১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তাকে গণহত্যার সামিল
প্রকাশিত : ১১:৩৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০
পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের উদয় ঘটেছে। এদের মধ্যে যারা তাদের সংগ্রামের ফসল হিসেবে সৃষ্টি করেছেন একটি রাষ্ট্র, একটি জাতিসত্তা। উল্লেখযোগ্যভাবে বলা যায়-জর্জ ওয়াশিংটন, মোস্তফা কামাল পাশা, মহাত্মা গান্ধী, হো চিন মিন, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভারাসহ আরও অনেকে। এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন রাষ্ট্রের। আরও উন্নত দেশ ও স্বজাতি সত্তার বিকাশের এবং অধিকার আদায়ের। ঠিক তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের।
আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি মানবের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে কালজয়ী মহাপুরুষদের অনেকেরই প্রাণ দিতে হয়েছে কিংবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিশ্বে রাজনৈতিক হত্যার অন্যতমগুলো হলো ভারতের মহাত্মা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চিলির সালভাদর আলেন্দে, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং ও জন এফ কেনেডি, মিয়ানমারের জেনারেল অং সান ও সিংহলের প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক, ঘানার নক্রুমা, ইন্দোনেশিয়ার আনোয়ার সাদাতসহ আরও অনেকে।
কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ছাড়িয়ে যেটি সবচেয়ে বর্বরোচিত সেটি হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদেরকে হত্যাকাণ্ড। এটি কোন ব্যক্তি হত্যাকাণ্ড বলা যায় না, এটি হচ্ছে সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে তার পূর্বের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং এই জাতিসত্তা যার হাত ধরে বিশ্বে প্রকাশ পেয়েছে সেই জাতিসত্তার পরিচয় মুছে ফেলার জন্য এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। তাই এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বুক থেকে একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার সমূলে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস ছিল। এটি আরও পরিষ্কার হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই হত্যার মাস্টারমাইন্ড ও পরবর্তী সুবিধাভোগী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি বিশ্বের বুকে একটি জাতিসত্তাকে অমর করেছেন। যিনি বিশ্বের বুকে এঁকেছেন একটি মানচিত্র, দিয়েছেন জাতীয় পতাকা, এক বছরের ব্যবধানে দিয়েছেন একটি সার্বভৌম সংবিধান। যিনি তার রাজনীতির শুরুতে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করেছেন বাঙালি জাতির ভাষার অধিকার। যেটি বিশ্বের বুকে একমাত্র বিরল ইতিহাস। যিনি অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি ছাত্র সংগঠন। তিনি ছিলেন এমন নেতা, তিনি যা মুখে বলতেন তা অন্তরে বিশ্বাস করতেন। যিনি একটি কোট পরতেন যেটি ‘মুজিব কোট’ নামে পরিচিত, আর এই মুজিব কোটের ছয়টি বোতাম ছিল তার রচিত ছয় দফার প্রতীক। তিনি যা মুখে বলতেন তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেন। তার এই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল বাঙালির ভালোবাসা এবং বাঙালির প্রতি গভীরতম ভালোবাসার প্রকাশ।
‘বাংলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি, আমার মাটি। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার। আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি।’ (১৮ ফেব্রুয়ারি১৯৭৩,চাঁদপুরে দেওয়া ভাষণ)। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের ভিত্তি। মননে মগজে, চলনে বলনে যিনি ছিলেন একজন পুরাদস্তুর বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী রূপ লাভ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহতম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় ঘাতকের দল।
ঘাতকের দল অনুধাবন করে ফেলেছিল বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাঙালি জাতির স্বর। বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের ইতিহাসের ১৫০০ শত বছরের ব্যর্থতার ইতিহাসকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়ানোর ইতিহাস। তাই তারা ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যা করেনি, তারা সেই সাথে বঙ্গবন্ধুর রক্তের যত উত্তরাধিকার ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমান। হত্যাকারী বলতে আমরা শুধু মঞ্চের কিলারদেরই চিনি, কিন্তু নেপথ্যের নায়করাও থাকে। তেমনি জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিল নেপথ্যের নায়ক। এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাকে’ আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন-‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরই আমার মনে হয়েছিল, সিআইএ তাদের আসল লোকটাকে মাঠে নামায়নি। ফারুক, ডালিম, মোশতাককে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রথম পর্যায়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করেছে মাত্র।’
কিলার কর্নেল ফারুক সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাসকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল জেনারেল জিয়া, কারণ সে কলঙ্কিত ছিল না। বহু কষ্ট করে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়াউর রহমানের সাথে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ করি। জেনারেল জিয়া বললেন-আমি একজন সিনিয়র অফিসার, আমি এভাবে জড়াতে পারি না। যদি তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এটা করতে চাও, এগিয়ে যাও।’
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিলিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় দেশটির সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’কে।
উল্লেখ্য, তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জারের ফরেন এনিমির তালিকায় ছিল চিলির সালভাদর আলেন্দে, ভিয়েতনামের থিউর ও বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। আর প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় সেনাবাহিনী দিয়ে। সামরিক চক্রান্তকারীদের পক্ষে মেজর রশিদ হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্বের(মোশতাক) সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং মেজর ফারুক যোগাযোগ করেছেন অন্যান্য সহকর্মী ও তার গুরু ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে। ১৯৭৬ সালে সংক্ষিপ্ত গোপন বিচারের জবানবন্দীতে কর্নেল তাহের বলেন,‘দিন কয়েকের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মুজিব হত্যার পেছনে রয়েছে পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল দুই কিলার মেজর ফারুক ও রশিদ। জেনারেল জিয়া ছিলেন মেজর ফারুকের চাইতে ১৩ বছরের সিনিয়র। ১৯৬৫ সালে ফারুক ও রশিদ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং রিসালপুরস্থ সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন। ঐ সময় জেনারেল (মেজর) জিয়া ছিলেন সেখানকার একজন প্রশিক্ষক। সেই একডেমীতেই জিয়ার সাথে ফারুক ও রশিদের পরিচয় ও আন্তরিকতার সূত্রপাত। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর এজেন্ট হয়ে নভেম্বর মাসে তারা ভারতে প্রবেশ করে। সন্দেহবশত কর্নেল ওসমানী তাদের গ্রহণ করলেন না, কিন্তু তাদের আশ্রয় দিলেন তাদের প্রশিক্ষক মেজর জিয়া। জিয়ার মাধ্যমে তারা ঢুকে গেলেন বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন ‘জেডফোর্সে’।
পূর্বেই আলোচনা করেছি বিশ্বে বহু রাষ্ট্রনায়কের হত্যাকাণ্ডের কথা, কিন্তু কিভাবে জেনারেল জিয়া এই হত্যার মূল কুশীলব ও এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার গণহত্যার সামিল তা আলোচনা করছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘ঘাতকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অহংকারকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’ মূল ব্যাপারটি এখানেই।
হত্যাকারীরা শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারতো। মূলত তাদের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু নয়, তাদের লক্ষ্য আরও সুদূর পরাহত ছিল। তারা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীন হওয়া বাঙ্গালিদের ওপর তাদের মূল ক্ষোভ ছিল। তাই তারা চায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে থাকুক। থাকলে এই রক্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। এজন্য এই হত্যাকাণ্ড ছিল বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন ঘটনা। এ জন্য বিশ্বের বুকে ঘটে যাও দুই একটি হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করা দরকার।
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমকে ১৯৮৬ সালে হত্যা করা হয়। সিনেমা হল থেকে স্ত্রীর সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় পালমেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল পেছন থেকে। ওইদিনই নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদায় জানিয়েছিলেন ওলফ পালম। অথচ ওইদিন তার পাশেই ছিলেন তার স্ত্রী তাকে হত্যা করা হয়নি।
সালভাদর আলেন্দে ১৯৭০ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম মার্কসবাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৩ জেনারেল আগুস্তো পিনোশের নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। পিনোশের অনুগত সেনা ও বিমান হামলার পর আলেন্দের মৃতদেহ প্রেসিডেন্ট প্যালেসের ভেতরে পাওয়া যায়। অথচ প্রেসিডেন্ট ভবনে তার স্ত্রী-সন্তানদের অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়।
পাত্রিস লুমুম্বা ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি। তিনি ছিলেন বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতা ও সাহিত্যিক। তার আসল নাম ছিল এলিয়াস ওকিত আসম্বো। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লুমুম্বা ও কাসাভুবুকে পদচ্যুত করা হয়। ডিসেম্বরে গ্রেফতার হন লুমুম্বা। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি লুমুম্বাকে। এরপর কঙ্গো চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে।
ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী বিশ্বব্যাপী যার পরিচিতি ইন্দিরা গান্ধী নামে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও মা কমলা নেহেরুর একমাত্র সন্তান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। একটি খারাফ সময়ে শক্ত হাতে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিষাদময় পরিণতি বরণ করতে হয় তাকে। পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়ার প্রতিশোধস্বরূপ ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ভারতের চার বারের প্রধনামন্ত্রী ইদন্দিরা গান্ধী। ওইসময় তার পরিবারের ওপর কোন হামলা করা হয়নি।
অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের ইতিহাসের ভয়াবহ নিষ্ঠুর ও জগন্যতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির জনকের সহধর্মিণী মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জাতির জনকের জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তাদের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ আরও অনেককে। এই হত্যাকাণ্ডে মস্তক বিদীর্ণ করা হয়েছিল ছোট্ট শিশুর, হত্যা করা হয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে। অবাধে হত্যা করা হয়েছিল নারীদেরকে। তছনছ করা হয়েছিল বাঙালির তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বঙ্গবন্ধুর বাড়িকে। মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিজয়কে ড. কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতো।
আর বাংলাদেশে হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ১৯৭১ সালে আমেরিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে মোশতাক স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তবে কিসিঞ্জার-ভুট্টোদের পছন্দের আসল লোকটি হচ্ছে জিয়াউর রহমান। আর এ জন্যই মোশতাককে ডামি হিসেবে ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির গদিতে বসিয়ে ৮০ দিনের মাথায় তাকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো হয় জিয়াকে। জিয়ার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করা হয়। এটা ঠিক যে, সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান নেপথ্যে থেকে মদদ না দিলে কোনভাবেই মুজিব হত্যা সম্ভব হতো না। খুনিদের মদদদাতা, আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা ও পুরস্কারদাতা ছিলেন এই জিয়াউর রহমান। আবীর আহদের ভাষায় বলা যায়, ‘যেকোন দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের অন্তরালে থাকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব। এ নিরিখে ১৫ আগস্টের ক্ষমতার পালাবদল কার্যক্রমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সার্বিক রাজনৈতিক ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হলেন খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। অর্থাৎ মোশতাক-জিয়ার যৌথ নেতৃত্বেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল সংঘটিত হয়।’
কেন অবাধে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্রসহ সবাইকে? এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কিলার মেজর রশিদ এর কথায় স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৮৬ সালে দেওয়া ভারতীয় লেখক সলীল ত্রিপাঠিকের একটি সাক্ষাৎকারে। আর এই সাক্ষাতকারের ওপর ভিত্তি করে করে সলীল ত্রিপাঠি একটি বই লিখেন ‘দ্যা কর্নেল হু উড নট রিপেন্টঃ দ্য বাংলাদেশ ওয়ার এন্ড ইটস আনকোয়াইট লেগাসি’ এখানে পাওয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী মেজর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মুজিবের শিশু পুত্রটিকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? তার স্পষ্ট উত্তর ছিল আমরা চাইনি মুজিবুরের রক্তের কেউ বেঁচে থাকুক। এই বংশটি আমাদের জন্য হুমকিস্বরুপ ছিল। তার এই জবানীর মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় তাদের ক্ষোভ এই জাতিসত্তার ওপর ছিল প্রবল। তারা কোনভাবেই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে পারেনি। তারা মেনে নিতে পারেনি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
কেন এই হত্যাকাণ্ড একটি জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার ওপর গণহত্যার সামিল তা বোঝানোর জন্য একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। তা হচ্ছে ওয়াং চেং, চীনের চ’ইন বংশের চতুর্থ সম্রাট। যিনি চীনের ডিউক অব চ’ইন চীনের প্রাচীন চৌবংশকে ক্ষমতাচ্যূত করে রাজসিংহাসনে বসেন খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫ সনে। তিনি গদিতে বসে নিজেকে চীনের প্রথম সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শিহ হুয়াং তি নাম ধারণ করেন। শিহ হুয়াং তি মানে ‘প্রথম সম্রাট’। তারপর চীনের দুই হাজার বছরের ইতিহাসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নেমে পড়েন। শিহ সদম্ভে বললেন-চীনের ইতিহাস আমাকে দিয়েই শুরু। আমিই চীনের প্রথম সম্রাট। এভাবে তিনি চীনের দুই হাজার বছরের বিভিন্ন রাজবংশের অসংখ্য শাসককে ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেন। চীন ভূখণ্ডে কোন পূর্বসূরির স্মৃতিকে তিনি সহ্য করতে পারেন নি। এমনকি কনফুসিয়াসের ধর্মীয় বইগুলো সরকারি রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি হবেন স্মরণীয়-বরণীয় এই লক্ষ্যেই কাজ করে গেছেন ডাণ্ডার জোরে, রক্তচক্ষুর শাসানিতে আর নরহত্যার মাধ্যমে।
ঠিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। যিনি এসেই বাঙালির ১৫ শত বছরের অমোঘ বাঙালি সত্তাকে বাদ দিয়ে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামক এক তত্ত্ব। যিনি পাকিস্তানি কায়দায় ফেরত আনেন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ নামক নতুন সুর, যিনি খুব দ্রুততার সাথে নিধন করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতার ইতিহাস শুরু করেন ২৭ মার্চ দিয়ে। বাঙালি কৃষ্টি কালচারকে চিরতরে ঝেঁটিয়ে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওয়াং চেনের কায়দায় জিয়াউর রহমান শুরু করেন বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতার ইতিহাসকে নিজের ঝুলিতে নেওয়ার। অসংখ্য ঘটনা ঘটে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করার, বিভ্রান্তি ছড়ানোর, জবরদখল করার এবং শাসককুলের মনগড়া ইতিহাস রচনার।
একটি জাতিগোষ্ঠীকে যারা স্বমূলে ধ্বংসের প্রয়াসে সেদিন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল অনেক পরে হলেও তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি এই হত্যাকাণ্ডের মূল কুশীলব মোশতাক ও জিয়ার। এদের মরণোত্তর বিচার এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের বিচারও করতে হবে। এদের বিচারও হবে কারণ সেদিন পরম করূণাময়ের ইচ্ছায় বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধু কন্যা, যিনি ধ্বংস্তুপে দাঁড়িয়ে উড়ান সৃষ্টির পতাকা। তিনি মরণের মিছিলে দাঁড়িয়ে জয়গান গান জীবনের।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং তার অদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। এই বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটাই কাম্য থাকবে যেন এই দেশের ওপর এই জাতিসত্তার ওপর আর কোন হায়েনারা যেন চোখ তুলে না তাকায়।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা।
এমবি//
আরও পড়ুন