ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

মৌনতায় প্রশান্তি

ফাহমিদা আই ফারিয়া

প্রকাশিত : ০৬:০৩ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

রমজানের শেষ দশদিন নাজাতের সময়। এর জন্য অনেকেই বেছে নেন ইতিকাফ। এই ইতিকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ দুনিয়াবী ব্যস্ততা ও সম্পর্ক ছিন্ন করে একান্তভাবে আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদতে মনযোগ দেওয়া। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৌনতার সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করাই হলো ইতিকাফ। মৌন থেকে ইতিকাফের মাধ্যমে একদিকে সে ব্যক্তি সব প্রকার বেহুদা কথাবার্তা ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। তাঁর নৈকট্যলাভ করবে এবং তাঁর ইয়াদ ও ইবাদতের মনে শান্তি লাভ করবে। 

পবিত্র আল-কোরআনে আল্লাহ বলেন, জাকারিয়া প্রার্থনা করল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও।’ আল্লাহ বললেন, ‘তোমার নিদর্শন এই যে, তিনদিন তুমি পুরোপুরি মৌন থাকবে। আকারে-ইঙ্গিতে ছাড়া কারো সাথে কিছু বলবে না। তোমার প্রতিপালককে এসময় বেশি বেশি স্মরণ করবে। আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৪১)

সূরা মরিয়মের ২৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কোনো মানুষ দেখলে বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতার মানত করেছি। তাই কারো সাথেই কোনো কথা বলব না।’ কোরআন পাঠ করা সম্পর্কে সূরা আরাফের ২০৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ তাই যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন মৌন থাকো ও মনোযোগ দিয়ে শোনো। যাতে তোমরাও রহমত পেতে পারো।’

পারস্য-কবি ও মহান সাধক মওলানা জালালউদ্দীন রুমি অনন্য স্রষ্টাপ্রেম ও দীর্ঘ সাধনায় উপনীত হয়েছিলেন জীবনের গভীরতর কিছু উপলব্ধিতে। তার এমনই একটি উপলব্ধির মর্মার্থ ছিল- ‘নীরবতা হলো স্রষ্টার ভাষা, বাদবাকি সব তাঁর কথার অতি দুর্বল ভাষান্তর।’ নীরবতা অর্থাৎ মৌনতার মধ্য দিয়ে প্রিয়তম পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেছিলেন সাতশ’ বছর আগের এই সুফি কবি। 

এ কালের বিজ্ঞানীরাও বলছেন, নিয়মিত মৌনতার চর্চা করা উচিত আমাদের সবারই। তাতে মস্তিষ্ক যেমন হয়ে উঠবে শাণিত ও সৃজনশীল, তেমনি শরীর-মন থাকবে স্ট্রেস ও টক্সিনমুক্ত।

সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, আগে পরিবারের সবার জন্যে বাড়িতে ছিল একটি ল্যান্ডফোন, এখন সেখানে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা মোবাইল ফোন। ফলে কথাও বেড়েছে প্রচুর, দরকার থাকুক বা না থাকুক। নীরবতার সুযোগ কমেছে ক্রমশ। এ পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করছেন কোলাহল-মহামারী নামে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীজুড়ে ক্রমবর্ধমান কোলাহল ও শব্দদূষণকে আখ্যা দিয়েছে ভয়াবহ ‘আধুনিক প্লেগ’ হিসেবে। 

মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়া সুসম্পাদনের জন্যেই মৌনতা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্যে মৌনতার প্রয়োজনীয়তা আমরা যতটা ভাবতে পারি তার চেয়েও বেশি।


২০১৩ সালে খ্যাতনামা নিউরোসায়েন্স জার্নাল ব্রেন, স্ট্রাকচার এন্ড ফাংশান-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে মৌনতা বা নীরবতা পালন মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে নতুন কোষ জন্ম দিতে সক্ষম। উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশটি আমাদের স্মৃতিশক্তি, আবেগ এবং নতুন কিছু শেখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে।

মৌনতার সময় মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং মস্তিষ্ক তখন নীরবে করে চলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ফ্রন্টিয়ার্স ইন হিউম্যান নিউরোসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জোসেফ মোরান ও তার সহযোগিরা জানান, আমরা যখন নীরব থাকি তখন নানা সময়ে বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তগুলো যাচাই-বাছাই করে তা সমন্বয় ও আত্মস্থ করার কাজে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। ফলে এসব এলোমেলো তথ্যমালাই একসময় হয়ে ওঠে সচেতনভাবে ব্যবহারের উপযুক্ত।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনি যখন কোলাহল বা হরেক রকম কাজের হুড়োহুড়ি থেকে কিছুটা নীরব অবসরে থাকেন, আপনার মস্তিষ্ক তখন তথ্যমালা পুনর্বিন্যাস ও প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ পায়। কারণ এটি তখন খুঁজে পায় পূর্ণাঙ্গ কর্ম স্বাধীনতা।

ফলে মেলে নিত্যনতুন সৃজনশীল আইডিয়া। এটা কল্পনা করেই বুঝি আমেরিকান রেনেসাঁ যুগের লেখক-কবি হারম্যান মেলভিল বলেছিলেন, জীবনের গভীর ও আবেগীয় সব অনুষঙ্গগুলো পরিণত ও সুবিন্যস্ত হয়ে ওঠে মৌনতার মধ্য দিয়ে।

দৈনন্দিন কোলাহল ও শব্দদূষণ মস্তিষ্কের পাশাপাশি আমাদের শরীরকেও প্রভাবিত করে ভীষণভাবে। স্ট্রেস হরমোনের আধিক্য বাড়ে শরীরে। অন্যদিকে মৌনতা দেহ-মনের টেনশন দূর করে। অযাচিত চাপ কমায়।

গবেষকদের মতে, দু’মিনিটের মৌনতা মিউজিক শোনার চেয়েও বেশি প্রশান্ত করে মনকে। এ ছাড়াও দেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বাড়াতেও মৌনতা রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

মৌনতা চেতনা ও বুদ্ধিমত্তাকে শাণিত করে। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে স্পষ্ট হয় দক্ষতার ছাপ। মনোযোগ দিয়ে কিছু শেখা, মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও জটিল সমস্যা সমাধানের মতো ব্যাপারগুলোতে নিয়মিত মৌনতা চর্চার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, পারিপার্শ্বিক কোলাহলমুখরতায় মস্তিষ্ক যেসব ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তা ভালোভাবেই পুষিয়ে দেয় মৌনতা।

গবেষকরা এখন বলছেন, নিয়মিত মৌনতা চর্চা করুন। দিনের শুরুতে অন্তত ১০ মিনিটের হিরন্ময় মৌনতা আপনাকে সারাদিনের জন্যে করে তুলবে প্রশান্ত, লক্ষ্য-সচেতন, গতিময়, সৃজনশীল ও কর্মোদ্যমী। সজিব মস্তিষ্কপ্রসূত আপনার কর্মপরিকল্পনাগুলোও নিশ্চিতভাবেই হয়ে উঠবে তুলনামূলক গোছানো। গত শতাব্দীর মহান মানবসেবী মাদার তেরেসা তার সমৃদ্ধ জীবন-অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছিলেন, ‘মৌনতার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের আত্মাকেই স্পর্শ করি।’

-ফাহমিদা আই ফারিয়া

এএইচ/