ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

লকডাউন ছেড়ে দিয়ে ক্ষতি শুধু প্রলম্বিতই হচ্ছে

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ১০:১৪ পিএম, ১৬ মে ২০২০ শনিবার

আসুন সুন্দর একটা দিবাস্বপ্ন দেখি। ধরা যাক, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যেকে সচেতন নাগরিক। তারা করোনা নিয়মানুসারে সকলে ঘরে থাকছেন। সবার ঘরে যথেষ্ট খাবারদাবার আছে। সাত দিন পর পর নগর বা গ্রাম প্রশাসকেরা করোনা নিয়ম মেনে শাক-সব্জি, ফলমূল, মাছ, ডিম, চালডাল, তেল, নুন, সাবান, টুথপেস্ট, ইত্যাদি পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোথাও বের হচ্ছে না। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকছে। নাগরিকেরা ঘরে বসে কেউ নকশি কাঁথা বুনছে, জাল বুনছে, বেতের, বাঁশের কাজ করছে, গান বাঁধছে, গাইছে, পড়ছে, লিখছে। টেলিফোনে কথা বলে, ভিডিও চ্যাটিং করে আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছে।

কৃষকেরা মাঠে কাজ করছেন। ফসল উঠছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে সেসব পণ্য সরাসরি মাঠ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হচ্ছে। কেউ পণ্য নিয়ে বাজার বা হাটে যাচ্ছে না। যারা এসব কাজে জড়িত তারা প্রত্যেকে সুচারুরূপে করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। অফিস, আদালত, কারখানা, স্কুল - সব বন্ধ। বিমান বন্দর, নৌ-বন্দর, স্থল বন্দর - তাও বন্ধ। শুধু বাংলাদেশের নাগরিকেরা যদি বিদেশ থেকে ফেরত আসে তবে তাদের আইসোলেশন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪ দিন পরে সুস্থ থাকলে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে সরকারী যানবাহন; অসুস্থ হলে হাসপাতালে। 

বর্তমানে করোনা আক্রান্ত প্রায় ১৬,০০০ রোগীর (মোট আক্রান্ত থেকে মোট সুস্থ বিয়োগ করে) সকলেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোননা কোন করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে বা চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কেউ আক্রান্ত হলেই সরকারের লোকেরা টেলিফোনে সে খবর পেয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায়। কোন আক্রান্তকে নিজ ঘরে থাকার অনুমতি দেয় আহয় না। সাধারণ করোনা রোগীদের জন্য অনেক স্কুল, কলেজ, কমিউনিটি সেন্টারকে চিকিৎসা কেন্দ্র বানানো হয়েছে অল্পকিছু বিছানাপত্র দিয়ে। আয়োজন কম হলেও তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো রয়েছে। ক্রিটিক্যাল রোগীরাপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন সুবিধাসহ করোনা হাসপাতালে এবং সুপার ক্রিটিক্যাল রোগীরাভেন্টিলেশন সুবিধা সম্পন্ন ওয়ার্ডে রয়েছে। ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থকর্মীরা তাদের আন্তরিকভাবে সেবা করছেন। ৪/৫ থেকে ১২/১৪ দিনে তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে ঘরেই থাকছেন। 

অন্য রোগীরা যার যার হাসপাতালে বা অনলাইনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঔষধের দরকার থাকলে ডাক্তারেরা সরকারের ঔষধ কেন্দ্রে অনলাইন প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্র রোগীর ঠিকানায় তা সময়মত পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবে চলার ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে দেশে যত করোনা আক্রান্ত মানুষের আছে তারা সকলেই সুস্থ হয়ে গেছে। প্রথম যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা সুস্থ হতে হতে আরও কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল তারাও পরবর্তী ১৫ দিনে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। এখন আর তেমন কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না। ৫/৭ দিন পর ১/২ জন আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। খবর পেলেই তাকে এবং তার সংস্পর্শে যে যে এসেছিল তাদের সবাইকে সরকারী আইসোলেশন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে চলার মোটামোটি এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সকল করোনা আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে সকল করোনাভাইরাস মরে বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হয়ে গেছে। 

