শূন্য থেকেই জীবন শুরু
প্রকাশিত : ১৬:৫৪, ১ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫৮, ১ মে ২০২০
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি- আইয়ামে জাহেলিয়াত, মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। আজ দ্বিতীয় পর্বে আপনারা জানবেন- শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়।
জন্ম হলো এক এতিম শিশুর: মক্কা। সোমবার ১২ রবিউল আউয়াল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। কোরাইশদের বনু হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন এক এতিম শিশু। বাবা আবদুল্লাহ মারা যান শিশুটির জন্মের ছয় মাস আগে। মৃত্যুকালে তিনি পরিবারের জন্যে রেখে যান পাঁচটি উট, ডজন তিনেক ছাগল এবং একজন দাসী। নবজাতক ছেলে হওয়ায় দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশুকে কাবায় নিয়ে গিয়ে নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’। মায়ের পর শিশুকে প্রথম দুগ্ধ পান করান চাচা আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবা। এদিকে তদানীন্তন রীতি অনুসারে জন্মের সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব শিশুর খতনা করান এবং কাবা প্রাঙ্গণে ভোজ দেন।
এদিকে, মা আমিনা প্রচলিত প্রথা অনুসারে ধাত্রীদের আগমনের অপেক্ষা করতে থাকেন। তিন মাস পর বনু সাদ গোত্রের ধাত্রীরা এলো। কিন্তু তাদের কেউই এই এতিম শিশুকে লালনের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না। হালিমাও প্রথমবার তাকে নিতে আগ্রহী হননি। কিন্তু গোত্রের অন্য ধাত্রীরা শিশু পেলেও হ্যাংলা-পাতলা বলে তাকে কেউই লালন-পালনের জন্যে শিশু দিতে আগ্রহী হয়নি। অগত্যা খালি কোলে ফিরে যাওয়ার চেয়ে তিনি এই পিতৃহীন শিশুকে কোলে তুলে নেন। শিশুর হাসিতে ভুলে যান তার কষ্ট। হালিমা অর্থ মমতাময়ী। শিশুটিকে পালনের ক্ষেত্রে তিনি অবশ্য তার নামের অর্থের সার্থকতার প্রমাণ দেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার চতুর্থ মাসেই হালিমার কোলে শিশুটির যাত্রা শুরু হয় তপ্ত মরুর পথে। গাধার পিঠে চেপে তারা নয় দিনের পথ পেরিয়ে পৌঁছান ৫০০০ ফুট উঁচু নজদ উপত্যকার শুষ্ক নদীতটে বনু সাদ গোত্রের আবাসস্থলে।
মোটা কাপড় আর ছাগলের চামড়ার বুননে তৈরি কালো ও ধূসর রঙের লম্বাটে নিচু তাঁবুতে হালিমার দুই মেয়ে এবং দুগ্ধপোষ্য ছেলের সাথে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠেন তিনি। মেষশাবক, ছাগলছানা আর আধাবুনো বেড়ালের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রাণীর প্রতি তার মমতার প্রকাশ ঘটে সেই হামাগুড়ি দেয়ার কাল থেকেই। আদিগন্ত মরুভূমির রুক্ষ প্রকৃতি, দারিদ্র্য আর বেদুইনদের স্বাধীন সহজসরল নির্ভীক পরিবেশ তাকে করে তোলে সুঠাম, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী। দু'বছর বয়সে হালিমা তাকে মা আমিনার কাছে নিয়ে এলেন, কিন্তু মক্কায় তখন রোগের প্রাদুর্ভাব। শঙ্কিত আমিনা ছেলেকে আবার মরুর বুকে ফিরিয়ে দিলেন। বনু সাদ গোত্র কথা বলত বিশুদ্ধ আরবিতে। শিশুকালেই তিনি বলতে শেখেন বিশুদ্ধ আরবি।
রুক্ষ মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা শান্ত তেজোদীপ্ত সুঠাম ও সাহসী এই শিশুকে পাঁচ বছর বয়সে হালিমা মায়ের কাছে মক্কায় ফিরিয়ে দিয়ে যান। মক্কায় তার খেলার সাথি হলেন প্রায় সমবয়সী চাচা হামজা ও ফুফু সাফিয়া। অভিজাত পরিবারের বিধবাদের বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী যুবকের কোনো অভাব তখন মক্কার সমাজে ছিল না। আমিনা এ ধরনের প্রস্তাব পুরোপুরি এড়িয়ে যান। পুত্রের প্রতি মমতাই প্রাধান্য পায় তার জীবনে। মাতুলকূলের আত্মীয়স্বজনদের সাথে পরিচিত করানোর জন্যে পুত্রকে নিয়ে যান মদিনায় খাজরাজ গোত্রের মাঝে। সেখানে পুত্র সাঁতার কাটতে শেখে। শেখে ঘুড়ি ওড়াতে। কিন্তু মায়ের সাথে এ আনন্দও মুছে গেল বাবা আবদুল্লাহর কবর জেয়ারত শেষে মক্কায় ফেরার পথে। মা আমিনা অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন আবওয়া নামক স্থানে। মরুভূমিতে মাকে কবরস্থ করে ছয় বছরের শিশু ফিরে এলেন মায়ের হাবশি দাসী বারাকার সথে। মায়ের পুরো স্নেহ দিয়েই বারাকা যত্ন নিয়েছেন এই শিশুর। তিনি তাই বলতেন মায়ের পর বারাকাই আমার মা।
দাদা আবদুল মুত্তালিব অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলেন এই এতিম শিশুর। দাদা হিসেবে নাতির প্রতি আদর আহ্লাদের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু মক্কার বেনিয়া সমাজে সবাই তখন ব্যস্ত টাকার ধান্ধায়। এই এতিম শিশুর লেখাপড়ার চিন্তা দাদার মাথায়ও আসে নি। তাই তিনি নিরক্ষরই থেকে গেলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব ৮২ বছর বয়সে মারা গেলেন। তখন এই শিশুর বয়স আট বছর। চাচা আবু তালিব তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলেন। চাচা ব্যবসায়ী ও গোত্রপ্রধান হলেও নির্মম বাস্তবতার শিকার এই এতিম বালক লেখাপড়ার কোনো সুযোগই পেলেন না। বেড়ে উঠলেন রাখাল হিসেবে রুক্ষ মরুভূমিতে মক্কাবাসীদের মেষ, ছাগল, উট, ঘোড়া চড়িয়ে; স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। শিশুকালে প্রাণীর সাথে বন্ধুত্ব এখন রূপ নেয় আরো ঘনিষ্ঠতায়। পশু প্রেমিক এই কিশোরের প্রেমে পড়ে যায় পশুরাও। সব ধরনের প্রাণী তার আওয়াজ ও ইঙ্গিতের ভাষা বুঝত। সহজেই পরিচালিত হতো তার ইঙ্গিতে বা আওয়াজে। সমবয়সী চাচা ও বন্ধু হামজা দুর্ধর্ষ শিকারি হলেও তিনি কখনো প্রাণী শিকারে অংশ নেন নি। তাই প্রাণীর ভালবাসাও তিনি পেয়েছেন প্রতিটি সংকটকালে।
রুক্ষ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কোনো কিশোরকে সে-কালে বাণিজ্যযাত্রায় সাথে নেয়া হতো না। কিন্তু স্বাবলম্বী হওয়ার অদম্য আগ্রহে তিনি চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার পথে বাণিজ্য কাফেলায় অংশ নিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। পথে বুসরার কাছে খ্রিষ্টান দরবেশ বাহিরা এই বাণিজ্য কাফেলার সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন তার আস্তানায়। বালককে পশুপালের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে সবাই আমন্ত্রণে সাড়া দিতে গেলেন। বাহিরা তখন জিজ্ঞেস করলেন, কাফেলার আরেকজন কোথায়? তখন এই বালককে সামনে উপস্থিত করা হলো। তিনি বালককে দেখেই তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে শনাক্ত করলেন। তিনি আবু তালিবকে বললেন, অনেক বড় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে এই বালকের জন্যে। আমাদের কিতাবে বর্ণিত কিছু লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি তার মধ্যে। অতএব আপনি একে নিয়ে সিরিয়া যাবেন না। রোমান ও ইহুদিরা যদি তাকে শনাক্ত করতে পারে তবে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, তার ক্ষতি করবে।
আবু তালিব তার কথা শুনে একজন দাসের সাথে মক্কায় ফেরত পাঠালেন বালককে। আসলে এই বালকের সুরক্ষায় তিনি আজীবন কখনো কোনো ত্রুটি করেন নি। কোরাইশ ও কায়েস গোত্রের লড়াইয়ে মুহাম্মদ কোরাইশদের পক্ষ অবলম্বন করলেন। কায়েস গোত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক তীর্থমেলায় আগতদের মক্কার উপকণ্ঠে উত্যক্ত ও লুটপাট শুরু করল। দুই গোত্রের মধ্যে পর পর চার বছর লড়াই চলল। ফুজ্জার যুদ্ধ নামে পরিচিত এ লড়াইয়ে কোরাইশরা বিজয়ী হলো। তবে ভবিষ্যতে শান্তি বজায় রাখার জন্যে কোরাইশদের উদ্যোগে ‘হিলফুল ফুজুল’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। তিনি লড়াইয়ে সরাসরি অংশ না নিলেও তরুণ যুবকদের নিয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেন।
