এবারের রমজান হোক দানের
প্রকাশিত : ১৮:১৯, ২৮ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৮:১৯, ২৮ এপ্রিল ২০২০
মাহে রমজানে রোজা পালন মানুষকে দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা ও মহত্ত্বের শিক্ষা দেয়। কোনো প্রকার অপচয় না করে রোজার মাসে মানুষের সেবায় দান-সাদকা করলে অভাবক্লিষ্ট মানুষের কল্যাণ হয় এবং মানবতা উপকৃত হয়। করোনার এই সঙ্কটকালে অসহায়, শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে। তারে খাদ্য সহ নানান সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সময় এই রমজানে আমরা অতিরিক্ত খরচ না করে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে রমজান আরও সার্থক ও কল্যাণকামী হবে।
বিশেষ করে রমজান মাসে ইফতারিতে বিশাল আয়োজন থাকে। ঘরোয়া আয়োজনের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার পার্টি। যাতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়। সেই সঙ্গে সেহেরিতে থাকে অন্যরকম আয়োজন। ভালো ও বিভিন্ন ধরণের দামি খাবারের নানান পদে টেবিল সাজিয়ে নেই আমরা। রমজানে অতিরিক্ত কেনাকাটা আমাদের এক প্রকার অভ্যাস। তাছাড়া ঈদের বাজারে পোশাক ও রকমারি প্রসাধনী ক্রয়ে অনেক অর্থ বাজেট থাকে প্রতিবছর। এবছর রমজান এসেছে ভিন্ন ভাবে। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে এমন রমজানের দেখা মেলেনি আমাদের কাছে। সবাই ঘরে বসেই প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতার করা সহ রোজার সব নিয়মকানুন পালন করছেন। তাই এই রমজানকে অনেকেই সৌভাগ্যের রমজান হিসেবে দেখছেন।
এছাড়া রমজান শেষে যাকাতের এটি বিষয় থাকে। ধনী মানুষ এই যাকাতের জন্য বিশাল আয়োজন করে থাকেন। তবে এবার যদি সবাই একটু নতুনভাবে নিজেদের দানের হাতটি প্রসারিত করেন তবে অসহায় মানুষ তাদের কষ্টগুলো থেকে একটু হলেও দূরে থাকতে পারবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সমগ্র মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার ও দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে যখন হজরত জিব্রাইল (আ.) নিয়মিত আসতে শুরু করতেন, তখন তাঁর দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত। (বুখারি) হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-এর চেয়ে কাউকে অধিকতর দয়ালু দেখিনি।’ (মুসলিম)
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের অন্তরে দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলি সৃষ্টি হতে পারে। মানুষকে দানশীল, সহানুভূতিশীল, মানবদরদি ও পারস্পরিক কল্যাণকামী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ইসলামের প্রতিটি ইবাদত সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালায়। তাই রোজাদার ব্যক্তিকে ইবাদতে মগ্ন থেকে সদয় আচরণ, দানশীলতা ও বদান্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রোজার দ্বারাই মানুষ দানশীল ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহ পাক বলেছেন: হে আদম সন্তান! তুমি দান করতে থাকো, আমিও তোমাকে দান করব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
যিনি দাতা বা দানশীল, তাঁর হাত দানগ্রহীতা বা দান গ্রহণকারীর হাত থেকে উত্তম। দাতা শ্রেষ্ঠ এ জন্য যে তিনি দানশীলতা ও বদান্যতার মাধ্যমে অন্যের উপকার করেন। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা আত্মমর্যাদাশীল অথচ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত, তারা প্রকাশ্যে সাহায্য চাইতে লজ্জাবোধ করলেও তাদের থেকে দান আরম্ভ করা অপরিহার্য। আর দান-সাদকা করে রোজাদার ব্যক্তি অন্তরে কষ্ট অনুভব করলে সেই দান আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় ও পছন্দনীয় হয় না। তাই প্রাচুর্য থেকে দান করলে অধিক পুণ্য হয়। কেননা, এতে দাতার অন্তরে কোনো রকম কষ্ট হয় না।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনীদের) অর্থ-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা আল-জারিআত, আয়াত ১৯)
মাহে রমজানে দানের ফজিলত অনেক বেশি। অন্য ১১ মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক দান-সাদকা করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতদের বাস্তব শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রমজান মাসে দান-দক্ষিণা ও বদান্যতার হাত বেশি করে প্রসারিত করতেন। মাহে রমজানে তাঁর দানশীলতা অন্যান্য মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেত। এ মাসটিকে তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি মাহে রমজানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন। প্রত্যেক সাহায্যপ্রার্থী দরিদ্রকেই তিনি দান করতেন। এ সময় কোনো প্রার্থী তাঁর কাছ থেকে বঞ্চিত হতে পারত না।
যে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতি সৃষ্টি হলো না, দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলি তৈরি হলো না, তার রোজা পালন নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। তাই যে ব্যক্তি শুধু রোজা পালন করে, কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষায় এগিয়ে আসে না, সমাজের গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণ তথা দারিদ্র্য বিমোচনে হাত সম্প্রসারণ করে না, সে ব্যক্তি রমজান মাসের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়। একজন রোজাদার মন থেকে কৃপণতা পরিহার করে যদি দানশীল না হন, তাহলে তিনি আল্লাহর কাছে কেবল রোজা রাখার জন্য তাঁর রহমত লাভে বঞ্চিত হবেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন কৃপণ আবেদের চেয়ে একজন মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।’ আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে দান-সাদকা করে সে সাধারণ সময়ের দানের চেয়ে বহুগুণ বেশি সওয়াব পাবে।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রমজান মাসে এক দিরহাম দান-খয়রাতের বিনিময়ে সহস্র দিরহামের পুণ্য লিপিবদ্ধ করা হয়।’
মাহে রমজানকে সহানুভূতির মাস বলা হয়েছে। এ মাস সমাজের গরিব-দুস্থদের প্রতি অর্থ দ্বারা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। প্রতিটি রোজাদার রোজা রাখার মাধ্যমে খাদ্য-পানীয়র অভাবে গরিব-দুঃখী ও দরিদ্র-অসহায় লোকদের কষ্ট অনুভব করে থাকেন। এ জন্য তাদের মধ্যে দানের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তি রোজা পালনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ গঠনে গরিব-দুঃখী, দুস্থ, অভাবী, অনাথ, এতিম, মিসকিন ও কপর্দকহীন পথচারীকে প্রয়োজনে অর্থ বণ্টন করে দেবেন। তারা ক্ষুধার্ত হলে প্রয়োজনে তাদের সেহির-ইফতারের বন্দোবস্ত করবেন, এটা মাহে রমজানে দানশীলতা ও বদান্যতা প্রদর্শনের সুবর্ণ সুযোগ।
যে রোজাদারের মন উদার ও আত্মা পরিশুদ্ধ, সে দরিদ্র হলেও প্রকৃত ধনী। যার যত টাকাপয়সা আছে, সেই অনুপাতে দান-সাদকা আল্লাহ গ্রহণ করে থাকেন। ধনী ও বিত্তশালী রোজাদার ব্যক্তি বেশি টাকা দান করে যে পুণ্যের অধিকারী হবেন, অনুপাতে কম টাকা দানকারী বিত্তহীন ব্যক্তিও আল্লাহর কাছে সেই পুণ্যের অধিকারী হতে পারেন, যিনি বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে খুশিমনে দান করবেন। দানের ব্যাপারে শুধু টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভর করে না, তা মানুষের মনের ওপর নির্ভর করে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আত্মার অভাবমুক্তিই হচ্ছে আসল অভাবমুক্তি।’ (বুখারি)
যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত রোজা পালন করে, কিন্তু দানশীলতা ও বদান্যতার চর্চা করে না, তার এ রোজা তাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রিয় বানাতে পারবে না।
হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) বলেছেন, ‘নামাজ মানুষকে আল্লাহর পথে অর্ধেক পৌঁছে দেয়। রোজা তাকে আল্লাহর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছায়। আর দান-খয়রাত তাকে খোদ আল্লাহর ঘরে পৌঁছে দেয়।’
জান্নাতে প্রবেশের জন্য দানশীলতা একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ। তাই প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের মাহে রমজানে রোজা পালনের সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় ধন-সম্পদকে দুস্থ মানবতার সেবায় সাধ্যমতো ব্যয় করা, অপরকে দান-সাদকা করার মনোভাব পোষণ করা উচিত।
প্রতিবছর রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ অনেক সংগঠন জমকালো ইফতার পার্টির আয়োজন করে। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে এবারের রমজানে ইফতার পার্টি, মাহফিল আয়োজন নিষিদ্ধ। বিভিন্ন দল, সংগঠন, সমিতি, প্রতিষ্ঠানের বিপুল টাকা সাশ্রয় হবে। করোনায় কাজ হারানো শ্রমিক, গরিব, অনাহারীদের জন্য এ টাকা ব্যয় করা হলে সংকটে পড়া দরিদ্র মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
প্রতি রমজানে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোও কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায় পর্যন্ত ইফতার পার্টির আয়োজন করে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন দলের প্রধানসহ শীর্ষ রাজনীতিকরা মাসজুড়েই ইফতারের আয়োজন করেন বিভিন্নজনের সম্মানে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মুদিখানার মালিক সমিতি, নায়ক-গায়ক-খেলোয়াড়দের ক্লাব, ফুটপাতের শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনও ইফতারের আয়োজন করত। ধর্মভিত্তিক সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মসজিদ, মাদ্রাসায় ইফতার মাহফিল রমজানজুড়েই হতো।
এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলরসহ সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও মাসজুড়ে ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। বিভিন্ন দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও একই কাজ করেন। পাড়া-মহল্লার বাসিন্দাদের কল্যাণ সমিতি থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট বাড়ির মালিকদের সংগঠনও ইফতার পার্টির আয়োজন করে।
এবার যেহেতু সে সুযোগ নেই, তাই সবার উচিত নিজের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা দরিদ্র মানুষ যারা খাদ্য সংকটে আছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো। এটা ধর্মীয় দিক থেকে যেমন প্রয়োজন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও করা উচিত।
তবে শুধু মুসলমানরাই নয়, করোনার এই ক্রান্তিকালে সব ধর্মের মানুষ দানের হাতকে পারেন প্রসারিত করতে। এতেই মিলবে মুক্তি, প্রতিষ্ঠিত হবে মানবতা।
এসএ/