রোজা : ভুল আচার, ভুল ধারণা
প্রকাশিত : ১০:৩৫, ১৫ এপ্রিল ২০২১
ইসলামের যে নির্দেশনাগুলো শত শত বছর ধরে প্রতিপালিত হতে হতে একসময় সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে গেছে, রোজা তার একটি। তবে সংস্কৃতিকরণের এই প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো ঢুকেছে কিছু ভুল ধারণা, ভুল আচার। এমন ভুল ধারণা যে, এগুলো করতে গিয়ে আসল কাজ প্রার্থনা করার তেমন সুযোগ থাকে না। যেমন রমজান মাসে বেশি খেলে এ জন্য আল্লাহ কোন হিসেবে নেবেন না। তারপর বেশি না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।
প্রচলিত আছে যে, রোজা রাখার পর ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত একজন মুসলমান হালাল হলে যে কোনো খাবার যত খুশি খেতে পারেন। ধর্মে তাকে এই ছাড় দেয়া হয়েছে। আর এই ভ্রান্ত ধারণার কারণে অন্য সময় আমরা যা খাই, রোজার সময় তার চেয়ে বেশি খাই। অন্য সময় যদি দু’বেলা খাই, কারণ অনেকেই নাশতা বা দুপুরের খাবারের মধ্যে যে কোনো একটা খুব হালকা করেন, তো রোজার মাসে খাই তিনবেলা ভরপুর।
ইফতারে ভুরিভোজ, তারপর রাতের খাবার এবং শেষরাতে ভরপেট সেহরি। ফলে যে মাসে ওজন কমার কথা তা না কমে বরং বেড়েছে। এই অতিভোজন, অপচয়ের কারণেই রোজার মাসে খরচ বাড়ে, বাড়ে দ্রব্যমূল্য, বাড়ে অসুস্থতা এবং হার্ট অ্যাটাক ও মৃত্যু। অথচ রমজানের আরবি প্রতিশব্দ সিয়ামের আক্ষরিক অর্থই হলো ‘সংযম’। ভোজন প্রবণতা কমবে, বাড়তি ওজন কমবে, কমবে খাওয়ার খরচ- এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, এতে বাড়বে সুস্থ্যতা।
অনেকে মনে করেন, এত বড় দিন রোজা রাখতে হবে! যত বেশি খেয়ে নেয়া যায়, তত ভালো! ফলে সেহরিতে রাখেন ভূরিভোজের ব্যবস্থা। অথচ সুস্থ রোজার চর্চায় এর চেয়ে ভ্রান্তির আর কিছু নেই। প্রথমত, রোজা রেখে আপনি পানি খেতে পারছেন না। আর প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রক্রিয়াজাত করতে দেহে লাগে প্রচুর পানি। ফলে সেহরিতে এসব খাবার যত বেশি খাবেন, আপনার তৃষ্ণা পাবে বেশি, অস্বস্তিবোধ হবে বেশি।
আবার উল্টোটাও আছে। অনেকে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ওঠার আলস্যে সেহরিই খান না। এ প্রসঙ্গে নবীজী (সা.) এর দুটি হাদিস হচ্ছে-
১. রোজার নিয়তে ফজরের আজানের আগে সেহরি খাও। সেহরির মধ্যে রয়েছে বরকত। -আনাস ইবনে মালেক (রা) : বোখারী, মুসলিম
২. আমাদের রোজা এবং খ্রিষ্টান-ইহুদিদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সেহরি খাওয়া। -আমর ইবনুল আস (রা) : মুসলিম
তাই সেহরিতে অল্প হলেও খেতে হবে।
হযরত আনাস ইবনে মালিকের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবীজি (সা.) ইফতার করতেন তিনটি তাজা পাকা খেজুর দিয়ে। তাজা পাকা খেজুর না পেলে, তিনটি শুকনো খেজুর দিয়ে। আর শুকনো খেজুর না পেলে তিন ঢোক পানি পান করে ইফতার করতেন।
তাঁর সেহরিও ছিল খুব সাদামাটা! একবার হযরত আনাস ইবনে মালেককে ডেকে নবীজী (সা.) বলেন, ‘আনাস আমি রোজা রাখার নিয়ত করেছি। আমাকে কিছু খাবার দাও। আনাস (রা.) তখন তাকে কয়েকটি খেজুর আর একটা পাত্রে পানি দিলেন। নবীজী (সা.) তাই খেলেন।’
রোজা নিয়ে এই ভ্রান্ত আচার ভ্রান্ত ধারণাগুলো থেকে মুক্ত হোন। স্রষ্টা স্বয়ং নিজের হাতে যে ইবাদতের প্রতিদান দেবেন বলে বলেছেন, সে রোজাকে সবচেয়ে ভালোভাবে পালনের মাধ্যমে সে পথে এগিয়ে যান আরো এক ধাপ।
আরেকটি প্রচলিত ধারণা রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয়, দীর্ঘসময় না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে এই ধারণাগুলো অনেকেরই আছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, রোজা এনার্জি লেভেলকে বাড়িয়ে দেয়।
তাছাড়া এই যে সবসময় খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে থাকা- এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে নিজের অজান্তেই মানুষ তার দেহকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু শারীরিক ঝুঁকির দিকে!
আমাদের দেহে আইজিএফ-১ হরমোন নামে এক ধরনের গ্রোথ হরমোন আছে যার কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোষ তৈরি করে দেহকে বাড়ন্ত রাখা। এসময় পুরনো কোষের মেরামত বা ক্ষয়পূরণের চেয়ে নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়াই বেশি সক্রিয় থাকে।
মানুষ যত বেশি খাবে, বিশেষত প্রোটিন জাতীয় খাবার, তত বেশি তার দেহ আইজিএফ-১ তৈরি করবে।
সবসময় যখন এমন একটা অবস্থা থাকে, অর্থাৎ কোনো বিরতি বা বিশ্রাম ছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়া- এই সুযোগেই দেহে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধি। কয়েক ধরনের ক্যান্সার, যেমন, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের সাথে বিজ্ঞানীরা উচ্চমাত্রার আইজিএফ-১ এর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা বলেন, এই অবস্থাকে পাল্টে দিতেই মাঝে মাঝে খাবার থেকে দেহকে অব্যাহতি দেয়া দরকার।
আর অটোফেজি নামের প্রাকৃতিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়াকে জোরদার করে রোজা যে দেহের কর্মক্ষমতাকেই বাড়ায়, ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ড. ইউশিনোরি ওশুমির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর তা তো এক বিশ্ব খবর।
ডায়াবেটিস রোগীদের যেহেতু নিয়ম করে খেতে হয়, তাই ডায়াবেটিস থাকলে রোজা রাখা যাবে কি না- এ নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।
তার আগে আমাদের একটু বুঝতে হবে, ডায়াবেটিস মানে কী? খুব সহজ ভাষায় বললে, আপনার ডায়াবেটিস হওয়া মানে হলো, আপনার জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন আর আপনার দেহ তৈরি করতে পারছে না।
আর এটা তখন হয়, যখন প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি হতে থাকে এবং নিয়মিত তা পেতে পেতে অলস এবং তৃপ্ত কোষগুলো একসময় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়।
কিন্তু আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরো সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মার্ক ম্যাটসন তার এক গবেষণায় দেখেন, উপবাস বা খাবার না খাওয়ার ক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু ফল দেখাচ্ছে। তার এ গবেষণায় তিনি ইঁদুর ব্যবহার করেছিলেন। ইঁদুরগুলোকে তিনি দু’ভাগ করেন। একভাগকে মাঝে মাঝে না খাইয়ে রাখতে লাগলেন। আর একভাগকে নিয়মিতভাবে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার এবং চিনি মেশানো পানি দিয়ে গেলেন।
দেখা গেল, মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট ইঁদুরগুলোর দেহে ইনসুলিনের সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়ছে। আর এতে করে তাদের কোষগুলো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে এবং বেড়েছে মেটাবলিজম। আর যে দেহে এ অবস্থা বিরাজ করে, সে দেহে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যায়।
আলসার রোগীদের একটা ধারণা আছে যে, তারা রোজা রাখতে পারবেন না। কারণ রোজাতে দীর্ঘ না খাওয়া, তাদের আলসার বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কোনো কোনো আলসার, যেমন, পেপটিক আলসারের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাই হলো রোজা। কারণ খাওয়ার পর একজন মানুষের পাকস্থলীতে যে এসিড নিঃসরণ হয়, রোজার সময় তা কমে যায়।
কারণ তখন সে না খেয়ে থাকে। যে কারণে রোজা রাখলে পেপটিক আলসারের রোগীদের সমস্যাগুলো অনেক কমে যায়।
এএইচ/এসএ/