শান্তি বজায় রাখা ছাড়াও-
১. পথিক ও তীর্থযাত্রীদের জানমাল হেফাজত
২. গরিব দুস্থদের সাহায্য
৩. মজলুমের সহযোগিতা
৪. জালেমকে মক্কায় আশ্রয় না দেয়ার বিষয়ে বিবদমান উভয়পক্ষই একমত হলো।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সময় বয়স্কদের পেছনে নীরবে যে দুজন তরুণ বসেছিলেন তাদের একজন হচ্ছেন তিনি আর অপরজন তার সারাজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর। অন্যায় ও জুলুমের বিপক্ষে তরুণ বয়স থেকেই তিনি ছিলেন অহিংস পন্থায় প্রতিকার প্রয়াসী। বয়স ২০ হতেই চাচা আবু তালিবের ব্যবসায়িক ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন এই তরুণ। আবু তালিব দেখলেন, এই তরুণের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা প্রবল আর যে-কোনো কিছু শিখে নিতে পারে দ্রুত। চাচার প্রয়োজন বলার আগেই বুঝতে পারতেন তিনি। ব্যবসায়িক আদব-কায়দা, আলাপ-আলোচনার ধরন, লেনদেন সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া সময়ের সাথে সাথে আয়ত্ত করলেন তিনি। পণ্যের গুরুত্ব, এর ওজন, এর মান, এর মূল্য, এ থেকে মুনাফার ধরন, ক্রেতা-বিক্রেতার পছন্দ-অপছন্দ, যাত্রাপথের সুযোগ ও বাধা সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান অর্জনও করলেন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে।
সেকালে সুগন্ধি আতর ও আগর ছিল অনায়াসে বহনযোগ্য সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্য। সংগৃহীত হতো ইয়েমেনের পার্বত্য এলাকা, সোমালিয়া ও আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইরিত্রিয়া) দুর্গম পাহাড় থেকে। এর ক্রেতা ছিল অভিজাতরা। বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের অভিজাত ও ধর্মীয় মহলে এর কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। মক্কার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করত তখনকার এই বিশাল বাণিজ্য। মিশর, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাক-ইয়েমেন জুড়ে পুরো আন্তঃবাণিজ্যই ছিল কোরাইশদের নিয়ন্ত্রণে। আর এই সুদূর এলাকায়ও ছিল মক্কার অভিজাতদের বাগানবাড়ি, ফলবাগান, কৃষিখামার। যুবক মুহাম্মদ তার সততা, বুদ্ধিমত্তা, বিনয় ও আমানতদারির কারণে মক্কার অভিজাত ব্যবসায়ী মহলের আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন। সবাই তাকে ডাকতে শুরু করল ‘আল আমিন’ (বিশ্বস্ত) নামে।
বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনায় হয়ে উঠলেন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ। ২৩ বছর বয়সে তিনি নিজেই বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনা শুরু করলেন। তার প্রথম ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন আল সাইব ইবনে আবি আল সাইব। নিজস্ব ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল। হয়তো চাচার কাছে লালিত-পালিত হওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা আবু তালিবের পরিবারের অংশ হওয়ার মানসে তিনি চাচাত বোন ফাকহিতাকে বিয়ের প্রস্তাব করলেন। চাচা প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। তিনি ফাকহিতাকে বিয়ে দিলেন সম্পদশালী মাখজুম গোত্রের হুবাইরা ইবনে আবি ওয়াহের সাথে। অবশ্য এই ঘটনাও চাচা বা চাচাতো বোনের সাথে সম্পর্কে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে নি। সম্পর্ক সবসময়ই ছিল একই রকম আন্তরিক। ফাকহিতা পরবর্তীকালে উম্মে হানী নামে পরিচিত হন।
