ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ১৬৪২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সেকেন্ড পার্ট অব দ্য ইন্সটিটিউট অব দ্য ল’স অব ইংল্যান্ড বইয়ে। তবে প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন নামে এই ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
অর্থগত দিক থেকে পুলিশ হচ্ছে এমন একটি বাহিনী যারা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অঙ্গ। এরা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয় এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকে। তাদের হাতে আইনসম্মত ভাবে গ্রেফতার করার ক্ষমতাও আছে। পুলিশের কার্যক্রম নানা দেশে নানাভাবে পরিচালিত হয়।
পুলিশকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা থাকলেও দেশে করোনাকালে পুলিশের মানবিক কর্মকাণ্ড পুলিশে অসীম মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এ মহামারীতে পুলিশই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত দেশে নতুন করে আরও ১৯৮ পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে সারাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২১৪১ জন।
সারাদেশের পুলিশ ইউনিটের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যই ১০৪১ জন। বুধবার এ সংখ্যা ছিল ৯০৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যই বেশি। এ বিষয়ে ডিএমপি জানায়, করোনায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও তাদের দুইজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ও একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন।
সারাদেশের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে, পুলিশে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে আইসোলেশনে রয়েছেন ১১৫২ জন ও আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে তিন হাজার ৯১ জনকে। এ পর্যন্ত ৩৩৩ পুলিশ সদস্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মারা গেছেন সাতজন।
করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমনটি বলেছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। তবে কতটুকু প্রস্তুত পুলিশের কেন্দ্রীয় হাসপাতাল। ব্যারাকের দুরবস্থা এবং হাসপাতালের অপর্যপ্ততা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুস্থ করে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানান অনেক পুলিশ সদস্য।
জানা যায়, গেল মাসের শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মাত্র ১০ শয্যার কোয়ারেন্টিন শয্য রয়েছে। আইসোলেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা সরঞ্জামেও সংকট আছে। হাসপাতালটি হচ্ছে রাজধানীর রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল (সিপিএইচ)। ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করা এই হাসপাতাল পুলিশ সদস্যরা এখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ পান। এখন এই হাসপাতালে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন জ্বর বা সর্দি-কাশি নিয়ে আসছেন। তাঁদের মধ্যে সাধারণ মানুষও আছেন।
বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি এখন ২৫০ শয্যার, চিকিৎসক আছেন ১২০ জন। সরকারের নির্দেশে সিপিএইচ ভবনের নবম তলায় পুলিশ সদস্যদের জন্য ১০ শয্যার কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর পুলিশেই প্রায় ৩৪ হাজার সদস্য আছেন। মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় করোনা প্রতিরোধেও তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে আসছেন, তাঁদের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখনো কেউ করোনা সন্দেহে ভর্তি হননি।
তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে একটি ব্যারাক খালি করে পুলিশ সদস্যদের জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে সিপিএইচের তত্ত্বাবধায়ক মো. মনোয়ার হাসানাত খান বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের আইসোলেশনে রাখার দরকার হলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ও উত্তরায় বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হবে। হাসপাতালে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী (পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট-পিপিই) বিশেষায়িত গাউন, মাস্ক, জুতা, বিশেষ ধরনের চশমার সংকট আছে। তবে কোয়ারেন্টিনে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকবেন, তাঁদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু নিরাপত্তাসামগ্রীর ব্যবস্থা করে রেখেছে।’
পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, যেমন পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নে (এসপিবিএন) একজন করে চিকিৎসক কর্তব্যরত আছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা সিপিএইচের হটলাইনে যোগাযোগ করে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
জানা যায়,পুলিশের যে সদস্যরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই ‘মাঠ পর্যায়ের’৷ অধিকাংশই ব্যারাকের মেসে থাকেন। পুলিশ বিভাগে এখন সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন তারা।
পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফিল্ড লেভেলে দায়িত্ব পালন আক্রান্ত হওয়ার একটি বড় কারণ৷ যারা ফিল্ড লেভেলে কাজ করেন তাদের বড় একটি অংশ পুলিশ মেসে থাকেন। সেখানে থাকার যে ব্যবস্থা তাতে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হয় না। তাদের খাবার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর পুলিশকে তো এখন চেকপোস্ট, লকডাউন, আসামি ধরা, করোনার লাশ দাফন, রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা- সব দায়িত্বই পালন করতে হয়। ফলে তাদের করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি অনেক বেশি।’
ডিএমপিতে কেন বেশি আক্রান্ত জানতে চাইলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্যসব বিষয় বাদ দিলেও বাংলাদেশ পুলিশের মোট ফোর্স দুই লাখ ১০ হাজার। এরমধ্যে ডিএমপিতে আছে ৩৪ হাজার। ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ঢাকায় করোনা আক্রান্তও সবচেয়ে বেশি। আর সেই বিবেচনায় সারাদেশের মধ্যে ঢাকায়ই করোনায় আক্রান্ত পুলিশ বেশি।’
ব্যারাককেন্দ্রিক জীবনে একসঙ্গে বসবাসের বাস্তবতাই পুলিশকে করোনা সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি পুলিশের দায়িত্ব পালনের যে ধরন সেটাও তাদের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে তুলছে। করোনা প্রতিরোধের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে ত্রিমাত্রিক চ্যালেঞ্জেও রয়েছে পুলিশ বাহিনী। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে পুলিশ যেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে তাকে মানবিক পুলিশের এক নতুন প্রতিচ্ছবি বলছেন অনেকেই।
পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কাজ করেছে। মানবিক বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। দেশের জন্য এই বাহিনী ঝুঁকি নিয়েছে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশ প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল। এই বাহিনী মাটি থেকে উঠে এসেছে। কাদামাটির অংশ হয়ে তারা জনগণের সঙ্গে মিশে আছে। আর তাই কমিউনিটির উপলব্ধি তারা সবার আগে বুঝতে পারে।
পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ডিএমপি। এখানে প্রায় ৩৪ হাজার ফোর্স। সব মিলিয়ে পুলিশের সদস্য সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার। এর মধ্যে ক্যাডার অফিসার প্রায় সাড়ে তিন হাজার। পুলিশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। আর পুলিশের সব ইউনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ডিএমপির ৯০৭ জন।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও ইমপালস হাসপাতাল, ট্রাফিক ব্যারাক চিকিৎসা কেন্দ্র ও রাজারবাগ স্কুল অ্যান্ড কলেজকে রিকভারি সেন্টার করা হয়েছে। উপসর্গ থাকা এমনকি করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে ছিলেন এমন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন পুলিশ লাইন্স থেকে সরিয়ে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, দিয়াবাড়িতে প্রস্তাবিত পুলিশ লাইন্সের অস্থায়ী ক্যাম্প, রায়েরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, ডিবি ব্যারাকসহ ৩৫-৪০টি পৃথক জায়গায় রাখা হয়েছে।
৫০ বছরে বেশি বয়সের সদস্যদের খুব প্রয়োজন না হলে থানার বাইরে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে না। তিন বা কোথাও চার ধাপে ভাগ করে ফোর্সদের ডিউটি করানো হচ্ছে। যাতে এক গ্রুপ সংক্রমিত হলেও অন্যরা মুক্ত থাকেন। অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখাশোনার জন্য গঠন করা হয়েছে 'বিশেষ টিম'। ঢাকায় একাধিক হাসপাতাল ছাড়াও বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুতে পুলিশ সপ্তাহ-২০২০ পালিত হয়েছিল। মুজিববর্ষে এবারের পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার।’ করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ যেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে তাতে এটা বলা যায়- পুলিশ সত্যিকার অর্থেই জনতার পুলিশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের দাবি দাওয়া কি পূরণ হয়েছে?
করোনা ভাইরাসের এই মাহামারিতে আইনশৃংখলা বাহিনী পুলিশ সদস্যরাই যদি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা না পায়, সুযোগ সুবিধা না পায়, তাদের দাবি দাওয়া পূরণ না হয় তাহলে জনসাধারণকে নিরাপত্তা দিবে কীভাবে? তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এমএস/এমবি