ঢাকা, বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

এক প্রবাসীর অব্যক্ত কাহিনী

মোহাম্মদ সুমন

প্রকাশিত : ২২:১২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

ছবি- লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।

ছবি- লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।

বয়স আমার ৪৩, কুয়েতে আছি ২১ বছর হলো। জীবনের আর্ধেকটা সময় প্রবাসেই কেটে গেল! আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, বউ-বাচ্চা সবাই বলে আমি নাকি সফল প্রবাসী। আমার পরিবার নাকি গর্ব করে আমাকে নিয়ে। আমার বাবা তো প্রায়ই বলে- আমি নাকি তার শ্রেষ্ঠ সন্তান।

আগে পরিবারের কথা শুনে খুব ভালো লাগতো। নিজেকেই সুখি মনে করতাম। কিন্তু এখন কেন জানি আর এই সব কথা শুনতে ভালো লাগে না। খুব বিরক্ত লাগে। আর বিরক্ত লাগার কারণ হলো বয়সের ভার!

যাই হোক, এখন ভাবতেছি দেশে চলে যাব। দেশে গিয়ে ব্যবসা করবো। যে ২৫ লাখ টাকা আছে, সেগুলো দিয়ে! বাডি ঘর তো সবই করলাম। এখন যে টাকাগুলো আছে সেগুলো দিয়ে কিছু একটা করে পরিবারের সাথে থেকে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু যখন বাড়িতে বললাম- আমি দেশে চলে আসব; তখন আমার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল, হাজারটা প্রশ্ন! কেন দেশে আসবো? দেশে এসে আমি কি করবো? এমন হাজারটা প্রশ্ন! 

আমার বাবা তো বলেই ফেললেন- আমি নাকি দেশে এসে কিছুই করতে পারবো না, দেশের অবস্থা নাকি ভালো না, আর আমার দ্বারা নাকি দেশে ব্যবসা করাটা অসম্ভব। আমার বউ বলে, আপনে এখন দেশে এসে কি করবেন? বিদেশেই তো আছেন ভালো আছেন। এখন দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ভাল না। আর এখন নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও বিদেশে থাকতে হবে! 

বাবা আর বউয়ের কথা শুনে অনেক কষ্ট পেলাম। যে আমি প্রবাসে কাটিয়ে দিলাম জীবনের ২১টা বছর! প্রবাসে প্রতিটি দিনই পার করতে হয় যুদ্ধ করে! আর সেই আমি নাকি দেশে গিয়ে কিছু করতে পারবো না! সবাইকে বললাম- কেউ আমার কথা বুঝলো না। সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেলাম মা'র কথা শুনে। মা বললেন যে, "বাবা রে, তোর মতো সহজ সরল মানুষেরা দেশে এসে কিছু করতে পারবি না। এই দেশটা ভাল মানুষের জন্য নয়। যতদিন বিদেশে থাকতে পারিস ততদিন ভাল থাকবি"। 

অথচ এই আমি অপরিচিত দেশে ভিন্ন ভাষা মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলাম। একজন সফল প্রবাসী বটে! অনেক টাকা পয়সা রোজগার করলাম। এই আমি নাকি নিজ দেশে গিয়ে কিছু করতে
পারবো না!

খুব জানতে ইচ্ছে করে, যারা দেশে আছে তারা কি বেঁচে থাকে না? তারা কি না খেয়ে থাকে? হয়তো তাদের সংসারে বিলাসীতা নেই, নেই দামি দামি খাওয়া, দামি পোশাক। তবু তো তারা বেঁচে থাকে। হয়তো দেশে থাকলে জীবন যুদ্ধটা একটু কঠিন হবে! যদি আমার গল্পটা এখানে সমাপ্তি হতো ভালই হতো!

কিন্তু প্রবাসীদের একটি গল্পের শেষে যে  আরেকটি গল্প শুরু হয়। আর এই গল্পের সমাপ্তি করতে গিয়ে জীবন থেকে চলে যায় অনেকগুলো বছর। সবকিছু ভুলে মেনে নিলাম পরিবারের সিদ্ধান্তকে, কারণ আমরা বাঙ্গালীরা পরিবারবিহীন থাকতে পারি না!

হটাৎ একদিন বাবা বললো- বাড়িতে বিল্ডিং তোলার জন্য। আমি বললাম- বিল্ডিং তোলার টাকা কই পাবেন? তখন বাবা বললো- কেন ব্যাংকে যে টাকাগুলো আছে তা দিয়ে! ব্যাংকের টাকাগুলো না হলে কয়েক লাখ টাকা ঋণ করবো। তুই মাসে মাসে ঋণ শোধ করবি। আমি বললাম- না বাবা, বিল্ডিং তোলার দরকার নাই। যদি বিল্ডিং তুলেন, তাহলে যে আমার বাকি জীবনটাই প্রবাসে কাটাতে হবে। তখন বাবা বললো- আমার অনেক দিনের ইচ্ছে বিল্ডিংয়ে ঘুমানো! 

এদিকে বউও একই কথা বলছে। মাও বলছে, পাশের বাড়ির অনেকেই বিল্ডিং তুলছে। তুই কেন তুলবি না? আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে বাড়ির সবাই বলছে বিল্ডিং তুলতে। বিল্ডিং তুললে নাকি সমাজে মানুষের কাছে দাম পাওয়া যায়। সমাজে বড় লোক হিসাবে পরিচিত হওয়া যায়! কিন্তু কেউ আমার কথা ভাবলো না, শুনলো না কেউ কোনও কথা। বুঝলো না আমার কষ্টটা কেউ। 

আমি জানি, বিল্ডিং তুললে আমার আরো ১০ বছর প্রবাসে থাকতে হবে। কারণ যে টাকাগুলো আছে, তা বিল্ডিং তুলতেই খরচ হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য আরো বেশ কিছু বছর বা বাকি জীবনটাই প্রবাসে কাটাতে হবে। কিন্তু এই প্রবাস জীবনটা যে আর ভালো লাগেনা। আজ আমি অনেক ক্লান্ত, বয়সের ভারে শরীরের শক্তিগুলো প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে। এখন আর আগের মতো কিছু ভাল লাগে না। 

আপন মানুষগুলো যে কেন এত স্বার্থপর হয়! আমি তো চেয়েছিলাম- ছোট একটা ঘর তুলে বউ-বাচ্চা, মা-বাবাকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার চাওয়াগুলো কেন প্রিয় মানুষগুলো বুঝে না! আজ যে আমি অনেক ক্লান্ত, আমি যে পারছি না বয়সের ভারে জীবনটাকে চালিয়ে নিতে, আমি জানি না আরো কত বছর এভাবে প্রবাসে কাটাতে হবে! নাকি মৃত্যু অবধি! আর তা-ই যদি হয় আফসোস নেই, এখন আমিও চাই- আমার মৃত্যুটা যেন একজন সফল প্রবাসীর মতো এই প্রবাসেই হয়; আর তখন পরিবার, সমাজ, দেশ আমাকে একজন সফল প্রবাসী হিসাবেই গর্ব করবে!!!

একটা কথা বলি, পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন টাকা, টাকা, টাকা এবং টাকা! আপনার যদি টাকা থাকে আপনজনের অভাব হবে না, তাই নিজের জন্য কিছু টাকা জমা করেন।

লেখক- কুয়েত প্রবাসী।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি