ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

পেন্ডুলাম ঘড়ির ইতিহাস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪৩, ৪ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ২১:০৬, ৬ আগস্ট ২০২১

সময়কে মানুষ অনেক আগে থেকেই পরিমাপ করতে শিখেছে। একটা সময় ছিল, যখন সূর্যের অবস্থান দেখেই মানুষ ধারণা লাভ করত সময় সম্পর্কে। আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর ও ব্যাবিলনে উৎপত্তি হয় সূর্যঘড়ির। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর; এ নিয়েই সূর্যঘড়ি। এমনকি মানুষের তৈরি প্রথম যান্ত্রিক ঘড়িতেও কাজে লাগানো হয়েছিল সূর্যের সময় ভিত্তিক অবস্থানের সূত্রকেই।

খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে মিসরে উৎপত্তি হয় পানিঘড়ির। বালিঘড়ির মতো করে কাজ করা এই ঘড়িটির নাম রাখা হয় ক্লেপসাড্রা। একটি বড় পাত্র থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় একটি ছোট পাত্রে পানি পড়ার মাধ্যমেই এগিয়ে চলে সময়ের কাঁটা। নিচের ছোট পাত্রের সঙ্গে জুড়ে থাকে একটি খাঁজযুক্ত দণ্ড। ওটাই একটু একটু করে ঘোরাতে থাকে সময়ের গিয়ার।

পানিঘড়ির হাত ধরেই আসে দিন, মাস ও ঘণ্টার ধারণা। গ্রিকরাই প্রথম বছরকে ১২ ভাগে ভাগ করে। এরপর উপবৃত্তাকার কক্ষপথকে ৩৬০ ডিগ্রি ধরে তাকে ১২ দিয়ে ভাগ করেই পাওয়া গেল মাসের ৩০ দিন।

মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা সূর্যের উদয়-অস্ত নিয়ে দিনকে দুটো সমান ভাগে ভাগ করল। এভাবে এলো ১২+১২ = ২৪ ঘণ্টা। সে সময় তাদের সংখ্যা গণনার ভিত্তি ছিল সেক্সাজেসিমাল তথা ৬০। আর এ কারণেই ঘণ্টা ও মিনিট ভাগ হলো সমান ৬০টি ভাগে। জার্মানির পিটার হেনলেইন ১৫১০ সালে প্রথম স্প্রিং চালিত ঘড়ি আবিষ্কার করেন। তবে ওটা নিখুঁত সময় দিতে পারত না।

এ সময় আরেক জার্মান গবেষক জোস্ট বার্জিও তৈরি করেন আরেকটি যান্ত্রিক ঘড়ি যেখানে মিনিটের কাঁটা ছাড়া আর কোনো নির্দেশক ছিল না তাতে। ১৬৫৬ সালে পেন্ডুলাম চালিত প্রথম কার্যকর ঘড়ি আবিষ্কার করেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন। ডানে-বাঁয়ে হেলে-দুলে বেশ ভালোভাবেই ঘুরিয়ে দিত মিনিট ও ঘণ্টার খাঁজকাটা চাকতিগুলো। পরে ১৯০৬ সালে পেন্ডুলাম ক্লকের পিছনে প্রথমবারের মতো জুড়ে দেওয়া হয় ব্যাটারি!

ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। অনেকেই হয়তো সেই ইতিহাস জানেন। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ঘড়ির পেন্ডুলাম। কিভাবে আবিস্কার হল এই পেন্ডুলামের সেটাই জেনে নিব আজ।

পেন্ডুলামের আবিষ্কারক
বিজ্ঞানের এমন অনেক আবিস্কার আছে যা হয়েছে অতি সাধারণ ঘটনা থেকে। আবার এমন আবিস্কার আছে যা হয়েছে হঠাৎ। পেন্ডুলাম বা দোলক। এই দোলকযুক্ত ঘড়ি আবিস্কারের মূলে ছিল এক অতি সাধারণ ঘটনা। বিখ্যাত বিজ্ঞানি গ্যালিলিও নাম আমরা সবাই কম বেশি শুনেছি। ১৫৮১ সালের একদিন অর্থাৎ ১৭ বছরের গ্যালিলিও একটি গীর্জায় গিয়েছিলেন উপাসনার জন্য। এর আগে এই গীর্জায় তিনি বহুবার গেছেন। তবে সেদিন ঘটল অন্যরকম ঘটনা। গীর্জার ভেতরে হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি লণ্ঠন। যেটি গীর্জার উঁচু ছাদ থেকে ঝোলানো রয়েছে। ব্রোঞ্জের তৈরি সেই লণ্ঠনটি বাতাসে দুলছিল। একবার বাম দিকে, একবার ডান দিকে। অনেক্ষণ তিনি সেটা লক্ষ্য করলেন। তার মনে হলো বাম দিক থেকে ডান দিকে এবং ডান দিক থেকে বাম দিকে লণ্ঠনটি যেতে একই সময় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না, প্রমাণ চাই। পরে তিনি নিজের ল্যাবরেটরি তে একটি ভাড়ি বস্তুকে হালকা সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে পেন্ডুলাম বা দোলক তৈরি করে ফেললেন। এভাবেই আবিস্কার হলো ঘড়ির পেন্ডুলাম।

প্রথমে তিনি পেন্ডুলামটি দিয়ে রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করতেন। পরে ১৬৩৭ সালে তিনি পেন্ডুলাম ঘড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। পরবর্তিতে ১৬৪৯ সালে তার পুত্র এর রূপায়ন করতে শুরু করেন। কিন্তু তিনিও সেটা শেষ করে যেতে পারেননি। আরও অনেক পরে পেন্ডুলামের এই ধারণাকে কেন্দ্র করে ১৬৫৬ সালে নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন পেন্ডুলম ঘড়ি তৈরি করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম নির্ভুলতম ঘড়ি।  

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কারক হিসেবে একজন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নামও পাওয়া যায়। তার নাম আবুল হাসান আলি ইবনে ইউনুস আল-মিসরি। তিনি মিসরের রাজধানীর কায়রোস্থ বিখ্যাত জ্ঞান-গবেষণাকেন্দ্র দারুল হিকমার নেতৃস্থানীয় গণিতজ্ঞ ছিলেন। মুসলমানরা তাদের স্বর্ণযুগের শুরুতেই ঘড়ির ব্যবহার শুরু করেছিল। এদিকে ইবনে ইউনুস পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন। পেন্ডুলাম আবিষ্কারের মাধ্যমে যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি করা হয়। পশ্চিমা কিছু বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুসের পেন্ডুলাম আবিষ্কারের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ আছে, দশম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কার করেন এবং সময় নির্ধারণে তা ব্যবহার করেন। এছাড়াও ইবনে ইউনুসের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি প্রমাণ করে তিনিই পেণ্ডুলামের প্রথম আবিষ্কারক।

যা হোক- এবার জেনে নিব সরল দোলকের পর্যায়কালের সূত্র-
T = সরল দোলকের পর্যায়কাল
L = সরল দোলকের সুতোর দৈর্ঘ্য
g = অভিকর্ষজ ত্বরণ
এই সূত্রকে কাজে লাগিয়েই পেন্ডুলাম ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে। পেন্ডুলাম ঘড়ির পেন্ডুলাম মূলত ঘড়ির প্রতি সেকেণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে হাতঘড়ি এবং টেবিল ঘড়িতে সাধারণত ব্যালান্স হুইল ঘড়ির প্রত্যেক সেকেন্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় সব মেকানিক্যাল ঘড়ির বাকি অংশ প্রায় একই রকম থাকে।

পেন্ডুলাম ঘড়িতে দম দেওয়া মানে কোনো ঝোলানো ভারকে চাকায় জড়িয়ে ওপরে তোলা। আর এর ফলে ভারটির মধ্যে বিভবশক্তি সঞ্চিত হয়। এই শক্তির সাহায্যেই ঘড়ি চলে। তবে এই শক্তি ঘড়ির অন্য অংশগুলোকে নিয়ন্ত্রিতভাবে সরবারহ করা হয়। পেন্ডুলাম ঘড়ির পেন্ডুলাম একটা সরল দোলক। সরলদলকের সুতোর দৈঘ্য (L) পরিবর্তন করে পর্যায়কাল (T) নিয়ন্ত্রণ করা যায় (কারণ, π এবং g এর মান ধ্রুবক)। সাধারণত পেন্ডুলামের সুতো বা রডের দৈর্ঘ্য এমনভাবে নেওয়া হয় যাতে পর্যায়কাল ১ সেকেন্ড হয়।

যার ফলে পেন্ডুলামের দোলনের সাথে সাথে একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রত্যেক ১ সেকেন্ড অন্তর অন্তর এস্কেপ হুইল এর একটা করে দাতকে ছেড়ে দিতে থাকে। একে escapement বলা হয়।

এখানেই মূলত পেন্ডুলাম ঘড়িতে পেন্ডুলামের কাজ শেষ হয়। Escape Wheel এর গতি বিভিন্ন গিয়ার্ এর মাধম্যে ঘড়ির সময় গণনাকারী অংশে পাঠানো হয় এবং ঘড়ি আমাদের সময় দেখাতে থাকে।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি