যৌন বিকৃতির কারণ হয়ে উঠছে স্মার্টফোন
প্রকাশিত : ১৯:১৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮
সম্প্রতি ভারতে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকরা এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন স্মার্ট-ফোনের অপব্যবহার। এছাড়াও পর্ণ ভিডিও, যৌনতা সম্পর্কে শিক্ষার অভাব, যৌন সহিংসতার ঘটনা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে অনেকে মত দিয়েছেন।
একদল টিনএজার একজন তরুণীর শরীর থেকে কাপড় টেনে খোলার চেষ্টা করছে-এমন একটি ভিডিও চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতের জনপ্রিয় একটি সামাজিক মাধ্যম হোয়াটস অ্যাপে ভাইরাল হয় ।
সেখানে দেখা যায়, মেয়েটি ছেলেদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকে, তাদেরকে `ভাই` বলে সম্বোধন করে কিন্তু তারা ব্যঙ্গ করতে করতে, হাসতে হাসতে প্রচণ্ড উপভোগের সাথে অপকর্মটি করতে থাকে।
সেই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ এটা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে বিহারের একটি গ্রামে ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল এবং অভিযুক্ত তরুণদের আটক করা হয়েছিল।
প্রদেশটির রাজধানী থেকে কাছেই সেই গ্রামটির নাম জেহানাবাদ। সেখানকার বাসিন্দাদের মাঝে বিষয়টি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং তারা পুরো ঘটনার জন্য দোষারোপ করছে স্মার্টফোনকে।
ভারতে পর্নোগ্রাফি বিষয়ক কোনকিছু তৈরি এবং শেয়ার করা অবৈধ কাজ। যদিও সস্তা ইন্টারনেট ডাটা এবং স্মার্ট-ফোনের কারণে সেসব সহজেই মিলে যাচ্ছে হাতের নাগালে, কিন্তু উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং যৌনতার বিষয়ে সেসব তাদের অর্থপূর্ণ কোনও ধারণাই দিতে পারছে না।
স্থানীয় অনেক কিশোর-তরুণ গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন যে, তারা যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের ভিডিও দেখেছেন।
১৬ বছর বয়সী এক কিশোর জানায়, সে এরকম ২৫টির বেশি ভিডিও দেখেছে, সে এটাও জানায় যে নিজেদের বন্ধুদের মাঝে তারা স্মার্ট-ফোনে এসব আদান-প্রদান করে থাকে।
তার ভাষায় ‘আমার ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেই একসাথে বসে কিংবা তারা নিজেরা নিজেরা এসব ভিডিও দেখে।’
আরেক কিশোর বলে, ‘এটা দারুণ লাগে কারণ সবাই এটা করে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ভারতীয় বহু পুরুষের ক্ষেত্রেই এভাবে যৌনতার সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে ।
চলচ্চিত্র পরিচালক এবং লেখক পারমিতা ভোহরা এজেন্টস অব ইশক (ভালবাসার এজেন্ট) নাম দিয়ে একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করছেন যেখানে `সেক্স` বিষয়ে খোলামেলা কথা-বার্তা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বেড়ে ওঠার সময় যৌন শিক্ষা দেওয়া হয়নি কিংবা এসব বিষয়ে স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক আলাপও হয়নি।’
ভারতে স্মার্ট-ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা চারশো মিলিয়ন এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি লোক হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। এই ধরনের ভিডিও শেয়ার করতে এই মাধ্যমটিই প্রায়শ ব্যবহার করা হয়।
গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বিবৃতিতে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘আমাদের প্ল্যাটফর্মে এই ভয়াবহ ধর্ষণের ভিডিও এবং শিশু পর্নোগ্রাফির কোন স্থান নেই। এ কারণে আমরা এসব বিষয়ের মতো সমস্যার ক্ষেত্রে রিপোর্ট করার বিষয়গুলো সহজ রেখেছি, যাতে করে আমরা ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট ব্যান (নিষিদ্ধ) করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি।
তারা বলছে, আমরা ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যেকোনো আইনগত জিজ্ঞাসা বা অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাদের তদন্ত কাজে সহায়তা করে থাকি।
উত্তরাঞ্চলীয় উত্তরাখণ্ড প্রদেশে কয়েকজন যুবক তাদের মোবাইল ফোনে পর্ণ ভিডিও দেখে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার পর তা ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্ট করেছিলো।
সেটিকে কেন্দ্র করে, উগ্র পর্নোগ্রাফি রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের ওপর ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশনা দেয় স্থানীয় একটি আদালত।
ব্যাপক বিক্ষোভের পর প্রায় তৎক্ষণাৎ সেটি বাতিল করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র সহিংসতা কিংবা আপত্তিকর ভিডিও রয়েছে এমন ৮শর মতো ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদিও এর খুব একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলা যাবেনা।
বড় বড় পর্নোগ্রাফী সাইটগুলোর অন্যতম একটি সাইটকে ব্লক করে দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সেটি আবার নতুন ইউআরএল সহ হুবহু একইরকম আরেকটি সাইট (মিরর সাইট) তৈরি করে ফেলেছে এটির ভারতীয় বাজারকে লক্ষ্য করে।
অনেকের বিশ্বাস প্রজনন শিক্ষার ঘাটতি এই ধরনের সহিংস এবং নারী-বিদ্বেষী ভিডিওর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রেই নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই যৌন সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা কি সে সম্পর্কে গভীর কোন ধারণা থাকেনা।
সরকার অবশ্য এই অবস্থা বদলানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল।
২০০৯ সালে অ্যাডলসেন্ট এডুকেশন প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য ছিল- কিশোর বয়সের নানা পরিবর্তন এবং লিঙ্গ, যৌনতা, যৌন সংক্রামিত রোগ ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করা।
কিন্তু এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে এখনো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেহানাবাদেরই একটি গার্লস স্কুলের অধ্যক্ষ জানালেন এই কর্মসূচি সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
এমএইচ/
আরও পড়ুন