বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার জড়িত থাকার প্রামাণ্য দলিল
প্রকাশিত : ১২:৫২, ১৫ আগস্ট ২০২০
১৫ আগাস্ট জাতীয় শোক দিবস। ঐ দিন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য। হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে সে আজ দীর্ঘদিন। অপরাধীদের সাজা কার্যকর হয়েছে সেও বেশ অনেক বছর। সেখানে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচার বা অপরাধীদের তালিকায় নেই। তারপরও কেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক বছরে অন্তত তিন বার বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জিয়ার জড়িত থাকার প্রসঙ্গ টেনেছেন? দ্বিধান্বিত না হয়ে তিনি সরাসরি বলেন, ‘(বঙ্গবন্ধুর) হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়া সম্পূর্ণভাবে জড়িত।’ তিনি আরও বলেন, ‘জিয়া যে রাষ্ট্রপতি হল, সূত্রটা যদি খোঁজেন … জিয়া ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল… আমিতো বলব, একটা এজেন্ট হিসেবেই কাজ করেছিল।’ (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
দেশী-বিদেশী অনেক বিশ্লেষকের দাবি, খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। ১৯৭৫ এর ১৫ আগাস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণও একই মত পোষণ করে। তবে মোশতাককেও কখনো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি, তার পূর্বেই তার মৃত্যু ঘটে। সেই সাথে বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে ‘সিআইএ’ বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত (Badhwar, Feb. 4, 2014, CIA’s Dacca Connection)। লিফশুলজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, কিসিঞ্জারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ অ্যাসিস্টান্ট রজার মরিস বলেন, “it is absolutely plausible that Kissinger gave his nod to Mujib’s outer because Mujib was on Kissinger’s enemy list of the ‘three most hated men’ along with Allende and Thieu”. (Badhwar, Feb. 4, 2014, CIA’s Dacca Connection)। তবে লিফশুলজ এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন আছে বলে উল্লেখ করেন।
তাহলে কি একদল জুনিয়র সেনাবাহিনী সদস্যের সাথে জিয়া, মোশতাক গং এবং সিআইএ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত? বলা দুরূহ। তবে শুধু হাতে গোনা কয়েকজন জুনিয়র অফিসার এবং সৈনিক এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তা ভাবা বোধ হয় বোকামি। ‘জিগ্-ছ’ পাজলের মত তারা সবাই হয়তো জড়িত। পুরো বিষয়টা ছিল ‘একটি নীলনকশার’ অংশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে মাত্র। তবে আজকের এই প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার ভূমিকা কী, শুধু তা বোঝার চেষ্টা করেছি। আর জিয়া যুক্ত থাকলে, তার গুরুত্ব বা কতটুকু?
জেনারেল জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন তা সম্ভবত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় ১৯৭৬ সনে বিলাতের আইটিভি চ্যানেলের World in Action প্রোগ্রামে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এই সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশীদ দাবি করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে ১৫ আগাস্টের বহু পূর্বেই জিয়াকে তারা অবহিত করে। ফারুক জানায়, ২০ মার্চ ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটের দিকে সে জিয়ার বাসায় জিয়ার সাথে দেখা করে এবং তাকে বলে- The country required a change।
উত্তরে জিয়া বলেন, ‘Yes, yes, lets go outside and talk’। তখন জিয়া ফারুককে নিয়ে বাইরে বাড়ির লনে যায়। সেখানে ফারুক পুনরায় বলে, ‘We have to have a change. We, the junior officers, have already worked it out. We want your support and leadership’। জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। জিয়া বলেন, ‘If you want to do something, you junior officers should do it yourself…’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh – A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)
আমরা অবশ্যই ভাবতে পারি বা প্রশ্ন করতে পারি, ফারুক-রশীদ বললো বলেই কি তা সত্য? এমনও তো হতে পারে যে, তারা তাদের দোষ কিছুটা লাঘব করার জন্য অন্যের ঘারে দোষ চাপাতে চেয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জিয়া? অন্য কোন সিনিয়র অফিসার নয় কেন? জিয়ার নামটা কি তারা হঠাৎ করে বা র্যান্ডমলি বলেছে? বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৬ সালে দেওয়া জিয়ার মাসকারেনহাস-কেই দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে। মাসকারেনহাস এর ভাষায়, ‘In July, 1976, while doing a TV programme in London on the killing of Sheikh Mujib I confronted Zia with what Farook had said’ (তাদের সাক্ষাৎকারে) । জিয়া এ ব্যাপারে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সাথে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টি এসেছে এভাবে, ‘Zia did not deny it– nor did he confirm it’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh– A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)।
সাক্ষাৎকারে জেনারেল জিয়ার গড়িমসি বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ভাব দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, ফারুকের সাথে জিয়ার এ কথোপকথন সত্য। এর সত্যতার আরও প্রমাণ মেলে আরও অনেক বছর পরে ১৯৯৭ সালে যখন ফারুক জেলে আর রশীদ ইউরোপে। ১৯৯৭ সনে রশীদের সাথে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ এর সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে। লিফশুলজের ভাষায়, ‘In 1997 I met Rashid for several hours in an European city… I went over with him exactly what he had told Mascarenhas about Zia’s involvement. Rashid confirmed to me the accuracy of his interview with Mascarenhas’।
শুধু তাই নয় রশীদ লিফশুলজকে এ ব্যাপারে আরও বহু কিছু বিস্তারিত জানায়। রশীদ জোরালোভাবে বলে যে, ‘He (Rashid) had met General Zia numerous times prior to the coup and that Zia was fully in the picture (In Conversation with Lawrence Lifschultz– The Daily Star, December 4, 2014)।
জিয়ার সাথে ফারুক-রশিদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে আরও অনেকবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, ‘একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়। জিয়া আরও বলে, If it is a success then come to me. If it is a failure then do not involve me.’ (আসাদুজ্জামান– বস সব কিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রথম আলো, ১৫ অগাস্ট, ২০১৮)।
একইভাবে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে অবহিত ছিলেন, কি ছিলেন না, তা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘন্টা পর কর্নেল শাফায়েত জামিল এবং জিয়ার কথোপকথন থেকে। তবে বিষয়টা বুঝতে হবে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই সকালে শাফায়েত জামিল জিয়ার সাথে দেখা করতে গেলে তাকে শেইভ করতে দেখেন। জামিল জিয়াকে বলেন, ‘The President has been killed, Sir. What are your orders?’ উত্তরে জিয়া বলে, ‘If the President is no longer there, then the Vice President is there. Go to your headquarters and wait there’। তখন জামিলের দৃষ্টিতে জিয়াকে অনেক শান্ত দেখায়, ‘Evidently aware of what had happened’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh– A Legacy of Blood, page 76, 1986)।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি বিষয় এখানে পরিষ্কার, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জিয়া পূর্বেই অবহিত ছিল। চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়নি, বরঞ্চ চক্রান্তকারীদের উৎসাহিত করেছেন এবং সেই সাথে, আসন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এ সব তথ্য এবং বিশ্লেষণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং একটি নির্বাচিত সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাতে জিয়ার পূর্ণ সমর্থন ছিল। এ ব্যপারে লিফশুলজ এর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের ফলাফল পরিষ্কার, ‘Had he (Zia) been against the coup, as Deputy Chief of the Army, Zia could have stopped it.’ তার মতে, “… Zia played perhaps the most crucial of all roles. He was the key ‘Shadow Man’. He (Zia) assured Rashid that he would make certain that the forces in the Army would not move against him and his men if they succeeded.” (In Conversation with Lawrence Lifschultz – The Daily Star, December 4, 2014)।
এসব থেকে আমরা বলতে পারি যে, জিয়া জেনেশুনে এবং সজ্ঞানে উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে দেশের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেনি। এ কারণে তার সাজা হতে পারে, তাই বলে কি বলা যাবে যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তকারীদের একজন? যদি তাই হয়, তাহলে জিয়ার সাথে শুধু ফারুক-রশীদের নয়, হত্যা পরিকল্পনার অন্যান্যদের যেমন, খন্দকার মোশতাক গং এবং সিআইএ এর সাথে ১৫ আগাস্টের পূর্বে যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তা কি ছিল? সত্য উৎঘাটনে এ বিষয়টা তলিয়ে দেখা জরুরি।
সময়টা ১৯৭৪। দেশে তখন সেনাবাহিনী দ্বারা অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চলছে। সেই সময় জিয়ার ফারুকের বাসায় আসা যাওয়া ছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে জিয়া ফারুককে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা ট্যাংক টুং ছাড়া দেশের আর খবরাখবর রাখো কি?’ সেই সাথে আলাপের মাধ্যমে ফারুককে করে জিয়া প্ররোচিত করতে যা বলেছিলেন তা অবাক করার মত। জিয়া বলেন, ‘দেশ বাচাঁনোর জন্য একটা কিছু করা দরকার।’ (আসাদুজ্জামান– বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রথম আলো, ১৫ অগাস্ট, ২০১৮)।
তাহলে দেশকে নিয়ে জিয়ার ভাবনা নিদেনপক্ষে ১৯৭৪ সাল থেকে। তবে কি জিয়ার কার্যকলাপ এবং গতিবিধি তখন থেকেই কোনো ষড়যন্ত্রের পথে এগুচ্ছিল? দেশে এত মেজর থাকতে, জিয়া কেন ফারুককে বেছে নিয়েছিল এত সব বলার জন্য? নেহায়েত তাদের পূর্ব পরিচয় ছিল বিধায়? নাকি, অন্য কিছু? উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে ফারুক তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এখানে কি দুই জনের মাঝে কোন ধরণের পাকিস্তান কানেকশন আছে? ঘটনাটা গবেষণার দাবি রাখে।
কেবল সেনাবাহিনীর মেজরদের সাথেই নয়, জিয়া ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের কর্মকর্তাদের সাথেও যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত পেশ করতেন। এমন একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে তৎকালীন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম। ১৯৭৪ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সীমান্তে দিয়ে খাদ্যশস্য (ধান-চাল) চোরাচালান বন্ধের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে এসব তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৪’র জুলাই-আগাস্টের কোনো একদিন জিয়া আসেন নূরুল ইসলামের কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে খাদ্যশস্যের চোরাচালানের পরিমাণ নিয়ে আলোচনার জন্য। আলোচনায় দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য চোরাচালান হচ্ছে বলে জিয়া মত পোষণ করেন এবং বলেন, “… there was a very large scale smuggling ranging anywhere from half a million to a million tons.” (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh – An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, page 225)। পরিসংখ্যানটা নূরুল ইসলামকে অবাক করে। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসাবে নিয়ে কি করে এত অল্প সময়ে (এপ্রিল-জুন, ১৯৭৪) এত বিপুল পরিমান খাদ্যশস্য চোরাচালান হয়েছে বলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাতে জিয়া খুশি হতে পারেননি।
নূরুল ইসলামের মতে, “Estimates of massive smuggling of rice that Zia conveyed appeared improbable, considering the limited time involved and the poor state of roads and transportation systems in the boarder and adjoining areas in the early days of Bangladesh” (page 226)।
বলাবাহুল্য, চোরাচালানের প্রাধান্যের বিবেচনায় ধান-চাল ছিল ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম স্থানে (page 224)। সেই সময়, মানে ১৯৭৪ সালে, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রায়ান রেডা্নওয়ে নামক এক অর্থনীতিবিদ Bangladesh Institute of Development Studies স্বল্প সময়ের জন্য ভিজিটে আসেন। সেই সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালানের উপর এক গবেষণা করছিলেন তিনি। এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে তিনি উপসংহার টানেন এই বলে যে, “smuggling was not significant enough so as to run into hundreds of thousands of tons” (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh – An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, page 225)। তাহলে, খাদ্যশস্য চোরাচালানের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করে বলার কারণ কী? পেছনে কি জিয়ার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? এবং তিনি তা করেন এমন একটা সময়, যখন মার্কিন প্রশাসন পিএল ৪৮০ অধীনে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ নানা অজুহাতে প্রায় নয় মাস ঝুলিয়ে রাখে। শেষে কিউবার সাথে পাটের ব্যাগের ব্যবসা করার দায়ে খাদ্য সরবরাহ চুক্তি বাতিল করে দেয়, আর যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের তীব্রতায়। কী হতে পারে জিয়ার সেদিনের সে উদ্দেশ্য?
মজার বিষয় হলো, খাদ্যশস্য চোরাচালানের ব্যাপারে জিয়ার মতো তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরেরও একই বক্তব্য। তাহের ঠাকুর আখাউড়ার চোরাচালান সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে একটি রিপোর্ট দেন, তাতে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ ধান-চাল আগরতলা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
ঘটনাটা এমন। ১৯৭৪ সালের মে মাসের কোন একদিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কোন এক এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। সঙ্গে যাবেন তাহের ঠাকুর। বাইরে হেলিকপ্টার অপেক্ষায়। ঠিক সেই সময় মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান (মহাপরিচালক, বিডিআর) বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন করবেন বলে। যাবার সময় জেনারেল খলিলকে দেখেই বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘হ্যাঁ, ভাল কথা খলিল, চোরাচালানের কী অবস্থা বর্তমানে?’ (মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান-কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-৭৫, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬, পৃষ্ঠা ১১৪)। উত্তরে জেনারেল খলিল বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণেই আছে, স্যার’। শুনে বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘আখাউড়ার কাছে মুকুন্দপুর এলাকায় নাকি ট্রাকে ট্রাকে, গাড়িতে গাড়িতে ধান-চাল আগরতলা যাচ্ছে? যে এলাকার কথা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, সে এলাকাটি নিচু। তখন মে মাসের শেষ দিক। জায়গায় জায়গায় পানি। আর রাস্তাঘাট নেই। সংক্ষেপে খলিল বলেন, ‘না স্যার, কথাটা ঠিক নয়’। উত্তরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাহের ঠাকুর অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে জেনারেল খলিলকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘দেখুন জেনারেল সাহেব, আপনারা আমলারা যা বলবেন, তা সব ধ্রুব সত্য, আমরা রাজনীতিকরা যা বলব সবই মিথ্যা।’ (মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান– কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-৭৫, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬, পৃষ্ঠা ১১৪)। তাহের উদ্দিন ঠাকুরের কথা শুধু মিথ্যাই নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতও বটে! আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেদিন বুঝতে পারিনি তার এসবের উদ্দেশ্য।
তাহের ঠাকুরের বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত নতুন কিছু নয়। শুরু হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যারা গোপনে কোলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তাহের ঠাকুর তাদেরই একজন (মঈদুল হাসান, মূলধারা’৭১, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৬, ঢাকা)। এই গোপন যোগাযোগের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে পাশ কাটিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। খন্দকার মোশতাক, মাহবুব আলম চাষী, তাহের ঠাকুরসহ আরও তিন/চারজন সহযোগীদের এ ধরনের যোগাযোগের কথা পরবর্তীকালে হেনরি কিসিঞ্জার নিজেও স্বীকার করেন, “We establish contact with the Bangladesh people in Calcutta, and during August, September and October of this year <(1971)>, no fewer than eight such contacts took place (India-Pakistan, Background briefing with Henry A Kissinger on December, ’71, Congressional Record, December 9, 1971, page 45735)।
খন্দকার মোশতাক, মাহবুব আলম চাষী, তাহের ঠাকুর যে কোনো ধরণেরর ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তে জড়িত, তা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিও এড়ায়নি। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৪ এর ডিসেম্বরের শেষের দিকে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটলাম তখন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সম্মানে এক নৌ-ভ্রমণের আয়োজন করে। খন্দকার মোশতাক এবং তাহের ঠাকুর সেই ভ্রমণের সফরসঙ্গী ছিলেন। দূর থেকে বঙ্গবন্ধু তাদের ফুসফাস করতে দেখেন। কাছে গিয়ে দুই জনের দিকে লক্ষ করে বলেন, “… what are you up to and why are you always huddle together and engage in whispering campaigns? (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh– An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, page 165)।
জিয়ার আর তাহের ঠাকুরের খাদ্যশস্য চোরাচালানের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করে বলার উদ্দেশ্য কি একই সূত্রে গাঁথা? তাহলে কি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক গংদের সাথে জিয়ার যোগাযোগ ছিল?
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৪ অগাস্ট খন্দকার মোশতাক এবং তাহের ঠাকুরের সচিবালয়ে দেখা হয়। কথোপকথনের সময় মোশতাক তাকে বলেন, ‘এ সপ্তাহে জিয়া দুইবার এসেছিলেন। সে এবং তার লোকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। বলপূর্বক মত বদলাইতে চায়, প্রয়োজনবোধে যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত।’ (আসাদুজ্জামান- বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রথম আলো, ১৫ অগাস্ট, ২০১৮)। এসব কী প্রমাণ করে? খন্দকার মোশতাকের মতো জিয়াও কী বঙ্গবন্ধু হত্যার চক্রান্তকারীদের একজন? হতে পারে। তবে যুক্তিটা এতটা জোরালো নয়। আরও তথ্যের প্রয়োজন।
জিয়া যে শুধু খাদ্যশস্য চোরাচালানের পরিমাণের হিসেব দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন উপ-চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম সাথে দেখা করেন, তা নয়। জিয়া আরও একবার তার সাথে দেখা করেন। তবে তা গোপনে। আমার ধারণা এই সাক্ষাতের আলোচনার বিষয়বস্তু জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কি না, তা অনুধাবনে সহায়তা করবে। নূরুল ইসলাম নিজেও মনে করেন এই সাক্ষাৎ, “The most memorable meeting…”,? (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh– An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, page 167)। জিয়া এবং নূরুল ইসলামের সাক্ষাৎ ঘটে গোপনে, জিয়াউল হক নামে নূরুল ইসলামের এক বন্ধুর বাসায়। সাক্ষাতের সময় তারা দুজন ছাড়া বাসায় আর কেউ উপস্থিত ছিল না। ঘটনাটা ঘটে ১৯৭৪ এর শেষ দিকে, নূরুল ইসলামের বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে। তিনি যে বিদেশে যাচ্ছেন, তা ইতিমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। তাদের সাক্ষাতের বিষয়বস্তু ছিল খুবই সুংক্ষিপ্ত। জিয়াও জেনেছেন নূরুল ইসলামের দেশ ছেড়ে যাবার কথা, তাই তাকে না যাবার জন্য রাজি করানোই ছিল এ সাক্ষাতের মূল বিষয়। জিয়া বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘নিকট ভবিষ্যতে’ দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা এমন থাকবে না। নূরুল ইসলামের ভাষায়, “He (Zia) was confident that in the not too distant a future, the situation would improve and the prevailing drift and uncertainty would disappear” (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh– An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, page 168)।
নিঃসন্দেহে জিয়ার এই বক্তব্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। জিয়া কিভাবে জানেন যে, ‘নিকট ভবিষ্যতে’ দেশে পরিবর্তন আসন্ন? জিয়ার এ মন্তব্য নূরুল ইসলামকেও বিস্মিত করে। তিনি বলেন, “I was surprised by the tenor of his talk and the confidence with which he spoke about the restoration of political and economic stability.…. particularly by his confidence that in not ‘too distant’ a future….” (Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh – An Economist’s Tale, The University Press Limited, Dhaka, 2003, pages 168-169)। এত দৃঢ়তার সাথে বলতে পারার উৎস কী? তাহলে জিয়া কি জড়িত বঙ্গবন্ধু হত্যার চক্রান্ত প্রক্রিয়ার সাথে? (আমার জানা মতে নূরুল ইসলাম এখনও জীবিত এবং সম্ভবত আমেরিকায় অবস্থানরত। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন ঘটনাটি যাচাইয়ের জন্য)।
এই প্রবন্ধের শুরুতে বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। প্রবন্ধের শেষেও লিফশুলজ এর লেখা একটি ঘটনার অবতারণা করছি। ঘটনাটি ঢাকায় একটি ডিনারকে ঘিরে যা সংঘটিত হয় ১৫ অগাস্টের ৭ থেকে ১০ দিন পূর্বে। লিফশুলজ বলেন, “এই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন মোট ছয়জন ব্যক্তি। ১৯৭৫ সনে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে অবস্থিত সিআইএ স্টেশন প্রধান ফিলিপ চেরি এবং তার স্ত্রী, জেনারেল জিয়া এবং তার স্ত্রী, এবং ডিনারের নিমন্ত্রণকর্তা (হোস্ট) এবং তার স্ত্রী। ঘটনার বিবরণের ভিত্তিতে লিফশুলজ দাবি করেন, “Zia and Cherry seems to know each other.” (Lawrence Lifschultz, A long road in search of the truth- August 15, 1975, Dhaka Tribute, 14th August, 2018)
তার ভাষ্য মতে, সেই রাতে ডিনারের আগে এবং পরে দীর্ঘ সময় ধরে চেরি-জিয়ার মাঝে নিমন্ত্রণকর্তার বাসার বাগানে বসে কথোপকথন চলে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হতে পারে, তা বোঝা একজন সচেতন মানুষের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। লিফশুলজ তার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মন্তব্য করেন, “The evidence increasingly points to the fact that Zia was one of the principal architects of the coup and played a much more significant role than Khondaker Mustaque Ahmed.” (Lawrence Lifschultz, A long road in search of the truth – August 15, 1975, Dhaka Tribute, 14th August, 2018)।
উপরের বিভিন্ন তথ্য এবং ঘটনার বিশ্লেষণের ফলাফল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জেনারেল জিয়ার জড়িত থাকার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের সত্যতাই হয়তো প্রমাণ করে।
লেখকঃ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক
(আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)
এমএস/
আরও পড়ুন