ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

করোনাকালে বৌদ্ধ ধর্মের আবেদন ও প্রার্থনা

ড. সুকোমল বড়ুয়া

প্রকাশিত : ১৪:৫৫, ৯ মে ২০২০

গৌতম বুদ্ধ

গৌতম বুদ্ধ

গত ৬ মে পালিত হয়েছে বুদ্ধপূর্ণিমা। ২৫৬৪ বুদ্ধাব্দ। এ পূর্ণিমা তিথিতেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ ও মহাপরিনির্বাণ- এ তিনটি মহান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তাই ত্রিস্মৃতিবিজড়িত এই পূর্ণিমা তিথিটি বিশ্বের বৌদ্ধদের নিকট অতীব পবিত্রতম ও মহান। এমন দিনে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মরণব্যাধি করোনাভাইরাসে মৃত ও আক্রান্ত সবার জন্য শান্তি ও আরোগ্য কামনা করছি। প্রার্থনা করছি, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এ মহাসংকট ও দুর্যোগের অবসান হোক।

বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের বাণীই হল জীব জগৎকে দুঃখ থেকে মুক্তি দেয়া। এজন্য বুদ্ধের প্রধান বাণী ছিল ‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’ অর্থাৎ জগতের সকল জীব সুখী হোক। বিশ্ব মানবতা ও আর্তপীড়িত মানুষের জন্য সে এক অসাধারণ বাণী।

বুদ্ধ বুদ্ধত্বলাভের পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের কাছে প্রথম যে ধর্ম ভাষণ করেছিলেন তা ছিল- ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়’ অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা বহুজনের হিত ও বহুজনের সুখের জন্য অনুকম্পাবশত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়। তোমরা এমন ধর্ম প্রচার করো- যে ধর্মের আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তেও কল্যাণ সাধিত হয়। মহামানব বুদ্ধের এ অমোঘ বাণী আজ গোটা বিশ্বের শঙ্কিত মানুষের জন্য অতীব প্রয়োজন।

গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগের উদ্দেশ্য ছিল জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ ও মৃত্যু দুঃখ- এ চতুর্বিধ দুঃখকে প্রতিরোধ করা এবং এ দুঃখগুলোর কারণ অনুসন্ধান করা। আজ আমাদেরও প্রয়োজন এ স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ব্যাধির কারণ অনুসন্ধান করা। কারণ গোটা বিশ্বের মানুষ আজ মহা-আতঙ্কিত, দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এ ভয়াবহতা দেখে মন্তব্য করে বলেছেন ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকটে আজকের বিশ্ব।’ অতএব, আজ এই শুভ তিথিতেই মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী করুণার মঙ্গলময় বাণী দিকে দিকে আবার উচ্চারিত হোক- ‘আরোগ্য পরম লাভা, সব্বদুক্খ বিনাসায়া’ অর্থাৎ জগতের আর্তপীড়িত সবাই আরোগ্য লাভ করুক, দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাক।

বলতে গেলে বিশ্বের সর্বত্র আমরা আজ মানবতাকে ধ্বংস করছি। আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এত উন্নত হওয়ার পরও আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব গুণ ও বিবেককে বিসর্জন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। এজন্যই তো বিশ্ব প্রকৃতি আজ আমাদের ওপর এত রুষ্ট ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। যে প্রকৃতি পরিবেশ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই নদ-নদী, সাগর, ভূ, পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল প্রভৃতি আজ নিধন হচ্ছে নির্মমভাবে, পরিণত হচ্ছে বিরানভূমিতে। তারই নির্মম পরিণতি আজ গোটা বিশ্বের এমন ভয়াবহতা। প্রকৃতি আমাদের জানিয়ে দিল- তোমরা সাবধান হও; নইলে আগামী দিনে আরও ভয়ানক হবে বিশ্ব পরিস্থিতি।

বুদ্ধ আড়াই হাজার বছর আগে প্রকৃতি-পরিবেশের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই শিষ্যদের জীবজগৎ ও উদ্ভিদ প্রকৃতিকে বাঁচানো ও সুরক্ষার কথা বলেছিলেন। কারণ বুদ্ধ জানতেন, তার জন্ম লুম্বিনী উদ্যানে, বুদ্ধত্বলাভ বোধিবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায়, আর মহাপরিনির্বাণ কুশিনারার উন্মক্ত শালবনে। অথচ আমরা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সেরা জীব। কিন্তু প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি নেই আমাদের কোনো মমতা, নেই কোনো যত্ন; বরং আমরা প্রকৃতি নিধনে বিভোর। আমরা হয়েছি পশুর চেয়েও নির্মম, হিংস্র। বিশ্বের মানুষ আজ লোভ, দ্বেষ, মোহে এবং যুদ্ধ-সংঘাত ও সাম্রাজ্য বিস্তারে এবং নানা অপরাধে প্রমত্ত। আমরা ভুলে গেছি আমাদের মনুষ্যত্ব, আমাদের পরম শ্রেষ্ঠত্ব। হৃদয় হয়ে গেছে আমাদের শুষ্ক মরুভূমির মতো। অথচ যে হৃদয়ে আমাদের অনন্ত অসীম প্রেম, করুণা ও ভালোবাসা থাকার কথা; সে হৃদয়ে রয়েছে সীমাহীন লোভ, ঘৃণা আর অসম্ভব নিষ্ঠুরতা। তাই তো পৃথিবী আজ এত বিপন্ন, ধরিত্রী আজ এত ক্রুদ্ধ।

অতএব, আজ বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের আচরণ হোক দায়িত্বশীল। আজ এই শুভ দিনে আবারও প্রার্থনা জানাই মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধের অহিংসা, প্রেম, মৈত্রী ও করুণার বাণী বিশ্বের চারদিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হোক। দূরীভূত হোক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর আর্তপীড়িতের কান্না। বিশ্বকল্যাণে নিবেদিত হোক আমাদের প্রেম-করুণা। মানবতার জন্য প্রসারিত হোক আমাদের পবিত্র দুটি হাত। পরিশেষে কবিগুরু ররীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি-

শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য

করুণাঘন ধরণীতল কর কলঙ্ক শূন্য।

‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’ জগতের সব জীব সুখী হোক।

লেখক- সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি