ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

রমজান হোক জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করার অভ‍্যাস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:০১ পিএম, ১৮ মে ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১২:০১ পিএম, ১৮ মে ২০২০ সোমবার

মানুষের দেহ ও মনকে সংযমের শাসনে রেখে ইসলামি শরিয়ত বা জীবনবিধানের পরিপন্থী যাবতীয় অসামাজিক ও অমানবিক কার্যাবলি পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাকওয়া অর্জনের কঠোর সিয়াম সাধনাই মাহে রমজানের মূলকথা। রোজা অর্থ আত্মসংযম। মিথ্যাচারিতা, আজেবাজে, অহেতুক কথা বলা, চোখের গিবত এবং কটু বাক্য হতে জিহ্বাকে সংযত রাখা, প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হেফাজত করা এবং হারাম মাল না খাওয়া—সর্বক্ষেত্রেই সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রোজা প্রকৃতই রোজাদারদের হাত, পা, মুখ ও অন্তঃকরণকে সংযত করে। সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের রোজা চক্ষু, কান, জিহ্বা, হাত, পা এবং দৈহিক সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে অর্জিত হয়। 

চুপ থাকার গুরুত্ব

চমৎকার একটি মিশরীয় প্রবাদ আছে চুপ থাকা নিয়ে- ‘কোলাহল যদি রূপার তৈরি হয়, নিরবতা তবে সোনার তৈরি।’ 

আরবি প্রবাদটা আরও চমৎকার- ‘তুমি তখনোই কথা বলো যখন তা চুপ থাকার চেয়েও সুন্দর।’ 

কেন চুপ থাকাকে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? 

কারন জিহ্বা দ্বারা সংশ্লিষ্ট গুনাহগুলো আমাদের ভালো আমলগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

এবার জেনে নেয়া যাক জিহ্বা দ্বারা সৃষ্ট কবিরা গুনাহ সমূহ :

১. মিথ্যা কথা বলা।
২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
৩. মিথ্যা শপথ করা।
৪. গিবত করা।
৫. পরনিন্দা করা।
৬. অভিশাপ দেয়া।
৭. খোঁটা দেওয়া।
৮. চোগলখোরি করা।

আমরা সারাদিনে যত কথা বলি তার বেশিরভাগই দেখা যায় অপ্রয়োজনীয় এবং মিথ্যাচার ও গিবতে পরিপূর্ণ। অথচ মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দই লিপিবদ্ধ হচ্ছে। 

মহান আল্লাহ বলেন- ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।’ [সূরা কাফ : ১৮]

হাশরের ময়দানে দেখা গেল আমাদের পূণ্যের চেয়ে পাপের পাল্লা ভারি। অবাক হওয়ারই কথা! কারণ কখনো কারো ক্ষতি করিনি, কারো প্রতি অন্যায় করিনি, তারপরো এ অবস্থা কেন?

তখন উত্তর আসবে- ‘এগুলো তোমার মুখ নিঃসৃত পাপের ফল।’ 

আল্লাহর রাসুল (সা.) এ জন্যই বলে গেছেন- ‘অধিকাংশ মানুষ জিহ্বা দ্বারা সংঘটিত পাপের কারণ জাহান্নামে যাবে।’ [তিরমিযি : ১৬১৮]

এ অবস্থায় করনীয় কাী?

এর সমাধানও রাসুলুল্লাহ (সা.) দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।’ 
[মিশকাত হা/৪২৪৩]

আমাদের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি তো? নাকি জিহ্বাই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে?

রোজাদারকে কু-কথা শ্রবণ করা থেকে নিজের কানকে বিরত রেখে সাধনা করতে হবে। কেননা, যেসব কথা বলা হারাম, সেগুলো শ্রবণ করাও হারাম। এ জন্যই মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম ভক্ষণকারীদের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গিবতকারী ও শ্রবণকারী উভয়ই গুনাহের অংশীদার।’ সুতরাং সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা, রুটিনমাফিক উপবাস করা, মসজিদে যাওয়া, তারাবি নামাজ পড়া, ইফতার আর সেহির খাওয়াতেই রোজা পালন সম্পন্ন হয় না, এর সঙ্গে রোজাদার ব্যক্তির দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সংযম সাধনা করা বাঞ্ছনীয়।

কিছু গুণের সমন্বিত একটি রূপকে ইসলামের দৃষ্টিতে মুখের হেফাজত বা বাকসংযম বলা হয়েছে। চলুন এবার জেনে নেই সেসবগুণগুলো।

কথা বলায় সাবধানতা

হজরত বিলাল বিন হারিস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তাঁর সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। আবার মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তাঁর অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। [তিরমিজি,মুয়াত্তা]

মিষ্টভাষী হওয়া

হজরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছে- ‘নিশ্চয় জান্নাতে বালাখানা থাকবে, যার ভেতরের সবকিছু বাইরে থেকে দেখা যাবে।" একজন বেদুঈন দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো, 'ঐ বালাখানা কাদের জন্য হবে?’

রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বললেন- ‘যারা মিষ্টভাষী হবে, অভাবীদের আহার করাবে, রাতের গভীরে যখন মানুষ নিদ্রামগ্ন থাকে তখন যারা নামায পড়ে।’ [তিরমিজি শরীফ ]

বিতর্ক পরিহার

হজরত আবূ উমামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের আশপাশে কোনো গৃহের জামিন হব যে উপযুক্ত ও সঠিক হবার পরও (বিপক্ষের) বিতর্ক ছেড়ে দেয়, আর ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে কোনো গৃহের জামিন হব যে ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যে পরিহার করে এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে কোনো গৃহের জামিন হব যে তার চরিত্রকে সুন্দর বানায়। [আবূ দাঊদ : ৪৮০০]

বেশী কথাবার্তা মনকে কঠিন করে দেয়

হজরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ-র যিকির ছাড়া বেশী কথা বলো না। কেননা আল্লাহ তাআলার যিকির বা স্মরণ ছাড়া বেশী কথাবার্তা মনকে কঠিন করে দেয় আর কঠোর মনের ব্যক্তিই আল্লাহ থেকে সর্বাধিক দূরে। [তিরমিজি, ১৫১৮]

জবানের হেফাজত হল নাজাতের পথ

হজরত উকবা ইবনে আমের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম : হে আল্লাহর রসূল! নাজাত কিসে? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তোমার জবানকে হেফাজত করো, তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়, তুমি তোমার ভুলের জন্য কান্না করো। [তিরমিজি]

জান্নাতের জিম্মাদারী

হজরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আ.) বলেন কথা বলা যদি হয় রুপার মতো তাহলে চুপ থাকা হবে স্বর্ণের মতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চলায়ের মাঝে যা আছে অর্থাৎ জিহ্বা এবং তার দুই পায়ের মাঝে যা আছে অর্থাৎ লজ্জাস্থানের জিম্মাদারী দিবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদারী নিবো। [বুখারি শরীফ]ৎ

ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা

হজরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অন্যথায় চুপ থাকে।’ [বুখারি ও মুসলিম থেকে রিয়াদুস সলিহীন –১৫১১]

হজরত উকবা ইবনে আমের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল! নাজাতের উপায় কি? তিনি বললেনঃ তোমার জিহবাকে সংযত রাখ, তোমার ঘরকে প্রশস্ত কর এবং তোমার অপরাধের জন্য কান্নাকাটি কর। [তিরমিযি থেকে রিয়াদুস সলিহীন –১৫২০]

এসএ/