আরাফার দিনের বিশেষ মর্যাদা ও আমল
প্রকাশিত : ১৯:০৬, ১৫ জুন ২০২৪
জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে বলা হয় ইওয়ামে আরাফা বা আরাফা দিবস। এ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন হাজিরা। হাজিদের জন্য এখানে অবস্থান করা ফরজ। এটি হজের অন্যতম রোকন বা ফরজ। এদিনটিই হজের মূল দিন। এ দিনের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এ দিনে বান্দার দিকে রবের রহমতের জোয়ার প্রবলবেগে উৎসারিত হয়। অসংখ্য বান্দাকে তিনি ক্ষমা করে থাকেন এ দিনে।
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘আরাফার দিনের মতো আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নিকটবর্তী হন এবং বান্দাদের নিয়ে ফিরিশতাদের নিকট গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, কী চায় তারা? (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৪৮)
জাবের রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় রয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা নিকটতম আসমানে আসেন এবং পৃথিবীবাসীকে নিয়ে আসামানের অধিবাসী অর্থাৎ ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। বলেন, দেখ তোমরা- আমার বান্দারা উস্কোখুস্কো চুলে, ধুলোয় মলিন বদনে, রোদে পুড়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সমবেত হয়েছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশী। অথচ তারা আমার আজাব দেখেনি। ফলে আরাফার দিনের মত আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৮৫৩)
এ দিন রাসূল সা. একটি দোয়া বেশি বেশি পড়তেন। দোয়াটি সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন, উত্তম দোয়া হল আরাফা দিবসের দোয়া, এবং আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণের সর্বোত্তম কথা হল—
لَا إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ اْلَحمْدُ وَهَوُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-লারিকালাহু, লাহুল মুলকু,ওয়ালাহুল-হামদু, ওয়াহুয়া আলা-কুল্লি শাইয়িং কাদির।
অর্থ :
আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তারই, প্রশংসাও তাঁর। এবং তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৮৫)
আরাফার ময়দানে এই দোয়াটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি পড়েছেন।
(১) আরাফার দিনের রোজা দ্বারা দু' বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়।
.
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা বিগত বছর এবং আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৩৬]
.
তবে, আরাফার মাঠে অবস্থানকারী হাজিগণ রোজা রাখবেন না। নবিজি হজ করা অবস্থায় আরাফার দিন রোজা রাখেননি, বরং এদিন দুধ পান করেছেন মর্মে হাদিস আছে। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৫২৫]
(২) আরাফার দিনে সর্বাধিক পরিমাণ জাহান্নামিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অন্যান্য দিনের তুলনায় আরাফার দিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।’’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৩১৭৯]
.
শয়তানের জন্য এই দিনটি বিষাদময়। সে এই দিনে নিজেকে তুচ্ছ ও অপদস্থ মনে করে এবং রাগান্বিত অবস্থায় থাকে। কারণ এ দিনে আল্লাহ তাআলা রহমত বর্ষণ করেন এবং বড় বড় গুনাহ মাফ করে দেন। [ইমাম মালিক, আল মুয়াত্তা: ৯৪৭; সনদ মুরসাল দ্বয়িফ]
.
(৩) আরাফাবাসীকে নিয়ে আল্লাহ গর্ব করেন।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে আসমানের ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন। তিনি তাদের বলেন, ‘‘আমার এই বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখো, তারা আমার কাছে এসেছে উশকোখুশকো ও ধূলিমলিন অবস্থায়।’’ [ইমাম ইবনু খুযাইমাহ, আস-সহিহ: ২৮৩৯; শায়খ আলবানি, সহিহুত তারগিব: ১১৩২; হাদিসটির সনদ সহিহ]
.
(৪) আরাফার দিনের দুআ মর্যাদাপূর্ণ।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘সর্বোত্তম দুআ হলো আরাফার দিনের দুআ। আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবিগণ এদিনে উত্তম যে দুআটি পড়েছি, তা হলো—
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক; তাঁর কোনো অংশীদার নেই। সকল প্রশংসা ও রাজত্ব তাঁরই; তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’’ [ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৮৫; হাদিসটি হাসান]
আরাফার দিনে এই দুআটি বেশি পরিমাণে পাঠ করা।
.
(৫) আরাফায় আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে তাঁর রবুবিয়্যাত তথা প্রভুত্বের স্বীকৃতি নিয়েছিলেন।
.
ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আরাফার ময়দানে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর সন্তানদের বের করে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, ‘‘আমি কি তোমাদের রব নই?’’, তারা (অর্থাৎ, আমরা) সকল মানুষ সেদিন বলেছিলো, ‘নিশ্চয়ই হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম।’ [সুরা আ’রাফ, আয়াত: ১৭২; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৪৫১; শায়খ আলবানি, সহিহুল জামি’: ১৭০১; হাদিসটি সহিহ]
.
(৬) আরাফার দিনেই আমাদের দ্বীন তথা ইসলামকে পূর্ণতা দেওয়া হয়েছিলো।
.