ব্যবসায়ী মুহাম্মদের বৈশিষ্ট্য: ব্যবসায়িক সততা। কেনার সময় ন্যায্যমূল্য প্রদান। বেচার সময় ভালো পণ্য প্রদান। সময়মতো অর্থ পরিশোধ। অন্যের ব্যবসা পরিচালনার সময় নিজের জন্যে কোনো আলাদা গোপন বখরা না রাখা। গচ্ছিত অর্থ বা দ্রব্য যথাযথভাবে প্রত্যর্পণ। সবার প্রতি আন্তরিক সমমর্মিতা। ব্যবসায়ে লাভের প্রায় পুরোটাই অভাবীদের মাঝে বিতরণ। এই ছিল ব্যবসায়ী মুহাম্মদের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য বিত্তশালী বিধবা খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। খাদিজা বনু আসাদ গোত্রের বিত্তশালী বাবার কন্যা। তার প্রথম বিয়ে হয় তামিম গোত্রের আবু হালা ইবনে জারারার সাথে। দুই পুত্রের জননী হন। একজনের নাম হিন্দ। অপরজনের নাম হালা। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর বিয়ে হয় বনু মখজুম গোত্রের আতিক ইবনে আয়াজের সাথে। এখানেও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। যার নামও ছিল হিন্দ। দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর বিপুল ধনসম্পদ আসে তার হাতে। মক্কার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে একটা বিশাল বিনিয়োগই ছিল তার।
খাদিজা বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনায় তার নিযুক্ত এজেন্টদের নির্ধারিত লভ্যাংশ প্রদান করতেন। তিনি এবার সিরিয়ার পথে বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনার জন্যে মুহাম্মদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন। সফল ব্যবসায়ীদের মতো তিনিও তার বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে কাফেলার সাথে দিয়ে দিলেন। সততা ও দক্ষতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটায় এই বাণিজ্য কাফেলায় প্রত্যাশার চেয়েও দ্বিগুণ লাভ হলো খাদিজার। খাদিজা প্রতিশ্রুত লভ্যাংশের চেয়ে দ্বিগুণ লভ্যাংশ ব্যবসা পরিচালনার জন্যে মুহাম্মদকে প্রদান করলেন। সুন্দরী, বুদ্ধিমতি ও বিত্তবান সম্ভ্রান্ত বিধবা খাদিজাকে বিয়ে করার ব্যাপারে অনেকেই আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু তিনি প্রতিটি প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এরা আসছে তার বিত্তের লোভে। তিনি খুঁজছিলেন একজন সৎ, চরিত্রবান ও ভালো মানুষ। বাণিজ্য কাফেলা ফিরে আসার পর মায়সারা মুহাম্মদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণ লেনদেন সবকিছুর সবিস্তার বর্ণনা দিলেন খাদিজার কাছে। শুনে খাদিজা মুগ্ধ হলেন।
তবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি পরামর্শ নেয়ার জন্যে প্রাজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা এই যুবকের বর্ণাঢ্য ভবিষ্যতের কথা বললেন। খাদিজা এরপর তার বান্ধবী নুফাইসার পরামর্শ নিলেন। নুফাইসা নিজেই মুহাম্মদের সাথে দেখা করলেন। খাদিজাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি সম্মতি দিলেন। চাচা হামজাকে সাথে নিয়ে এরপর তিনি খাদিজার চাচা আমর ইবনে আসাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। খাদিজার বাবা খোয়াইলিদ ফুজ্জার যুদ্ধের আগে মারা যাওয়ায় চাচাই ছিলেন তার অভিভাবক। যথারীতি বিয়ে হলো। তখন তার বয়স ২৫। দেনমোহর ধার্য হয়েছিল ৪০০ দিরহাম এবং ২০টি উট। ইতিহাসের এক অসাধারণ বিয়ে। একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী নারীও বিয়ের পর স্বামীর চেতনায় কতটা উজ্জীবিত হতে পারেন, তার উদাহরণ খাদিজা।