স্বপ্ন শেষ। এবার বাস্তবে আসুন। এরকম একটা অবস্থা কি তৈরি করা যেত না? জানুয়ারিতে বা ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তুতি নিলে উপরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যেত না? এখনো কি তা আবার তৈরি করা সম্ভব নয়? বলুনতো ভেন্টিলেটর ছাড়া আমাদের আর কোন জিনিসটার অভাব রয়েছে? প্রথম দিকে কিট, পিপিই সমস্যা ছিল – তাও মিটে গেছে অনেক দিন আগে। উপরে বর্ণিত স্বপ্ন শতভাগ বাস্তবায়ন করা গেলে মাত্র এক থেকে দেড় মাস সময়ের মধ্যে করোনা নির্মূল করা সম্ভব। স্বপ্নের একশতভাগ বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। তবে ৯০ ভাগ বা ৮০ ভাগতো পারা যায় বা তারও কম। যেখানে বা যে দেশে করোনা নিয়ম যত কড়াকড়িভাবে পালন হয়েছে সেখান থেকে করোনা তত দ্রুত বিদায় নিয়েছে। 

উপরে যা হলা হয়েছে তা আসলে স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার ছবি এঁকেছি। তবে তা আমাদের দেশের না। চীন, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান, কেরালা, দঃ কোরিয়া, সার্বিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের বাস্তবতা এটাই। আমরা যদি তাদের মত সিরিয়াসলি করোনা হ্যাণ্ডেল করতে পারতাম তবে আমাদের এই দুই মাসের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থার মধ্যে থাকতে হত না। অনেক আগেই আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারতাম। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইউকে, আমেরিকা সময় থাকতে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। যখন তাদের পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে তখন তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে লকডাউন কড়াকড়ি করেছে। কড়াকড়ি করার পর তাদের অবস্থা ভাল হতে শুরু করে, আস্তে আস্তে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। কড়া লকডাউন ছাড়া কেউই করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি; বাংলাদেশও পারবে না। 

করোনা নিয়ন্ত্রণে কড়া লকডাউনের বিকল্প এখন পর্যন্ত নেই। সেপ্টেম্বর মাসে করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবকেরা। বিভিন্ন দেশে আরও অন্তত ১০০টি প্রতিষ্ঠান যার যার মত ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে। পর্যায়ক্রমে তাও বাজারে আসবে। যতদিন ভ্যাকসিন সবার কাছে পৌঁছান না যাচ্ছে ততদিন লকডাউন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। ততদিন যে যার মত চললে, কড়া লকডাউন না হলে দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে শুধু বাড়তেই থাকবে। এখনো যদি আমরা আবার লকডাউন কঠিন করতে পারি,বাংলাদেশকে উপরে বলা স্বপ্নের মত করে তুলতে পারি, সীমান্তগুলো বন্ধ রাখতে পারি তবেজীবন, স্বাস্থ্য,সময় আর অর্থনীতির ক্ষয় কমিয়ে ফেলতে পারব। ভ্যাকসিন আসার আগেই বাংলাদেশ থকে করোনা নির্মূল করতে পারব। 

অর্থনীতির দোহাই দিয়ে লকডাউন ছেড়ে দিয়ে কোন লাভ হয়নি। অর্থনীতি ঠিকভাবে চলছে না। জীবন, স্বাস্থ্য, সময় আর অর্থনীতির ক্ষয়ের কাল শুধু প্রলম্বিতই হচ্ছে। অনেকে মানুষের জীবন আর স্বাস্থ্যের বিপরীতে অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন তুলেছেঃ কত দিন এভাবে অর্থনীতি বন্ধ রেখে টিকে থাকা যাবে? এটা ঠিক যে অনন্তকাল তা সম্ভব নয়। তবে কিছুকাল সম্ভব। দুই থেকে তিন মাস অবশ্যই সম্ভব। উন্নত দেশগুলোর জন্যতো বটেই বাংলাদেশের জন্যেও সম্ভব। আমাদের রয়েছে যথেষ্ট খাদ্যের মজুদ, হয়েছে বোরো ধানের বাম্পার ফলন। আগামী ছয় মাসের খাদ্য এখন আমাদের গুদামে। লকডাউন চলাকালে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, হচ্ছে ছোটবড় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর কাজ হারিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষ। এই ক্ষতি সহনীয় করার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রণোদনাও দিয়েছে। যদিও পর্যাপ্ত নয়, নগদ সহায়তা দিয়েছে কাজ হারানো মানুষদের, খাদ্য সহায়তা দিয়েছে দরিদ্র মানুষদের। কাজ হারানো পরিবারের সংখ্যা ৫০ লক্ষের অনেক বেশি। তাদের আরও বেশি করে মাসে মাসে নগদ সহায়তা দিতে হবে তাদের বাঁচানো এবং সেই সঙ্গে ব্যাসিক অর্থনীতি চালু রাখার স্বার্থে। ব্যাসিক অর্থনীতি চালু রাখতে না পারলে ক্ষতি হবে অনেক অনেক বেশি। অর্থনীতি পুনরায় পুরোদমে চালু করতেও সময় লাগবে অনেক বেশি। এমনকি দুই/চার বছরেরও বেশি। এরপর ক্ষতি থাকবে শুধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা। তাদের দুই থেকে তিন মাসের মুনাফার ক্ষতি তাদের মেনে নিতে হতো। 