একবার ইহুদিরা উমার (রা.)-কে বললো, তোমরা কুরআনের এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করো, যদি সে আয়াতটি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হতো, তবে, আমরা সেই দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করতাম। উমার (রা.) বলেন, ‘সেটি কোন্ আয়াত?’ সে বললো, ‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (জীবনবিধান) হিসেবে মনোনীত করলাম (সুরা আল মায়িদাহ, আয়াত: ০৩)।’’ উমার (রা.) বলেন, ‘আমরা জানি কোন্ দিন এবং কোথায় এটি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াম সাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে। সেদিন তিনি আরাফার ময়াদানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সেই দিনটি ছিলো জুমার দিন।’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৪৫]। উল্লেখ্য, এই দিনটিই ছিলো বিদায় হজের দিন।
.
(৭) এই দিনটিও ঈদের মতই আনন্দের দিন।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আরাফার দিন, কুরবানির দিন এবং তাশরিকের দিনগুলো (ঈদের পরের তিন দিন) হলো ইসলামে আমাদের ঈদের দিন।’’ [ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ৩০০৪; হাদিসটি সহিহ]
.
(৮) এই দিন এবং এর পরবর্তী আরও ৪ দিনের অন্যতম কাজ হলো, বেশি বেশি তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা; এটি ওয়াজিব।
.
একটি সুন্নাহসম্মত তাকবির:
"আল্লাহ সবচেয়ে বড়; আল্লাহ সবচেয়ে বড়; আল্লাহ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই। আল্লাহ সবচেয়ে বড়; আল্লাহই সবচেয়ে বড়; আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা"
.
এটি ইবনু মাস‘উদ (রা.) ও অন্যান্য পূর্বসূরিদের থেকে প্রমাণিত। [ইমাম দারা কুতনি, আস-সুনান: ১৭৫৬; শায়খ আলবানি, ইরওয়াউল গালিল: ৬৫৪; বর্ণনাটির সনদ সহিহ]
.
আরেকটি বিশুদ্ধ সনদের সহজ তাকবির (এটি পড়লেও ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে):
.সালমান ফারসি (রা.) বলেন, ‘তোমরা তাকবির দাও (এভাবে)—
"আল্লাহ সবচেয়ে বড়; আল্লাহ সবচেয়ে বড়; আল্লাহই সবচেয়ে বড়; তিনি মহান।" [ইমাম বাইহাকি, ফাদ্বাইলুল আওক্বাত: ২২৭; ইমাম ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি: ২/৪৬২; বর্ণনাটির সনদ সহিহ]
.
আরাফার দিন অর্থাৎ, জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একাকী বা জামাতে নামাজ আদায়কারী, নারী অথবা পুরুষ—প্রত্যেকের জন্য একবার তাকবিরে তাশরিক (উপরে বর্ণিত যেকোনো একটি তাকবির) পাঠ করা ওয়াজিব। পুরুষদের উচ্চ আওয়াজে বলতে হবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে বলবে, যাতে শুধু নিজে শুনতে পায়। [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৪/২২০; ইমাম ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৩৬০; ইমাম ইবনু আবিদিন, রাদ্দুল মুহতার: ৩/৬১; আল্লামা উসমানি, ইলাউস সুনান: ৮/১৫২]
.
পিরিয়ডে থাকা নারীদের জন্য এই তাকবির পাঠ করা জরুরি নয়। কারণ এটি ফরজ নামাজের পর পাঠ করতে হয়। তবে, তাঁরা এই দিনগুলোতে যখন-তখন বেশি বেশি পড়বেন। তাহলে নেকি পাবেন।
.
বি:দ্র: ফরজ নামাজ শেষে কোনো কথা বলা বা নামাজ পরিপন্থী কোনো কিছু করার আগেই অন্তত একবার তাকবির পাঠ করা ওয়াজিব। তাই, ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর বিলম্ব না করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা উচিত। ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র পড়ে নেবেন, পাশাপাশি বিলম্ব হওয়ার জন্য ইস্তিগফার পড়বেন। ফরজ নামাজের পরের মাসনুন আমলগুলো তাকবিরে তাশরিকের পর পড়বেন।
৯) যেকোনো নেক আমলই আরাফার দিনে করা, কারণ এটি জিলহজের দশকের অন্তর্ভুক্ত।
রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিলহজের (প্রথম) দশ দিনের আমলের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই।’’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ রাস্তায় জিহাদও কি এর চেয়ে উত্তম নয়?’ তিনি বললেন, ‘‘না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং এর কোনোটি নিয়েই আর ফিরে এলো না (অর্থাৎ, শহিদ হয়ে গেলো, তার কথা ভিন্ন)।’’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৯৬৯; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৪৩৮]
.
আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি আরাফার দিনের বিকেলটা (সন্ধ্যা পর্যন্ত) নির্জনে কাটিয়ে দিতে পারো, তবে তাই করো।’ [ইমাম আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া: ৩/৩১৪]
(১০) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনু আব্বাস (রা.)-কে বলেন, ‘‘হে আমার চাচাতো ভাই, এই দিনে যে ব্যক্তি নিজ কান ও চোখের নিয়ন্ত্রণ করবে, তাকে ক্ষমা করা হবে।’’ [ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৩০৪২; হাদিসটির সনদ সহিহ]
কেআই//