স্বামীর প্রতি তার ছিল প্রশ্নাতীত ভালবাসা। মক্কার সামাজিক বৈষম্য ও গরিবদের বঞ্চনার ব্যাপারে তিনিও ছিলেন স্বামীর মতোই ব্যথিত। তাদের দাম্পত্য জীবনে ছিল এরই ছোঁয়া। বিয়ের পর তিনিও স্বামীর মতো সাধারণ মোটা সূতি কাপড় ব্যবহার করতেন। অভিজাতদের সিল্ক সযত্নে এড়িয়ে চলতেন। নতুন পোশাক কেনার পরিবর্তে স্বামীর মতো পুরাতন পোশাক সেলাই বা তালি দিয়ে ব্যবহার করতেই পছন্দ করতেন।
ব্যবসায়ের লাভের প্রায় পুরোটাই দান করে দিতেন গরিবের মধ্যে খাবার ও সাহায্য হিসেবে। ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে তারা ছিলেন একজন আরেকজনের পোশাক, সকল দুঃখের সমব্যথী, সকল আনন্দের সাথী, সকল সংগ্রামের সহযোদ্ধা।
উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে মুহাম্মদ পেয়েছিলেন দাসী বারাকাকে। বিয়ের দিন তিনি তাকে মুক্ত করে দিলেন। বারাকা বিয়ে করে মদিনায় চলে গেলেন। সেখানে তার এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। নাম রাখা হলো আয়মন। উম্মে আয়মন নামে এরপর থেকে ডাকা হতো বারাকাকে। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ায় উম্মে আয়মন কিছুদিন পর মক্কায় ফিরে এলেন। মুহাম্মদ তখন জায়েদ ইবনে হারিসার সাথে তার বিয়ে দিলেন। সেখানেও তিনি পুত্রের জননী হলেন। পুত্রের নাম রাখা হলো ওসামা ইবনে জায়েদ।
বিয়ে ও ব্যবসায়িক সাফল্য তাকে মক্কার সমাজ জীবনে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আসীন করল। সেইসাথে সদাচারী দানশীল মানুষ হিসেবে হয়ে উঠলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই লাভ করত তার আতিথ্য। তিনি নিজের প্রয়োজনের বোঝা কখনো অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতেন না। কিন্তু অন্যের প্রয়োজন পূরণে সবসময় থাকতেন অগ্রগামী। সেবা নেয়ার পরিবর্তে সেবা দিতেই ছিলেন আগ্রহী। বঞ্চিতের প্রতি সমবেদনা ও সমমর্মিতা মিশে ছিল তার সারা অন্তর জুড়ে। এই সমমর্মিতা কতটা অন্তর্জয়ী ছিল, একটি ঘটনাই তা বোঝার জন্যে যথেষ্ট।
বিয়ের পর খাদিজা তাকে উত্তর আরবের কালব গোত্রের জায়েদ নামক এক কিশোর দাসকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। গোত্রীয় হানাহানির পরিণতিতে প্রতিপক্ষ জায়েদকে অপহরণ করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিন্তু পিতা হারিসা ইবনে সারাহিল পুত্র জায়েদকে খুবই স্নেহ করতেন। বহু অনুসন্ধানের পর পুত্রের খোঁজ পেয়ে ভাইকে সাথে নিয়ে তিনি মক্কায় উপস্থিত হলেন। পুত্রের বর্তমান মালিকের কাছে তারা যে-কোনো মূল্য দিয়ে পুত্রকে কিনে নেয়ার প্রস্তাব করলেন।
মুহাম্মদ তাদের কাছে পাল্টা প্রস্তাব দিলেন— দেখুন, কোনো মূল্য দিতে হবে না। আমি জায়েদকে আপনাদের সামনে ডাকব। সে যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, স্বাধীন মানুষ হিসেবে আপনাদের সাথে চলে যাবে। আর যদি আমার সাথে থাকতে চায়, তবে আমি তাকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করব। আপনারা কি এই প্রস্তাবে সম্মত? দুজনই একবাক্যে সম্মতি জানালেন। কারণ তারা নিশ্চিত ছিলেন জায়েদ তাদের সাথেই যাবে। মুহাম্মদ জায়েদকে ডাকলেন। জায়েদ এলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এদেরকে তুমি চেনো? জ্বী! জায়েদের উত্তর। একজন আমার পিতা আর একজন আমার চাচা। তখন তিনি বললেন, তুমি এখন মুক্ত। এদের সাথে কথা হয়েছে— তুমি ইচ্ছে করলে এদের সাথে যেতে পারো আবার ইচ্ছা করলে আমার সাথে থাকতে পারো। আমার সাথে থাকলে আমি তোমাকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করব।
বাবা ও চাচাকে হতবাক করে জায়েদ বলল, ‘আমি কাউকে আপনার ওপরে স্থান দিতে পারি না। আপনি আমার বাবা ও মা। আপনার কাছে আমি যে মমতা পেয়েছি, তাতে কাউকেই আপনার ওপরে স্থান দেয়া সম্ভব নয়। আমি এদের সাথে যাব না, আপনার সাথে থাকব।’ তিনি তখন কাবা চত্বরে নিয়ে গিয়ে জায়েদকে পালকপুত্র বলে ঘোষণা দিলেন। সামান্য ঘটনা! কিন্তু এ ঘটনাই বলে দেয় নবী হওয়ার আগেই নিপীড়িত-লাঞ্ছিতের কত নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
বিয়ের পর প্রথম সন্তান পুত্র কাশেমের জন্ম। তারপর চার কন্যা জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা। এরপর আরেক পুত্র আবদুল্লাহ। যদিও পুত্ররা শিশুকালেই মারা যায়। তারপরও পালকপুত্র জায়েদ ও চার কন্যা নিয়ে পয়মন্ত সংসার। পতিপ্রাণা স্ত্রী। পয়মন্ত সংসারে যুক্ত হলো পাঁচ বছর বয়সী চাচাতো ভাই আলী। চাচা আবু তালিবের ব্যবসায় তখন মন্দাবস্থা। বড় সংসার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তখন মুহাম্মদের প্রস্তাব অনুসারে ধনাঢ্য চাচা আব্বাস দায়িত্ব নিলেন আবু তালিবের এক পুত্র জাফরের। আর তিনি নিজে নিলেন আরেক পুত্র আলীর দায়িত্ব। ফলে অনেকটা নির্ভার হলেন আবু তালিব।
উপচে পড়া ব্যবসায়িক সাফল্য। ঈর্ষণীয় সামাজিক মর্যাদা। মক্কার তৎকালীন সমাজে পার্থিব সাফল্যের শিখরে তখন তার অবস্থান। তারপরও তিনি হারিয়ে যেতে শুরু করলেন ভাবনার রাজ্যে। জীবন, জীবনের পরিণতি আর চারপাশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হিংসা, অসহিষ্ণুতা, অমানবিকতা থেকে মুক্তির চিন্তা তাকে নিয়ে যেত মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে জাবলে নূরের হেরা গুহায়। যেখান থেকে দেখা যেত কাবা। তিনি সেখানে বসে হয়তো তাকিয়ে থাকতেন কাবার দিকে, কিন্তু ডুবে যেতেন গভীর ধ্যানে, মানুষের দুঃখ থেকে মুক্তির ভাবনায়। সুযোগ পেলেই তিনি চলে যেতেন হেরা গুহায়। আর প্রতি রমজানে সেখানে তিনি পুরো মাসই থাকতেন ধ্যানে নিমগ্ন।
প্রবল ঝড়সৃষ্ট বর্ষণের পানিতে ধসে গেল কাবাঘর। কোরাইশের সব গোত্র মিলে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করল। গণ্ডগোল বাঁধল ‘হাজরে আসওয়াদ’ নিয়ে। পুনর্নির্মিত কাবাঘরে পবিত্র পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’ যথাস্থানে স্থাপনের মর্যাদা লাভের জন্যে সব গোত্র তখন সংঘাতের মুখোমুখি। সশস্ত্র অবস্থায় কাবা চত্বরে চার দিন ধরে অবস্থানরত গোত্রনেতারা আপস আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিলেন—আগামীকাল ভোরবেলা ‘আল সুফফা’ দ্বার দিয়ে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কাবায় প্রবেশ করবে তাকেই তারা সালিশ মানবেন।
হেরা গুহা থেকে কয়েক দিনের নির্জনবাস ও ধ্যান শেষে ঘরে ফেরার পথে পরদিন ভোরবেলা মুহাম্মদ সে-দ্বার দিয়েই কাবায় প্রবেশ করলেন। সবাই তাকে একবাক্যে সালিশ হিসেবে মেনে নিলেন। ভাবলেন নিশ্চয়ই এখন সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান বেরুবে। মুহাম্মদ গোত্রপতিদের একটি চাদর আনতে বললেন। চাদর আনা হলে তিনি পাথরটি চাদরের ওপর রাখলেন। সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরে পাথরটি যথাস্থানে নিয়ে যেতে বললেন। যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই চাদর ধরে পাথরটি উঁচুতে তুলে ধরলেন। এরপর তিনি নিজ হাতে পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করলেন।
এভাবে একটা দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলো। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধংদেহী প্রতিপক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনে তার দক্ষতার প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সেইসাথে এও বুঝলেন, গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব বহাল রাখার জন্যে কোরাইশরা কাবা প্রাঙ্গণেই পরস্পরকে হত্যা করার কত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
এনএস/