এই মেনে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই-তিন মাসের মুনাফা হারাতে চায়নি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা বিভিন্নভাবে অন্তঃসারশূণ্য বিতর্ক সৃষ্টি করে কিছু তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আর তাদের মালিকানাধীন মিডিয়ার সহায়তায় সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে। অর্থনীতি আগে না জীবন আগে – এই বিভ্রান্তিতে ভুগছে অনেক মানুষ। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেও তাদের লাভ হয়নি। সরকারকে নতজানু করে লকডাউন শিথিল করাতে পারলেও ব্যবসা তাদের পুরো দমে হচ্ছে না। দুই মাসের বেশি সময়ে ইতোমধ্যে চলে গিয়েছে। করোনা এখন উর্দ্ধগতিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আগামে মাস দুয়েকের মধ্যে করোনা ধরাশায়ী হবে এমন কোন লক্ষণ নেই। লকডাউন কড়া না করলে করোনার জয়যাত্রা এখানে চলবেআরও অনেক দিন। 

এখন বেশিরভাগ মানুষ সচেতন। নিতান্ত বাধ্য না হলে তারা ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। বাইরে গেলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘরে ফিরে আসছে। এসময়ে তাদের কোন রকম বিনিয়োগের বা শৌখিন পণ্যের চাহিদা নেই। যে যত সচ্ছলই থাকুক না কেন সবাই এখন চুপ করে ঘরে বসে আছে। এরকম পরিস্থিতিতে কেউ বাড়তি খরচ করে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসা ছাড়া আর সব ব্যবসাই এখন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রফতানি ব্যবসাও ব্যতিক্রম নয়। যা বিক্রি হচ্ছে তা দিয়ে ব্যবসায়ের খরচই উঠছে না। মুনাফা নয়, তাদের এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই অবস্থা আগেভাগে বুঝে ক্ষতি কমাতে সৌখিন পণ্যের দোকান আর শপিংমল মালিকেরা ঈদ সামনে পেয়েও তাদের দোকান খুলেননি। লকডাউন কড়া থাকলে এতদিনে মোট আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম থাকত। দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যাওএখন অনেক কমহত; শূণ্যের কাছাকাছি চলে আসত। জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করত। ব্যবসায়ীরা সুদিনের মুখ দেখতে শুরু করতেন।লকডাউন শিথিল করায় তা হয়নি। 

জীবন আর অর্থনীতি কখনোই সাঙ্ঘর্ষিক নয়, সবসময় একে ওপরের পরিপূরক। জীবন বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে। জীবন বিসর্জন দিয়ে অর্থনীতি কে সুস্থ রাখবে?স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে হলে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফার মুখ দেখতে হলে, লকডাউন আবার এখানে কড়াকড়ি করতেই হবে। নতুবা মুনাফা দূরে থাক, লক্ষ লক্ষ করোনা আক্রান্ত ভগ্নস্বাস্থ্যের ক্ষীণকায় মানুষ, সামাজিক বিশৃঙ্খলা আর হাজার হাজার শবযাত্রার মিছিলের জন্য তৈরি থাকতে হবে। লকডাউন এখনই আবার কড়াকড়ি করতে হবে।

লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।

এসি