পতিতাবৃত্তির শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা
প্রকাশিত : ২০:৪৭, ২১ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২০:৫৮, ২১ মার্চ ২০১৮
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনে এ পর্যন্ত প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থান করছে সবথেকে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গারা।
চলমান এই সংকটকে পুঁজি করে রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে করানো হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। কম বয়সী মেয়েরা বিশেষ করে কিশোরীরা হচ্ছে এর মূল টার্গেট। পতিতাবৃত্তির পাশাপাশি পাচার হয়ে বিদেশের পতিতালয়েও আশ্রয় হচ্ছে এদের। সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে এসব তথ্যের সত্যতা উঠে আসে।
বিবিসি নিউজের একটি দল এবং ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল নামের অলাভজনকে একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি কক্সবাজার গিয়েছিল এমন ব্যবসার সাথে জড়িত নেটওয়ার্ক গুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে।
অনুসন্ধান শুরুর পর স্থানীয় ছোট হোটেল ও সৈকতের রেজর্ট থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দালালদের টেলিফোন নম্বর যোগাড় হয়ে গেলো। এই হোটেল ও রিসোর্টে যৌন কর্মকাণ্ডের জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায়।
পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েই বিবিসি নিউজের দলটি এসব নম্বরে ফোন করে দালালদের কাছে জানতে চায় বিদেশীদের জন্য অল্পবয়সী রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা।
এর উত্তরে টেলিফোনের ওপার থেকে এক দালাল জানায় `অল্পবয়সী মেয়ে আছে কিন্তু রোহিঙ্গা মেয়ে কেন খোজা হচ্ছে? ওরা তো খুব নোংরা`।
আরো অনুসন্ধানে দেখা গেলো রোহিঙ্গা মেয়েদের সেখানে সবচাইতে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। পতিতাবৃত্তির ক্ষেত্রেও তারা সেখানে সবচাইতে নিচের সারিতে রয়েছে।
বিবিসির দলটি দালালকে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তারা এসব মেয়েদের সাথে রাত কাটাতে চায়। খুব দ্রুতই বিভিন্ন দালালদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা মেয়েদের ছবি আসতে শুরু করলো। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। বলা হল ছবির মেয়েদের পছন্দ না হল এমন আরো বহু আছে। চাইলেই পাওয়া যাবে। এভাবে এত রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া গেলো যা খুবই ভয়াবহ।
যখন খদ্দের থাকে না তখন এসব মেয়েরা অনেক সময় দালালদের বাড়িতে রান্নাবান্না বা ধোয়ামোছার কাজ করে বলেও জানা গেলো।
অল্পবয়সী মেয়েরা `ঝামেলা` করে বলে তাদের দ্রুত বিদায় করে দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
দালালদের সাথে কথাবার্তার রেকর্ডিং ও ভিডিও স্থানীয় পুলিশকেও দেয়া হয়েছে। পুলিশের একটি ছোট দলকে অভিযানে দেয়া হয়।
দালালদের একজনকে পুলিশ খুব দ্রুতই চিনে ফেলে। বলা হয় সে সম্ভবত পুলিশেরই তথ্য দাতা অথবা অপরাধী কেউ হবে।
অভিযানের অংশ হিসেবে বিবিসির দলটি কক্সবাজারের ঐ দালালকে ফোন করে। ছবিতে দেখা দুটো মেয়েকে রাত আটটায় শহরের একটি নামি হোটেলে পাঠাতে বলা হয়।
ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের এক কর্মী অনুবাদক হিসেবে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিলো।
হোটেলের কার পার্কে অপেক্ষা করছিলো পুলিশ। রাত আটটার দিকে বেশ কিছু ফোন কলের পর একটি গাড়িতে করে ড্রাইভারের সাথে ছবিতে দেখা মেয়ে দুটিকে পাঠানো হয়।
বিদেশী খদ্দের সেজে থাকা ব্যক্তিটি জানতে চায় আজ রাতের পরে আরো মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা। গাড়ির চালক সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে। টাকা হস্তান্তরের পরই পুলিশ গাড়ির চালককে গ্রেফতার করে। মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দারিদ্র আর পতিতাবৃত্তির জালে যেন এই মেয়ে দুটি আটকে গেছে। তারা জানায় পতিতাবৃত্তি ছাড়া জীবন চালানো তাদের জন্য খুব কঠিন।
কিন্তু পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গা মেয়েদের বাংলাদেশের ঢাকা, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
কোলকাতায় ব্যস্ত যৌন ব্যবসায় এরকম অনেক নারীদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে তারা। এর পর তাদের আজ খোঁজ মিলছে না।
ঢাকায় পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে গিয়ে জানা গেলো কিভাবে ইন্টারনেটের সহায়তায় পাচারকারীরা মেয়েদের পাচার করে।
এজন্য গড়ে উঠেছে নানা ফেইসবুক পাতা ও এনক্রিপটেড বা গোপন ওয়েবসাইট।
এমন ওয়েবসাইটও পাওয়া গেলো যেখানে কিভাবে রোহিঙ্গা মেয়েদের ব্যবহার করা যায় সে নিয়ে ধাপে ধাপে তথ্য দেয়া হয়েছে।
কিভাবে ধরা পরার হাত থেকে বাঁচা যায়, কোন এলাকায় সবচাইতে বেশি শিশু পাওয়া যায় এমন সব তথ্য দিয়েছে এক ব্যক্তি।
এই ওয়েবসাইটটি পুলিশ সরিয়ে ফেলেছে। তবে তার আগে সেটি যাচাই করে জানা গেছে কিভাবে শিশুকামী ও পাচারকারীদের টার্গেট হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা।
বাংলাদেশে নতুন সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না উঠলেও যৌনকর্মী হিসেবে কাজের জন্য মেয়ে সরবরাহ বেড়ে গেছে। আর সেটির অন্যতম শিকার রোহিঙ্গা মেয়েরা। ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুই কিশোরীর করুণ গল্প
মিয়ানমারে পরিবারের লোকজনের হত্যাকাণ্ডের পর চৌদ্দ বছর বয়সী আনোয়ারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
বিপদগ্রস্ত এই কিশোরীর সেসময় সাহায্য খুবই দরকার ছিল। আর এই অসহায়ত্বের সুযোগটিই নিয়েছে পাচারকারীরা।
"একদিন একটি গাড়িতে করে কয়েকজন মহিলা এলো। তারা জানতে চাইলো আমি তাদের সাথে যাবো কিনা", বলছিলেন আনোয়ারা।
তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল নতুন জীবনের। তাদের সাথে যেতে রাজি হওয়ার পর আনোয়ারাকে গাড়িতে তোলা হল এবং কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হল।
"খুব বেশিক্ষণ হয়নি তার আগেই ওরা আমার কাছে দুটো ছেলে নিয়ে এলো। তারা আমাকে ছুরি দেখালো। পেটে ঘুষি মারলো। আমি রাজি হচ্ছিলাম না দেখে ওরা আমাকে মারতে থাকলো। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে ধর্ষণ করলো।"
বাংলাদেশের কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে নারীদের যৌন নির্যাতন ও যৌন পেশায় জড়িয়ে পরার এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে।
অল্প বয়সী নারী ও শিশুরা এর মূল টার্গেট। বিপদগ্রস্ত এই নারী ও শিশুদের মূলত কাজের লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের অভিভাবকরা বলছেন দেশের বাইরে কাজ, রাজধানী ঢাকায় বাড়িঘরে গৃহকর্মীর কাজ বা হোটেলে কাজের অনেক প্রস্তাব আসছে তাদের কাছে।
মারাত্মক ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাসুদা নামের আর এক কিশোরী তার কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, "আমি জানতাম আমার কপালে কি আছে। যে মহিলা আমাকে কাজ দেবার কথা বলেছিল সে একজন রোহিঙ্গা। অনেকদিন আগে এখানে এসেছে। সবাই জানে যে সে লোকজনকে যৌন কাজে সহায়তা করে। আমার কোনো উপায় ছিল না কারণ এখনো আমার জন্য কিছুই নেই"।
রোহিঙ্গাদের জন্য জীবনের ভরসা নেই। ক্যাম্পের জরাজীর্ণ জীবনই তাদের ভবিষ্যৎ। তা থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন মাসুদা। এখন তিনি একটি স্থানীয় এনজিওর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
মাসুদা বলছেন, "আমার পরিবার নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমার কোন অর্থকড়ি নেই। মিয়ানমারে আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। আমি একসময় আমার ভাইবোনের সাথে খেলা করতাম। এখন খেলা কাকে বলে সেটাই ভুলে গেছি।"
*বিবিস বাংলা অবলম্বনে
//এস এইচ এস//টিকে
আরও পড়ুন