ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাংকারের অভিজ্ঞতা

মোহাম্মদ মাসুদ খান 

প্রকাশিত : ০৪:৪০ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৪:৪৩ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার

একেএম সাইফ উদ্দিন মাসুক গত ২৫-০৪-২০২০ উত্তরার বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তিনি গত মার্চের শেষ সপ্তাহে তার শরীরে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ বুঝতে পারেন। 

সাইফ উদ্দিন মাসুক (৪৭) একটি বেসরকারি ব্যাংকের মিরপুর দারুস সালাম ব্রাঞ্চের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত। গত ২৮-০৪-২০২০ আক্রান্ত সাইফ উদ্দিন মাসুক কোভিড-১৯ সংক্রমণের যে বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার সাথে শেয়ার করেছেন তা ইটিভি অনলাইন পাঠকদের মাঝে তুলে ধরা হলো। 

গত মার্চের ২৯ তারিখে তিনি জ্বর অনুভব করেন যা ১০০-১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইট ছিল। দুদিন পর শুরু হয় জ্বরের সাথে খুশ খুশে কাশি। পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে  তিনি Napa এবং Fexo সেবন শুরু করেন, সাথে লেবুযুক্ত গরম পানি। 0২-০৪-২০২০ থেকে তিনি এন্টিবায়োটিক সেবন শুরু করেন। রাজধানীর শংকরের বাসাতেই তিনি এই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সেই সময় তার স্ত্রী এবং ১৩ ও ১০ বছরের দুই ছেলে তাকে সার্বক্ষণিক সেবা দান করেন। ৩-৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় প্রচণ্ড কাশি এবং মাঝারি লুজ মোশান। 

০৫-০৪-২০২০ তিনি স্ত্রীর সাথে শাহবাগের BSMMU হাসপাতালের ফিভার ইউনিটে দেখা করেন। চিকিৎসক তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখতে পান এবং বলেন সম্ভবত আপনার শরীরে করোনার সংক্রমণ নেই। চিকিৎসক তাকে রক্ত পরীক্ষা এবং চেস্ট এক্স-রে করতে বলেন। চেস্ট এক্স-রে দেখে চিকিৎসক মাসুক ভাইকে করোনা টেস্ট করার পরামর্শ দেন। 

০৬-০৪-২০২০ জানতে পারেন তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে একটি এ্যাম্বুলেন্স করে তাকে উত্তরায় বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে তিনি হাসপাতালে পৌঁছেন। তিনি বলেন, মনে হলো এক অন্ধকার ভুতুড়ে পরিবেশে পদার্পণ করেছি। তার থাকার ব্যবস্থা হয় পঞ্চম তলায়। তাকে বেডশিট, বালিশ, মশারী, ১টি সাবান এবং ১টি টিস্যু বক্স দেয়া হয়। 

পরের দিন ০৭-০৪-২০২০ থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী Paracetamol,  Omeprazole, Cefixime 200 mg এবং হিস্টাসিন টাইপের আরেকটি ট্যাবলেট দেওয়া হয়। 

এদিকে এক পর্যায়ে মাসুক ভাইয়ের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ১০৩-১০৪ ডিগ্রী ওঠে। চিকিৎসাকালীন সময়ে তিন বেলা খাবার দেয়া হতো। সকালে কলা ও ডিম, দুপুরে ভাত, মুরগী, ডাল এবং রাতে ভাত, মাছ, ডাল। ভর্তির ১০ দিন পর দুপুর ও রাতের খাবারের সাথে ডিম ও ভাজি যোগ হয়। এছাড়া তিনি অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাবার যেমন লেবু গরম পানি, মাল্টা, খেজুর,  কালিজিরা নিজ খরচে গ্রহণ করেছেন। 

চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তিনি পঞ্চম তলায় ২ জনের মৃত্যু দেখেছেন, যাদের বয়স ছিলো ৫০-৬০ এর মধ্যে। তাদের একজনের ডায়াবেটিক ছিল।  তার সুগার শুন্য হয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আরেকজন আইসিইউতে মারা যান। 

হাসপাতালের অন্যান্য ফ্লোরের অবস্থা তিনি বলতে পারেননি। মাসুক যে রুমে ছিলেন সেখানে ৪ জন রোগী ছিলেন। প্রতি ফ্লোরে ৬/৭টি রুমে মোট রুগীর সংখ্যা  ৮/৩০ জন । নার্সরা রুমের ভেতরে ঢুকতেন না, বারান্দা থেকে রোগীদের ডেকে ঔষধ হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতেন, আর বয়স্কদের পক্ষে রুমের অন্য কোন রুগী তা গ্রহণ করতেন। বয়রা খাবার বারান্দায় রেখে দিতেন এবং সেখান থেকে রোগীরা যার যার খাবার নিয়ে আসতেন। প্রথম দিকে চিকিৎসকগণ রোগীদের দুর থেকে দেখতেন। কিছুদিন পরে অবশ্য তারা রুমে ঢুকে দুরত্ব রেখে রোগীদের দেখাশোনা শুরু করেন। জরুরি প্রয়োজনে নার্স স্টেশনে কল করতে হতো।  

সাতদিন পর ১৩-০৪-২০২০ পুনরায় মাসুক ভাইয়ের স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। ১৭-০৪-২০২০ তিনি জানতে পারেন তার রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। সেদিন পুনরায় তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে নেওয়া হয়। এবার তার ফলাফল পেতে অনেক বিলম্ব ঘটে। 

২২-২৩ এপ্রিলেও যখন ফলাফল পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের কাছে রেজাল্টের জন্য তাগাদা দেন। তারা বলেন, আপনি আইইডিসিআর-এর সাথে যোগাযোগ করেন। পরে তিনি আইইডিসিআর এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ই-মেইল সংগ্রহ করে সেথায় ই-মেইল করেন। 

২৫-০৪-২০২০ তিনি জানতে পারেন পুনরায় তার রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে, তার মানে মাসুক ভাই কোভিড-১৯ মুক্ত। যেখানে ১৮-০৪-২০২০ তিনি এই রেজাল্ট জানতে পারতেন সেখানে তা তিনি জানতে পারেন ৭ দিন পর। তিনি জানান এজন্য তারা পরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। 

সাইফ উদ্দিন মাসুকের বক্তব্য, কভিড-১৯ আক্রান্ত কারো শ্বাসকষ্ট না হলে হাসপাতালে না ভর্তি হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়াই উত্তম। ইতোমধ্যে তার দেহের ওজনও আট-নয় কেজি হ্রাস পায়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, প্রায় ৮/৯ দিন ধরে আক্রান্ত মাসুকের সংস্পর্শে থেকেও তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং অন্যান্যরা আক্রান্ত হননি। 

আসলে করোনা ভাইরাসে যে কেউই আক্রান্ত হতে পারেন। তা কারো সংস্পর্শে এসে বা না এসে। তবে আমাদের সবার অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিৎ।  

মহান আল্লাহ তা'লা আমাদের করোনা ভাইরাস সহ সকল ভাইরাস এবং মহামারী থেকে রক্ষা করুন এই প্রার্থনা করছি কায়মনোবাক্যে।

লেখক : সামাজিক সংগঠক
e-mail: masoodsupti@gmail.com