আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা
প্রকাশিত : ০৮:১৩, ১৫ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ তখন সদ্যোজাত শিশুর মতো মাথা তুলে দাঁড়ানোর সংগ্রামে রত। কিন্তু তার আগেই ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতার লোভ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশকে নিয়ে গেল এক নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে। কুচক্রী আর বিপথগামীদের বুলেট ১৯৭৫ সালের এই দিনে সপরিবারে হত্যা করল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ ঘটনা যখন ঘটে তার আগেই বঙ্গবন্ধু পরিণত হয়েছিলেন বিশ্ব ব্যক্তিত্বে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নেতৃত্ব তাকে নিয়ে গিয়েছিল বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বগণমাধ্যম ও রাষ্ট্রনেতাদের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। ফলে তার হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককেও। ১৫ আগস্টের সেই কলঙ্কজনক ঘটনা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছিল বিশ্ব গণমাধ্যম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে- বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঢাকায় সংবাদ কভার করতে এসে বিমানবন্দর থেকে জোর করে ফেরত পাঠানো সাংবাদিক ব্রায়ান ব্যারন লন্ডনে ফিরে লিখেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন সংবাদ চ্যানেল এবিসি নিউজ গুরুত্ব সহকারে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি প্রচার করে। বাংলাদেশে অভ্যুত্থান শিরোনামের ওই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে সংগঠিত ক্যুতে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান তার বাড়িতে নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরাও প্রাণ হারিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন এবং তিনি দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে পাল্টে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রেখেছেন।
মার্কিন আরেক চ্যানেল এনবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতির পিতা ও স্বাধীনতা লাভের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মিলিটারি ক্যুতে তার দেহরক্ষীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ, যিনি ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে মুজিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও কট্টর বিরোধী ছিলেন। তিনি দেশের নাম পাল্টে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রেখেছেন।
কানাডার সিবিএস নিউজের খবরে বলা হয়, এক আকস্মিক ক্যুতে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। তার অন্তত ২০০ অনুসারীও নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। দেশে সেনা শাসন ও কারফিউ জারি করা হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণকারীরা মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে ধ্বংসের অভিযোগ তুলেছে।
১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসির খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা পর্যন্ত সংকোচবোধ করেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার সময় থেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলে পরিচিত ভারতে। সেদিন ছিল দেশটির স্বাধীনতা দিবস। সেই খবর ছাপিয়ে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকা ও রেডিওতে গুরুত্ব সহকারে প্রচার হয়েছিল এই খবর। ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রুশ ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
একই দিন ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের নয়াদিল্লি প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘একটি সেনা সমর্থিত সরকার মধ্যরাতে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছে। মনে করা হচ্ছে, সরকারটি ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষের। ক্ষমতাচ্যুতির ওই বিদ্রোহ দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক বামপন্থি রাষ্ট্র্রপতি মুজিবুর রহমানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।’
তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্রিকা ইজভেস্তিয়া অবশ্য ভেতরের পাতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার খবর ছাপে। তবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদার খবরে বলা হয়, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিকূল শক্তিরা হয়তো দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলবে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবরে সেদিন খানিকটা যেন উল্লসিত হয়ে উঠেছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তান। ১৫ আগস্ট সকালেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ও বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর করাচি ও লাহোরের পত্রপত্রিকাগুলো বিশেষ বুলেটিন বের করে। রেডিও পাকিস্তানের সকাল ৮টার খবরেও গুরুত্ব সহকারে তা প্রচার করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ ৫০ হাজার টন চাল এবং ১০ মিলিয়ন গজ সুতা উপহার দেয়। পাশাপাশি ওআইসি এবং অন্য মুসলিম দেশগুলোকে পাকিস্তান আহ্বান জানায়, যেন তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
১৮ আগস্ট পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক ‘জং’-এর সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো হয়। সেখানে মোশতাক সরকারকে বঙ্গবন্ধুর আমলে সম্পর্কের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেরও পরামর্শ দেওয়া হয়।
এসএ/
আরও পড়ুন