ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা

বুদ্ধের জীবন, ধর্ম ও দর্শন

প্রকাশিত : ১৭:৩৭, ২৯ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১১:০৩, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

বুদ্ধ পূর্ণিমা বিশ্ববৌদ্ধদের সবশ্রেষ্ট ধর্মীয় উৎসব। এ দিনটি বিশ্ববৌদ্ধদের নিকট পবিত্র ও মহিমান্বিত দিন। ভগবান বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার বিশাখা নক্ষত্রে রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে আলোকপ্রাপ্ত অর্থাৎ সর্বতৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে বোধিজ্ঞান লাভ করে জগৎ পূজ্য বুদ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। বুদ্ধের জীবনে মহাপবিত্র ত্রি’স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের নিকট অতি গৌরবের ও মহাপবিত্র দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। ২৫৬১ বুদ্ধবর্ষ এবছরের বুদ্ধ পূর্ণিমা। বাংলাদেশের বৌদ্ধরাও নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে এ পবিত্র দিবসটি উদযাপন করছে। বুদ্ধবর্ষ গণনায় বৈশাখই প্রথম মাস। সেই হিসেবে বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোও তাদের পহেলা বৈশাখ বৈশাখের প্রথম দিনে উদযাপন করে। বিশেষতঃ থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা ভারতের কিছু কিছু প্রদেশ। বাংলাদেশও বৈশাখ মাসের প্রথম দিবসটি পহেলা বৈশাখ হিসেবে উদযাপন করে। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের সময়কাল থেকেই বাঙালি জাতি বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করতেন। তাঁর কারণ এদেশে বাঙালি সাংস্কৃতির বিকাশে পাল রাজাদের ভূমিকা ছিল। পাল রাজা বাঙালি ও বৌদ্ধদের পৃষ্টপোষক ছিলেন। তাদের চারশত বছরের অসাম্প্রদায়িক শাসন কালকে ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। এটা বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের কারণে সমগ্র এশিয়ায় বৈশাখই বৎসর গণনায় প্রথম মাস। বুদ্ধের জন্মোৎসবের কারণেই এ ইতিহাসিক ঘটনা। তাই ভগবান গৌতম বুদ্ধও একজন ঐতিহাসিক মহামানব হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত। সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম একজন সাধারণ মানুষের মতো হয়েছিল। পিতা রাজা শুদ্ধোধন ও মাতা রাণী মহামায়া। শাক্য রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু হতে মায়াদেবীর পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে বর্তমান নেপাল রাজ্যের রম্মিদের স্থানে লুম্বিনী কাননে। শাক্য বংশে জন্ম হয়েছিল বলে গৌতম বুদ্ধকে শাক্যসিংহ বলা হয়। তাঁর পারিবারিক নাম রাজকুমার সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর মহামায়া মারা যান। বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী লালন পালন করেছিলেন বলে পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ নামে বিখ্যাত হন। সিদ্ধার্থ গৌতম কেন রাজপুত্র হয়েও সন্ন্যাস জীবন বা অনাগারিক জীবন বেছে নিলেন? মানুষ যে জন্ম, জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যুর অধীন, এর কষাঘাতে জর্জরিত মানবের মুক্তির পথ খুঁজতে তিনি রাজসুখ ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স উনত্রিশ বৎসর। ভরা তারুণ্য তাঁর মধ্যে। এ বয়সেই জগৎকে দেখেছিলেন শুধু দুঃখ আর দুঃখময়রূপে। আর সুখের পরিমাণ সামান্য, তাও মরিচিকাবৎ। বুদ্ধের ভাষায়-দুঃখই উৎপন্ন হয়, দুঃখই বিরাজ করে, দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু উৎপন্ন হয় না, দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু নিরোধও হয় না। তিনি মহানিষ্ক্রমণ বা সংসার ত্যাগ করে ঋষি আড়ার কালাম ও রাজপুত্র রুদ্রকের নিকট ধ্যান সমাধি করেন। এতে তাঁর চিত্ত রমিত না হলে কৃচ্ছসাধনায় মনোনিবেশ করেন- ইহাসনে শ্যুষ্যতু মে শরীরং ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু, অপ্রাপ্র বোধিং বহ কল্প দুলভং নৈবসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতেজ। এদেহ শুকিয়ে যাক, তক, অস্থি, মাংস প্রলয়ে যাক, বোধিজ্ঞান অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমি এ আসন থেকে উঠব না। এ কঠোর বজ্র দৃঢ় সংকল্পের কারণে সিদ্ধার্থ গৌতমের শরীর-জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেল। চলৎশক্তি হারিয়ে বিষম দুর্বল হয়ে গেলেন। কৃচ্ছ্র সাধনায় যে বিমুক্তিলাভ অসম্ভব সিদ্ধার্থ গৌতম উপলব্ধি করলেন। পরে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে মধ্যম পন্থা গ্রহণ করলেন। বৈশাখী পূর্ণিমা দিনে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে চরম ও গরম প্রাপ্তি বোধিজ্ঞান লাভ করলেন। বোধিজ্ঞান লাভ করে যে উদান বাণী তিনি উচ্চারণ করলেন-‘ এ দেহ রূপ গৃহ নিমার্তার সন্ধান করতে গিয়ে অনেক জন্ম পরিভ্রমন করেছি। বুঝতে পেরেছি পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ দুঃখজনক। হে গৃহ নিমার্তা, আমি তোমার সন্ধান পেয়েছি। তুমি পুনরায় এ গৃহ আর নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার সমুদয় পার্শ্বক ভাগ্ন ও গৃহকূট ভেঙ্গে দিয়েছি। সংষ্কারমুক্ত চিত্ত সমুদয় আমি তৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করেছি।’ এটা বুদ্ধত্ব লাভের পর আন্দোচ্ছ্বাসে উদান বাণী পরিবেশন করেছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথম যে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের (কৌন্ডিন্য, ভদ্রিয়, বপ্প, অশ্বজিৎ ও মহানাম) ধর্ম ভাষণ করেছিলেন তাকে ’ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন সূত্র’ হিসেবে ইতিহাসে দেখা যায়। তথাগত বুদ্ধ এ সূত্রে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে বুঝিয়েছেন তিনি যে মধ্যম পথ অধিগত হয়েছেন যা চক্ষু উৎপাদনকারী, জ্ঞান উপশম ও অভিজ্ঞতা উৎপাদনকারী এবং যা মানুষকে সম্বোধি ও নির্বাণের দিকে সংবর্তিত করে।’ বোধিলাভের পর দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর ব্যাপী বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষের বাহ্যিক আচরণের উপর নয়, অন্তর জগতকে পূর্ণতায় ভাসিয়ে দিতে। ইন্দ্রিয় সংযম, বাক সংযম, চিত্তের সংযম, আহারে-বিহারে মাত্রা জ্ঞান বা সংযম-এগুলোই ছিল তাঁর উপদেশ। আসব ক্ষয় না হলে কেবল শীল ও ব্রত সম্পন্ন হলে বা বহু শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করলে, এমন কি নির্জনে বাস ও সমাধি লাভ করলেও যে নির্বাণ লাভ করা যায় না, বুদ্ধ এ কথা বারবার বলেছেন তাঁর শিষ্যমণ্ডলীকে । বুদ্ধত্ব লাভের পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকেও একই উপদেশ দিয়েছেন…….. ‘হে ভিক্ষুগণ! প্রব্রজিতদের দুই অন্ত পরিত্যাগ করা উচিত। সে দুই অন্ত কী? প্রথম হীন গ্রাম্য ইতরজনভোগ্য অনার্য, অনর্থ সংযুক্ত কাম্য বস্তুর উপভোগ, দ্বিতীয় দুঃখময় অনার্য, অনর্থ সংযুক্তদেহ নিযার্তন। এ দুই অন্ত অতিক্রম করে তথাগত বুদ্ধ মধ্যম পথ আবিষ্কার করেন। এ পথে দৃষ্টি লাভ হয়, জ্ঞান লাভ হয়, প্রাণ প্রশান্ত হয়, অভিজ্ঞা সম্বোধ ও নির্বাণ লাভ করা যায়। হে ভিক্ষুগণ! তথাগত যে মধ্যম পথন আবিষ্কার করেছেন, তা কোন পথ? তা এ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ …..১. সম্যক দৃষ্টি, ২.সম্যক সংকল্প ৩. সম্যক বাক্য ৪. সম্যক কর্মান্ত ৫. সম্যক আজীব ৬. সম্যক ব্যাম ৭. সম্যক স্মৃতি ৮. সম্যক সমাধি। সংযুক্ত নিকায় ৫৬/১১/১/৪।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি