ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৩, ৩ মে ২০২০

পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। আর তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে, তারপর প্রকাশ্যে। আজ চতুর্থ পর্বে আপনারা জানবেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। 
 
বেনিয়া কোরাইশ চক্র যথার্থই বুঝতে পেরেছিল কোরআন বিশ্বাস করলে, পরকালে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করলে মানুষ অন্যায় পাপাচার থেকে দূরে সরে যাবে। সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে তাদের ওপর শোষণ ও কর্তৃত্ব করা যাবে না। তাই যে করেই হোক মানুষকে মুহাম্মদের (স) বাণী থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পৌত্তলিকতায়— পিতৃপুরুষের ধর্মে। প্রতিটি গোত্র তাদের মুসলিম সদস্যদের পিতৃধর্ম পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে আনার জন্যে শুরু করল নিপীড়ন নির্যাতন। সকল ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতনের প্রথম শিকার হলো সমাজের দাস ও বঞ্চিত মানুষেরা।

বেলালের ঘটনা থেকে বোঝা যায় তাদের বিশ্বাসের পরীক্ষা ছিল কতোটা নির্মম-নিষ্ঠুর। উমাইয়া ইবনে খালাফ জানতে পারলেন যে, তার হাবশি ক্রীতদাস বেলাল ইবনে রাবাহ পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে গোপনে মুসলমান হয়ে গেছে। তখন তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা— কতভাবে নির্যাতন করলে সে পথে আসবে। প্রথম সে খেজুর গাছের ছাল দিয়ে বানানো শক্ত দড়ি বেলালের গলায় লাগিয়ে বখাটে কিশোরদের হাতে ছেড়ে দিল চতুষ্পদ ভারবাহী পশুর মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। উচ্ছৃঙ্খল কিশোররা বেলালকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তা দিয়ে এদিক-সেদিক নিয়ে যেতে লাগল। শরীরের ত্বক-মাংস ছিলে গেল। এতেও কাজ না হওয়ায় আহত রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে খাবার-পানি ছাড়া বেঁধে রাখা হলো। কয়েকদিন এভাবে গেল।

তারপর একদিন দুপুরের রোদে ‘রামাদা’ নামক মরুতে আগুনের মতো তপ্ত বালুতে বেলালকে চিৎ করে শোয়ানো হলো। তার বুকের ওপর চাপানো হলো বিশাল পাথর। বলা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করে লাত ও উজ্জার উপাসনা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই তপ্ত মরুতে পাথরচাপা হয়ে সিদ্ধ হতে থাকবে। কিন্তু বেলাল তখনও কোনো রকমে ডান হাতের তর্জনী ইশারা করে জড়িত কণ্ঠে শুধু বলেছেন— আহাদ! আহাদ! আল্লাহ এক! আল্লাহ এক! তার বিশ্বাস জয় করে ফেলেছিল সকল শারীরিক যন্ত্রণা। বিস্মিত ক্ষুব্ধ হতাশ উমাইয়া দাঁড়িয়ে ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। এমন সময় আবু বকর সেখানে এসে হাজির হলেন। তিনি উমাইয়ার কাছ থেকে বেলালকে কিনে নিলেন। তাকে মুক্ত করে দিলেন গোলামী থেকে। বেলাল এরপর থেকে আজীবন ছিলেন রসুলের সঙ্গী।

বিশ্বাসীদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চলেছে সমানতালে। যখন যার ওপর যেভাবে চালানো সম্ভব। এ-ক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের অনেকের মা-বাবাও পিছিয়ে ছিলেন না। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নির্যাতক ছিলেন তার মা। মা কড়া পৌত্তলিক ছিলেন। তিনি শারীরিক নির্যাতন করেন নি। কিন্তু চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন। সাদ ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। মা যখন জানতে পারলেন ছেলে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তখন তিনি শপথ করে বললেন, ‘সাদ! তুমি আমার ধর্মে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি পানাহার করব না। আমি না খেয়ে মারা যাব। তখন তুমি অভিহিত হবে মাতৃহন্তাকারীরূপে।’

সাদ বললেন, ‘মা আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু কোনোকিছুই আমাকে আমার ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।’ অনাহারের প্রথম দিন পার হলো। পরদিন সকাল। মা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় দিনও পার হলো। মা অনাহারে আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন। একইভাবে তৃতীয় দিন পার হলো। চতুর্থ দিন সকালে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছেন। সাদ মায়ের বিছানায় বসে বললেন, মা! আল্লাহর শপথ! তোমার যদি একশটা জীবন থাকে এবং প্রতিবারই তুমি না খেয়ে মারা যাও তবুও আমি আমার ধর্মত্যাগ করব না। এখন তুমি এই খাবার ইচ্ছা হলে খেতে পারো। ইচ্ছা না হলে খাবে না। তখন তিনি খাবার গ্রহণ করলেন।

নিঃসন্দেহে সাদের পরীক্ষা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু তিনি তার বিশ্বাসের সাথে আপস করতে অস্বীকৃতি জানান। এই প্রেক্ষাপটে আয়াত নাজিল হয় - ‘আমি মানুষকে বাবা-মার সাথে সম্মানজনক আচরণ ও খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু তারা যদি আমার সাথে উপাস্য হিসেবে কোনোকিছুকে শরিক করার জন্যে চাপ দেয়, তবে তা কখনো মানবে না।’ (সূরা আনকাবুত: ৮)

এদিকে, বনু মাখজুম গোত্র ক্রীতদাস আম্মার, তার বাবা ইয়াসির ও তার মা সুমাইয়াকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে আনার জন্যে ‘রামাদার’ তপ্ত মরুতে নিয়ে গেল।  আম্মারকে খালি গায়ে লোহার পাতের বর্ম পরিয়ে তপ্ত মরুতে শোয়ানো হলো। তার ত্বক ও মাংসপেশীতে সাথে সাথে ফোসকা পড়ে গেল। একই নির্যাতনের শিকার হলো পুরো পরিবার। কিন্তু তাদের বিশ্বাসে কোনো ফাটল ধরে নি। নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরও সুমাইয়াকে বিশ্বাসচ্যুত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভে ক্রুদ্ধ হয়ে আবু জেহেল বর্শা দিয়ে বুকে আঘাত করে তাকে হত্যা করল। শহিদ হলেন সুমাইয়া, একজন নারী হয়েই ইসলামের প্রথম শহিদ তিনি। 

মক্কার কর্মকার খাব্বাব ইবনে আল আরাতকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে চু্ল্লি থেকে তোলা জ্বলন্ত কয়লার ওপর হাত পা বেঁধে শোয়ানো হলো। একজন তার বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে রাখল। খাব্বাবের মাংস রক্ত ও চর্বি গলে আগুন নিভে গেল। এ ঘটনার ২৭ বছর পর খলিফা ওমর একদিন তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন তার ওপর নির্যাতন সম্পর্কে। খাব্বাব শুধু জামা তুলে পিঠ দেখিয়েছিলেন। পিঠের পোড়া গর্তগুলো দেখে ওমর গভীর বেদনাহত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে এমন নিষ্ঠুরতা দেখিনি!’ মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারী দাস ও সহায়হীনদের ওপর নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন তখন হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা।

নির্মম নির্যাতন সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বাড়তে লাগল। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ করছে। শুধু বঞ্চিতদের মধ্য থেকেই নয়, অভিজাত পরিবারগুলোর ভালো মানুষরাও ঝুঁকে পড়ল ইসলামের দিকে। অভিজাত পরিবার থেকে নবীজীর অনুসারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে শোষকশ্রেণি প্রমাদ গুণলো। মুসলমানরা একত্র হলে তাদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এদের সমূলে বিনাশ করার জন্যে চরমপন্থা গ্রহণে অন্যদের প্ররোচিত করতে শুরু করল। 

নবীজী তখন অনুসারীদের একটা বড় অংশকে আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইরিত্রিয়া) প্রেরণের এক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমত, চরমপন্থী বিরোধীদের উদ্বেগ কমানো। হিজরতের ফলে মক্কায় মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাবে। ফলে বিরোধীরা অবশিষ্টদের কোনো হুমকি মনে করবে না। দ্বিতীয়ত, মক্কার বাইরে সত্যধর্মের অনুশীলন ও প্রচারের জন্যে একটি নিরাপদ কেন্দ্র স্থাপন। সাধারণভাবে মনে করা হয়, দৈহিক নির্যাতনের হাত থেকে সামাজিকভাবে দুর্বল অনুসারীদের জীবন রক্ষাই ছিল এই হিজরতের উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রাথমিকভাবে হিজরতকারীদের তালিকার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, শুধু জীবন রক্ষা নয়, মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন ভূখন্ডে চেতনার বিস্তার। 

এই তালিকায় ছিলেন- উমাইয়া গোত্রের উসমান ইবনে আফফান, আবদ শামস গোত্রের আবু হুজাইফা ইবনে উতবা- যার পিতা ছিলেন মক্কার একজন গোত্রপ্রধান, আসাদ গোত্রের আল জুবাইর ইবনে আওয়াম, জোহরা গোত্রের আবদুর রহমান ইবনে আউফ, মাখজুমি গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে আবদ আল আসাদ, ফিহির গোত্রের সুহাইল ইবনে ওয়াহাব, আবদ আল দর গোত্রের মুসআব ইবনে উমাইর, হাশিম গোত্রের জাফর ইবনে আবু তালিব। এরা সবাই ছিলেন কোরাইশ বংশীয়। এদের পরিবার মক্কার ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তখনকার আরবের গোত্রীয় রীতি অনুসারে দাস ও গরিবদের ওপর যে অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন করা সহজ তা এদের ওপর করা তত সহজ ছিল না।

নবীজীর পরামর্শে নির্বিঘ্নে ধর্মপালনের প্রত্যাশায় উসমান ইবনে আফফান প্রথম হিজরতকারী হিসেবে মক্কা ত্যাগ করেন। সাথে ছিলেন তার স্ত্রী নবীকন্যা রুকাইয়া। এ দলে উসমান ইবনে মাজউন, আমির ইবনে রাবিয়া ও তার স্ত্রী লায়লা, উম্মে সালমা, মুসআব ইবনে উমাইর, আবু সাবরা, আবু হুজাইফা ও তার স্ত্রী শাহলা, আবু সালামা, জুবাইর ইবনে আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ-সহ ছিলেন ১৫ জন। দলনেতা ছিলেন উসমান ইবনে মাজউন। পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মোট ৮২ জন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তিনি হিজরতকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা এমন এক দেশে যাচ্ছ, যেখানকার রাজা কারো উপর অবিচার করেন না। তাঁর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি চারপাশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবেই খোঁজখবর রাখতেন।

আবিসিনিয়ার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বড় দলটি হিজরত করে জাফর ইবনে আবু তালিবের নেতৃত্বে। কোরাইশরা এদের ফেরত আনার জন্যে আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে শক্তিশালী প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসীর দরবারে। রাজ দরবারে রাজার প্রশ্নের জবাবে জাফর ইবনে আবু তালিব মুসলমানদের ওপর কোরাইশদের নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ‘মহামান্য রাজা! নিকট অতীতে আমরা মূর্খ ছিলাম। আমরা মূর্তিপূজা করতাম। যে-কোনো মৃত প্রাণীর মাংস খেতাম। সব ধরনের পাপাচারে নিমজ্জিত ছিলাম। আত্মীয়তার সম্পর্ক খুব সহজেই ছিন্ন করতাম। প্রতিবেশীদের সাথে মন্দ আচরণ করতাম। সবলরা দুর্বলের সম্পত্তি হজম করে ফেলতাম। আমাদের রীতি ছিল জোর যার মুল্লুক তার।

জাফর ইবনে আবু তালিব বলেন, আমাদের এই অধঃপতিত অবস্থায় আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকেই একজনকে নবী হিসেবে পাঠালেন। তাঁর সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আমরা পূর্ব থেকেই জানতাম। তিনি আমাদেরকে এক আল্লাহর উপাসনা করতে বললেন। তাই আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সকল উপাস্যকে বর্জন করলাম। শুধু এক আল্লাহকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করলাম। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন, তোমরা সত্য কথা বলবে। আমানত রক্ষা করবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত রাখবে। প্রতিবেশীদের প্রতি সমমর্মী আচরণ করবে। অন্যায় রক্তপাত থেকে দূরে থাকবে। পরকীয়া-ব্যভিচার ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে। এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। সতী নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারে লিপ্ত হবে না। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা শুধু এক আল্লাহরই উপাসনা করবে। আর কোনোকিছুকে উপাস্য বানাবে না।’ তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করবে। নিয়মিত দান করবে। রোজা রাখবে। ...’

জাফর আরো বলেন, ‘আমরা তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আমরা আল্লাহর প্রেরিত ধর্ম অনুসরণ শুরু করলাম। তিনি আমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা আমরা বর্জন করলাম। আর তিনি যা বৈধ করেছেন তা করণীয়রূপে গ্রহণ করলাম। এরপর আমাদের স্বগোত্রীয়রাই আমাদের সাথে শত্রুতা শুরু করল। আল্লাহর পরিবর্তে আগের মতোই মূর্তিপূজায় ফিরে যাওয়া, আগের মতোই সকল অনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করার জন্যে তারা সকল ধরনের বর্বর নির্যাতন শুরু করল। তখন আমাদের নবী নির্দেশ দিলেন আপনার দেশে আশ্রয় নেয়ার জন্যে। মহানুভব রাজা! আমরা বিশ্বাস করি আপনার কাছে আমরা আশ্রয় ও সুবিচার পাব।’

রাজা নাজ্জাসী কোরাইশদের হাতে হিজরতকারীদের প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। হিজরতকারীরা আবিসিনিয়ায় বসবাস, ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের কাজে মনোযোগী হলেন। সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই তারা অনেক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন। জাফর অবশ্য তার মিশনের কাজ সমাপ্ত করে সদলবলে আবিসিনিয়ান মুসলমানদের নিয়ে খায়বরের যুদ্ধের পর মদিনায় ফিরে আসেন।

আবু জেহেল একদিন চলতি পথে নবীজীকে পেয়ে আচ্ছামতো গালিগালাজ ও লাঞ্ছিত করেন। নবীজী কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ স্থান ত্যাগ করেন। নবীজীর চাচা ও দুধভাই হামজা সেদিন শিকার শেষে ঘরে ফিরছিলেন। হামজা ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও শিকারি। শিকার শেষে তিনি সবসময় কাবায় উপাসনা করে বাড়ি ফিরতেন। সেদিন কাবার প্রবেশপথে এসেই ঘটনা শুনে ক্ষুব্ধ হলেন। কাবা প্রাঙ্গণে ঢুকেই আবু জেহেলকে সামনে পেয়ে ধনুক দিয়ে আঘাত করলেন। তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়ে আবু জেহেলকে বললেন, সাহস থাকলে এবার আমাকে আঘাত করো। আবু জেহেল তখন ভয়ে নিশ্চুপ। এটি নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।

হামজার ইসলাম গ্রহণের তিন দিন পর ওমর বিন খাত্তাব নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ছুটলেন নবীজীকে হত্যা করার জন্যে। ওমর ছিলেন শক্তিমান ও আবেগপ্রবণ মানুষ। রাজা নাজ্জাসী মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ায় তার ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছিল। তিনি কোরাইশদের সব সমস্যার মূল হিসেবে নবীজীকে চিহ্নিত করলেন। তিনি ভাবলেন, তাঁকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। খবর পেলেন, নবীজী তাঁর অনুসারীদের সাথে সাফা এলাকার একটি ঘরে বৈঠক করছেন। তাই ওমর নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে ছুটলেন সে-দিকে। পথে নুয়াম ইবনে আবদুল্লাহর সাথে দেখা।  নুয়াম তার অভিপ্রায় জানতে পেরে বললেন, ‘ওমর আত্মপ্রতারণা কোরো না। আগে তো ঘর সামলাও।’

নুয়ামের কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন ইতোমধ্যেই তার বোন ফাতেমা ও বোনের স্বামী সাঈদ ইবনে জায়িদ মুসলমান হয়ে গেছে। ওমর এবার ছুটলেন বোনের বাড়ির দিকে। ঘরে ঢুকতে গিয়েই শুনলেন কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে। ওমরের আওয়াজ পেয়েই তারা কোরআন ও তেলাওয়াতরত অতিথি দুজনকেই লুকিয়ে ফেললেন। যা পড়া হচ্ছিল সেই কোরআন চাইলেন ওমর। ফাতেমা ও সাঈদ তেমন কোনোকিছুর কথা অস্বীকার করলেন। ওমর রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে সাঈদকে মারতে শুরু করলেন। স্বামীকে বাঁচাতে দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন ফাতেমা। ফাতেমার মাথায় আঘাত লাগল। রক্তাক্ত হয়ে গেল মাথা। রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনের মন থেকে সকল ভয় উবে গেল। একসাথেই দুজন বলল— ঠিক, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি। তুমি যা পারো করো। দুজনের সাহস ও বোনের রক্তমাখা চেহারা দেখে ওমর ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ালেন। 

একটু শান্ত হওয়ার পর ওমর বললেন, ঠিক আছে। যা পড়ছিলে আমাকে দাও। পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ার পর ওমর পড়তে শুরু করলেন। ওমর মুগ্ধ হলেন। তার ভাবান্তর হলো। সেখান থেকেই তিনি রওনা করলেন আস সাফা এলাকায় আরকাম-এর ঘরে। নবীজীর সামনে এসে ইসলাম গ্রহণ করার ঘোষণা দিলেন। হামজার পর পরই ওমরের ইসলাম গ্রহণ মক্কার সামাজিক সমীকরণে একটা ঝাঁকুনি সৃষ্টি করল। এতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা সব ধরনের ইবাদত করত গোপনে, মক্কা থেকে দূরে গিয়ে। এবার তারা সাহসী হয়ে উঠল। কাবাঘরের সামনেই নামাজ পড়তে শুরু করল। বিশ্বাসের জন্যে আরো ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুতি ও প্রত্যয় দুটোই বেড়ে গেল।

শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ কোরাইশরা ইসলামের প্রভাব বলয় নাশের জন্যে, আরবের মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার জন্যে শুরু করল নতুন ও নির্মম চক্রান্ত। তারা বুঝল- শুধু অপপ্রচার ও নির্যাতন দ্বারাই ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। এদেরকে কঠোরভাবে একঘরে করতে হবে। কঠোর অবরোধ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট। নবুয়তের সপ্তম বছরে কোরাইশরা আরবের সব গোত্রের সাথে লিখিত চুক্তি করল যে, কেউ মুসলমান এবং বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের সাথে সামাজিক যোগাযোগ, বিয়ে-শাদি, বেচাকেনা করবে না। কোনো ধরনের খাদ্য বিক্রি করবে না। সকল পক্ষ স্বাক্ষরিত দলিল খুব যত্নের সাথে কাবাঘরে সংরক্ষণ করা হলো।

আবু তালিবের সাথে গোত্রের সবাই শিয়াবে আবু তালিবের পাহাড়ি উপত্যকায় আশ্রয় নিল (শুধু আবু লাহাবের পরিবার ছাড়া)। মক্কার বিভিন্ন স্থানের মুসলমানরাও সেখানে জড়ো হলো। শিয়াবে আবু তালিবের অবরুদ্ধ জীবন ছিল তিন বছর। অবর্ণনীয় দুর্দশা ও কষ্ট। কোরাইশরা তাদের জ্ঞাতসারে কাউকে কোনো খাবার নিয়ে সেখানে যেতে দিত না। শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করত। সেই চিৎকার মক্কা থেকেও শোনা যেত।

দুর্দশা কত চরমে ছিল তা সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস-এর একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, আমি এক রাতে পেশাব করার জন্যে বাইরে এসেছি। পেশাব করছি। একটু ভিন্ন ধরনের শব্দ পেলাম। চাঁদের আলোয় ভালো করে তাকালাম। দেখি, উটের এক টুকরো শুকনো চামড়া। আমি তুলে নিলাম। পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আগুনে ভালো করে ঝলসে পরে পানিতে ভিজিয়ে জীর্ণ করে খেলাম। পরবর্তী তিন দিনের জন্যে এটাই ছিল আমার খাবার। অবরোধের শেষের কয়েক মাস গাছের পাতা, ছালবাকল ও ময়লা পানি ছাড়া তাদের অধিকাংশেরই খাওয়ার তেমন কিছুই ছিল না। তাদের কারোরই চেহারা তখন চেনা যেত না।

এমনি ঘোর দুঃসময়ে একদিন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দিব্যদৃষ্টিতে নবীজী দেখতে পেলেন যে, আল্লাহর পাঠানো উঁই পোকা চুক্তিপত্রের সবটুকুই খেয়ে ফেলেছে শুধু ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা’ শব্দটি ছাড়া। এই কথা শুনে আবু তালিব কোরাইশদের কাছে গেলেন। কোরাইশরা তাকে দেখে উল্লসিত হয়ে উঠল— নিশ্চয়ই এবার আত্মসমর্পণ করতে এসেছে। কিন্তু তিনি তাদেরকে বললেন, দেখ আমার ভাতিজা দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছে, তোমাদের চুক্তিপত্র পোকায় খেয়ে ফেলেছে, শুধু আল্লাহর নামটুকু ছাড়া। তার কথা যদি সত্য হয় তবে তোমরা বয়কট তুলে নেবে। আর যদি মিথ্যা হয় তবে আমি আমার ভাতিজাকে তোমাদের হাতে তুলে দেবো।

পার্চমেন্ট কাগজে লেখা চুক্তিপত্রটি তিন স্তরে মোহরকৃত ছিল। সংরক্ষণের পর এটি কেউ দেখেওনি, স্পর্শও করেনি। অতএব চুক্তিপত্রটি কোনোভাবেই নষ্ট হতে পারে না মনে করে অবিশ্বাসীরা সাথে সাথে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। আবু তালিবকে সাথে নিয়ে আবু জেহেলের নেতৃত্বে পৌত্তলিকরা কাবায় প্রবেশ করল। যখন চুক্তিপত্রের সিলগালা খোলা হলো সবাই বিস্ময়ে হতবাক। পুরো চুক্তিপত্র পোকায় খেয়ে ফেলেছে শুধু ‘আল্লাহুমা বিসমিকা’ শব্দ দুটি ছাড়া। সব দেখে আবু জেহেল প্রথমে কেটে পড়তে চাইল। কিন্তু যখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য গোত্রপতিরা চাপ দিল— এখন যেখানে চুক্তিপত্রই নেই বয়কট থাকারও কোনো যুক্তি নেই। তাই বয়কটের অবসান হোক। অগত্যা বয়কট উঠে গেল। মুসলমানরা মনে করল, এবার শুরু হবে তাদের সুসময়।

তিন বছরের দুঃসহ অবরোধ অবসানে কোরাইশ গোত্রভুক্ত হিশাম ইবনে আমর, জুহায়ের ইবনে আবু উমাইয়া, আল মুতিম ইবনে আদী, জামাহ ইবনে আল আসওয়াদ ও আবুল বখতারী ইবনে হিশাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের সদস্যরা নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করল। মুসলমানরাও ফিরে গেল যার যার এলাকায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ কিছুটা স্বাভাবিক হলো। প্রতিপক্ষের নির্যাতনের মুখে অহিংস প্রতিরোধ অর্থাৎ সকল নির্যাতন সহ্য করেও নিজ বিশ্বাসে অটল থাকা এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো সহিংস পদক্ষেপ না নেয়ার নীতির সার্থকতা ও কার্যকারিতা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হলো। 

কোরাইশদের বয়কটের কারণে নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি আরবের সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও আগ্রহ বেড়ে গেল। শুধু মক্কায় নয়, দুর্গম মরু অঞ্চলেও ছড়িয়ে যেতে থাকল শাশ্বত ধর্মের বাণী। অবরোধের অবসানে দূরদূরান্ত থেকে ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা বেড়ে গেল। কোরাইশরা অবরোধের লক্ষ্য অর্জনে শুধু পুরোপুরি ব্যর্থই হয় নি। বরং অবরোধ উল্টো ইসলাম সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলকেই বাড়িয়ে দিল। তবে বাণী ছড়িয়ে পড়লেও নির্যাতন ও আঘাত থেকে অনুসারীদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। তবুও নবীজী প্রতিটি সুযোগই গ্রহণ করেছেন আল্লাহর বাণী প্রচারে।

অবরোধ মুক্তির পর এক ধরনের স্বস্তির আবহ কাটতে না কাটতেই ঘটল এক বিয়োগান্তক ঘটনা। সকল বিপদ-আপদ ও প্রতিকূলতার মুখে মুহাম্মদকে (স) ‘সুরক্ষা’ প্রদানকারী চাচা আবু তালিব মারা গেলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। আবু তালিবের মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে ঘটল নবীজীবনের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনাটি। তাঁর ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি-আনন্দের সাথি, নবুয়তের মুহূর্ত থেকে সকল সংগ্রামের সহযোদ্ধা, সকল নিপীড়নের সমব্যথী, সকল কল্যাণকর্মে সমমর্মী খাদিজা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। এই বুদ্ধিমতি, সুন্দরী ধনী নারী সকল সম্পদ ব্যয় করেছেন স্বামীর ধর্মপ্রচারে। অবরুদ্ধ জীবনে অর্ধাহার, অনাহারে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। অবরোধমুক্ত হলেও তিন বছরের কষ্টের ধকল আর সামলে উঠতে পারেন নি। 

নবীজী আমৃত্যু খাদিজাকেই ভালবাসতেন। তিনি তাকে উল্লেখ করেছেন ভূপৃষ্ঠে আগমনকারী চার জন আলোকিত নারীর একজন হিসেবে। অপর তিন জন হচ্ছেন হজরত মুসা (আ:)-এর জীবন রক্ষাকারী ফেরাউন পত্নী আসিয়া, ঈসা (আ:)-এর মাতা মরিয়ম এবং নবী (স)-এর দুহিতা ফাতেমা। 

নবুয়তের দশম বছর কার্যত হয়ে উঠল শোকের বছর। একদিকে পারিবারিক বিয়োগব্যথা, অপরদিকে সুরক্ষাদাতার বিদায়ে অবিশ্বাসীদের তরফ থেকে নতুন হুমকির মুখে তিনি মক্কার বাইরে ধর্মপ্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাবলেন, মক্কার বাইরে যদি বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়, তাহলে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি হবে, যা মক্কায় অবস্থানরত বিশ্বাসীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। তাই তিনি একদিন গোপনে শুধু জায়েদকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে ১১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত তায়েফে পৌঁছলেন।

বাগানবেষ্টিত শহর তায়েফের বাজারে যখন তারা পৌঁছলেন তখন সেখানে মজলিস জমে গেছে। নবীজী সেখানে সত্যধর্মের কথা বলা শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সাকিফ গোত্রের অভিজাত কয়েকজন শুরু করল গালিগালাজ। তায়েফ থেকে তাঁকে বিতাড়িত করার জন্যে লেলিয়ে দিল দাস ও বখাটে ছেলেদের। বখাটেরা ঢিল ও পাথর মারতে মারতে তাড়া করল তাঁদের। তাদের নিক্ষিপ্ত ঢিল ও পাথরের আঘাতে নবীজী রক্তাক্ত হলেন। 

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তায়েফের অভিজাতরা নবীজীর ব্যাপারে এত মারমুখী হলো কেন? কারণ তারা ছিল কোরাইশদের মতোই অর্থপূজারি ও ভোগবাদী। তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ছিল মক্কা। আর কোরাইশদের অবকাশযাপনের কেন্দ্র ছিল তায়েফ। মক্কার মক্কেলদের তুষ্ট রাখার জন্যেই এই নিষ্ঠুরতা। নবীজীকে ঢিল থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে জায়েদ নিজেও আহত হলেন। শেষ পর্যন্ত তারা কোনোরকম দৌড়ে হেঁচড়ে শহরের উপকণ্ঠে এক বাগানের দেয়ালের পাশে বসে পড়লেন।

নবীজী কিছু সময় হারিয়ে গেলেন তন্ময়তার ভুবনে। একটু স্থির হয়ে আবেগভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রার্থনা করলেন— ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি আমার দুর্বলতার, উপকরণহীনতার ও আমার ওপর করা অন্যায়ের। হে করুণানিধান! তুমি দুর্বল ও মজলুমের মালিক! তুমি আমারও প্রভু! আমাকে কার হাতে ছেড়ে দেবে? দূরবর্তী কোনো বিরুদ্ধভাবাপন্নের হাতে? অথবা এমন শত্রু যাকে তুমি আমার ওপর শক্তিমান করেছ? তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হয়ে থাকো তবে যে-কোনো পরিণতির মুখোমুখি হতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আমি শুধু তোমার সন্তুষ্টিই চাই। তোমার দয়া চাই। আমি তোমার ওপর বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত থাকতে চাই, যা ইহকাল ও পরকালের সব অন্ধকার দূর করে দেবে। আমি তোমার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করছি। সকল ক্ষমতা ও শক্তির উৎস তো তুমিই!’ 

চরম এই দুঃখ ও যন্ত্রণাকাতর মুহূর্তে জিবরাইল আল্লাহর বাণী নিয়ে এলেন। বললেন, আপনি বললে পুরো তায়েফকেই পাহাড়সহ উল্টে ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু এভাবে নির্যাতিত হয়েও নবীজী তৎক্ষণাৎ বললেন, না! না! এই অবাধ্যদের মধ্য থেকেই একদিন হয়তো এমন প্রজন্মের উদ্ভব ঘটবে, যারা এক আল্লাহর উপাসনা করবে। আসলে দুঃখ ও যন্ত্রণাকাতর মুহূর্তেও সাফল্য আসতে পারে, যদি আল্লাহ চান। নবীজী যখন বাগানে বিশ্রামরত তখন বাগানের মালিক মক্কার উতবা ও শায়বা দূর থেকে তাঁর অবস্থা দেখছিল। তারা সহানুভূতি পরবশ হয়ে তাদের খ্রিষ্টান দাস আদ্দাসকে দিয়ে একটি প্লেটে এক থোকা আঙুর খাওয়ার জন্যে পাঠাল। পাঠানোর সময় দাসকে সতর্ক করে দিল। খবরদার! ঐ লোকটির কথায় কান দিও না। তাহলে তোমার ধর্ম নাশ হবে। কিন্তু নবীজী ‘বিসমিল্লাহ’ বলে একটা আঙুর মুখে তুলতেই আদ্দাস তাঁকে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করল। উত্তরে মুগ্ধ হয়ে আদ্দাস সত্যধর্ম গ্রহণ করে নবীজীর মাথায়, হাতে ও পায়ে চুমু খেল। 

তায়েফ থেকে দীর্ঘ ফেরত যাত্রায় তিনি নাখলায় থামলেন। কয়েকদিন সেখানে অবস্থানকালে তিনি জানতে পারলেন যে, তায়েফে তাঁর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার খবর মক্কায় বিরোধীপক্ষের কাছে চলে গেছে। এখন মক্কায় কোনো ‘সুরক্ষা’ ছাড়া প্রবেশ করা বোকামি। কারণ চাচা আবু তালিবের পর বনু হাশিম গোত্রপ্রধান হন চাচা আবু লাহাব। আর আবু লাহাব ইতোমধ্যেই গোত্রপ্রধান হিসেবে নবীজীকে প্রদত্ত ‘সুরক্ষা’ প্রত্যাহার করেছেন। তিনি তখন হেরা গুহায় আত্মগোপন করলেন। খুজাহ গোত্রের উরাইকিজকে দূত হিসেবে পাঠালেন মক্কায়। প্রথমে জুহরা গোত্রের আল আখনাস ইবনে শরীক এবং পরে আমির গোত্রপ্রধান সুহাইল ইবনে আমর এর কাছে। তারা ‘সুরক্ষা’ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। 

নওফাল গোত্রপ্রধান আল মুতিম ইবনে আদীর কাছে আবেদন করলে তিনি ইতিবাচক সাড়া দিলেন। তিনি পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রসহ সশস্ত্র অবস্থায় কাবাঘরে এসে নবীজীর ‘সুরক্ষার’ ঘোষণা দিলেন। নবীজী কাবা তাওয়াফ শেষে নিজ ঘরে ফিরে গেলেন। নবীজীকে প্রাণে শেষ করার এক সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আবু জেহেল হতাশ হলেন। নবীজীও বুঝতে পারলেন, নিজ গোত্র বনু হাশিমের পক্ষ থেকে তাঁর ‘সুরক্ষার’ ব্যাপারে কোনোভাবেই নির্ভর করতে পারবেন না। এই ঘটনায় নবীজী আল মুতিম ইবনে আদীর প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ ছিলেন তা বোঝা যায় বদর যুদ্ধের পর কোরাইশদের ৭০ জন বন্দির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, আজকে যদি মুতিম ইবনে আদী বেঁচে থাকতেন এবং তোমাদের জন্যে সুপারিশ করতেন তা হলে তোমাদের সবাইকে আমরা কোনো পণ ছাড়াই মুক্তি দিয়ে দিতাম। তায়েফের ঘটনার প্রেক্ষিতে নবীজী সিদ্ধান্ত নিলেন, বাণী গ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে আপাতত মক্কার বাইরে যাবেন না। 

চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর শোক, কোরাইশদের চরম বিরোধিতা আর তায়েফের নির্মম প্রত্যাখ্যান। নবীজীবনে বিষণ্নতার এক চরম লগ্নে ঘটল এক অভাবিত ঘটনা—অস্তিত্বের ভিন্ন মাত্রা দর্শন। সে-রাতে তিনি ঘুমিয়েছিলেন চাচাতো বোন উম্মে হানীর বাড়িতে। জিবরাইল এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিয়ে গেলেন কাবাঘরের সামনে। সেখান থেকে দুজন ‘বোরাক’-এ (বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন বাহন) চড়ে নিমেষে পৌঁছে গেলেন জেরুজালেম-এর মসজিদে আকসায়। সেখানে তিনি অতীতের মহান নবীদের সম্মিলিত নামাজে ইমামতি করলেন। এরপর তাঁর সামনে দুটি পানপাত্র আনা হলো। একটিতে ছিল দুধ। অপরটিতে মদ। তিনি দুধের পাত্র গ্রহণ করে দুধ পান করলেন। তখন জিবরাইল বললেন, ‘আপনি আপনার উম্মাহর জন্যে সঠিক পথ গ্রহণ করেছেন। মদের পাত্র গ্রহণ করলে আপনার উম্মাহ পুরোপুরি উচ্ছন্নে যেত।’

জেরুজালেমের পর্ব শেষ করে সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করলেন। একের পর এক জান্নাত ভ্রমণ করলেন। প্রত্যেক জান্নাতেই আদম, ইব্রাহিম, নূহ, মুসা, ঈসা, ইউনুস, ইউসুফ প্রমুখ মহান নবীদের কারো না কারো সাথে সাক্ষাৎ হলো, যারা মানবজাতিকে এক স্রষ্টার উপাসনার ডাক দিয়েছেন। তিনি এই ভ্রমণে, অপরাধের জন্যে যারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের শাস্তির নমুনা দর্শন করলেন। একইসাথে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা সৎকর্মের জন্যে পুরস্কৃতদের নিবাস জান্নাতের সুখের নমুনাও দর্শন করলেন। জান্নাতে প্রবহমান শান্তি ও সুখ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করল যে তিনি তাঁর সকল অনুসারীর জন্যেই এই পুরস্কার কামনা করলেন।

‘সিদরাতুল মুনতাহায়’ (স্রষ্টার সরাসরি সান্নিধ্যের স্তরে) পৌঁছার পর জিবরাইল তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বললেন, আমার জ্ঞানের সীমানা শেষ। এরপর এগোনোর শক্তি আমার নেই। আপনি এগিয়ে যান মহাপ্রভুর শানে। এরপর এগিয়ে গিয়ে তিনি যা দেখলেন ও অনুভব করলেন, তা কোনো মানুষ কখনো দেখেনি। সেখান থেকে তিনি ফিরে এলেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে, যাতে সেজদায় অন্তর্চক্ষু উন্মোচিত হয়ে তাঁর অনুসারীরাও লাভ করতে পারে এই অপার্থিব আনন্দের অংশ। ফেরত যাত্রায় আবার জেরুজালেম। জেরুজালেম থেকে মক্কা। রাতের মাত্র একটা অংশ কাটল বাইরে। ভোর হওয়ার আগেই ফিরে এলেন ঘরে। কিছুক্ষণ পরে ঘরের সবাই উঠে নামাজ পড়লে তিনি উম্মে হানীকে বললেন পুরো ঘটনা। উম্মে হানী তাঁর কথাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করলেন।

কিন্তু নবীজী ঘর থেকে বেরুনোর সময় উম্মে হানী তাঁকে সতর্ক করে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে একথা অন্যদের বললে তারা আপনাকে বিশ্বাস নাও করতে পারে। হলোও তাই। আবু জেহেলসহ সত্য অস্বীকারকারীরা বিষয়টি নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগল। কিন্তু আবু বকর শোনামাত্র বললেন, তিনি সত্য বলেছেন। আবু জেহেল তাকে বলল, তুমি এসব উদ্ভট বিষয়ও বিশ্বাস করবে? আবু বকর বললেন, আমি তো বিশ্বাস করি যে, ‘আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়মিত বাণী পাঠান।’ এই বিশ্বাসের কাছে ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণের বিষয়টি তো অনেক সাধারণ।

অবিশ্বাসীরা জানত, নবীজী কখনো জেরুজালেম যান নি। তাঁর কাছ থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দসের বিবরণ জানতে চাইল। নবীজীর মুখে বায়তুল মুকাদ্দসের বিবরণ শুনে তারা হতবাক হয়ে গেল। জানতে চাইল সিরিয়া থেকে ফেরত যাত্রাকারী কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার কথা। কাফেলার অবস্থান, বিবরণ ও কখন মক্কায় ফেরত আসবে সে কথাও নবীজী বর্ণনা করলেন। নির্দিষ্ট দিনেই কাফেলা ফিরে এলো। কাফেলা সম্পর্কিত বিবরণও যথাযথ বলে পরিগণিত হলো।

মেরাজের পুরো ঘটনা নিজ কাজের প্রতি নবীজীর আস্থাকে যেমন জোরদার করল তেমনি বিশ্বাসীদের বিশ্বাসকে করল দৃঢ়। আর যারা বিশ্বাসে দুর্বল ছিল, তাদের অনেকেই পুনরায় ফিরে গেল অবিশ্বাসের অন্ধকারে। মেরাজের মধ্য দিয়ে নবীজী নিজেই শুধু স্থান-কালের সীমানা অতিক্রম করলেন না, তাঁর প্রচারিত ধর্মও অতিক্রম করল স্থান-কাল। মহান নবীদের নামাজে ইমামতির মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলো সকল সত্যধর্মের উত্তরসূরি হিসেবে। এতদিন পর্যন্ত ইসলামের প্রচার সীমিত ছিল কোরাইশদের জগৎ ঘিরে। মেরাজে সেটা রূপ পেল সকল মানুষের সকল কালের সকল ধর্মের মৌল ব্যঞ্জনায়—সমর্পিত অবস্থায় স্রষ্টার সাথে সাক্ষাতের।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি