ক্যাপ্টেন শেখ কামালের সামরিক জীবন
প্রকাশিত : ০৮:৪৯, ৫ আগস্ট ২০২১
২০১৭ সালে আমার সৌভাগ্য হয় বাংলাদেশ ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ভারতের কলকাতার অনুষ্ঠিত ‘মুক্তিযোদ্ধা সম্বর্ধনা ও বিজয় দিবস উদযাপন’এ অংশ নেয়ার। তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ফোর্ট উইলিয়াম ইস্টার্ন কমান্ড সামরিক যাদুঘর পরিদর্শন। এখানে সংগৃহীত রয়েছে ভারত বর্ষে সংঘঠিত বিভিন্ন যুদ্ধের ছবি, যুদ্ধাস্ত্রের সংগ্রহ এবং বিরল সব দলিল পত্র। যাদুঘরের বাংলাদেশ সেকশনে পা ফেলতেই চোখ আটকে গেল বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সের প্যারেডে ওপেন অর্ডার ফরমেশনে দাঁড়ানো অফিসারদের একটি ছবিতে। ছবির প্রথম সারির সর্ববামে দাঁড়িয়ে আছেন একজন টগবগে তরুণ অফিসার, বড় একজোড়া গোঁফ, স্টাইলিশ কালো ফ্রেমের চশমা, মেদহীন সুঠাম দেহ আর আত্মবিশ্বাসী চাহনি । তিনি আর কেউ নন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। সুদর্শন তরুণ অফিসারের ছবিটি আজও আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। ছবিতে আরও ছিলেন, অয়াকিজ্জামান, নিরঞ্জন, আবুল হোসেন, দিদার, মইন, সামাদ, ফিরু, আজিজুল, কামরুল স্যার সহ বাংলাদেশ প্রথম ওয়ার কোর্সে কমিশন প্রাপ্ত ৬১ জন চৌকশ সেনা অফিসার।
ক্যাপ্টেন শেখ কামাল একজন উদ্যমী সৃজনশীল ও প্রাণবন্ত সেনা অফিসার ছিলেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতের শিলিগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে কমিশন পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অস্ত্র ধরেছেন, তেমনি সংগীত, নাটক, ক্রীড়া, সামাজিক কাজেকর্মে অনুকরণীয় দৃষ্ঠান্ত রেখে গেছেন, “An Officer Leading From The Front”. তাকে নিয়ে তাকে কিছু জানা অজানা বিষয় তুলে ধরলাম।
১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ ছেলে শেখ কামাল। ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল তার। তিনি ‘ছায়ানট’-এর সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন; ছিলেন মঞ্চ নাটক সংগঠক। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’। তিনি ছিলেন অভিনয় শিল্পী এবং ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স পাস করেন, শাহাদাৎ বরণকালীন সময় তিনি মাস্টার্সের শেষ বর্ষের পরীক্ষার্থী ছিলেন।
Officer Like Qualities’ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এই শেখ কামাল। তার অফিসার সুলভ গুণাবলী সহজেই নজর কাড়ত। কিন্তু শেখ কামাল হতে চেয়েছিলেন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি, তাই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ঢাকা কলেজে যখন পাকিস্তানী সেনা রিক্রুট দল মেধাবী ছাত্রদের বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল, শেখ কামাল নম্র ও আত্মবিশ্বাসের সাথে সেই পাকিস্তানী সেনা দলকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্থানে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য তুলে প্রশ্ন রাখলেন- কেন পাকিস্তানের সামরিক বীরত্ব পদক উর্দুতে দেয়া হয়? বাংলাতে কেন নয়। যে প্রশ্নের জবাব ছিলনা প্রতিনিধি দলের কাছে। তবে এরপর থেকে পাকিস্তানী গোয়েন্দা নজরে পড়েন শেখ কামাল।
তিনি ৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সংঘটক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখেন শেখ কামাল। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও রক্তের উত্তরাধিকার শেখ কামাল মুক্তিযদ্ধের জন্য ছাত্র ও যুবকদের সংঘটিত করতে থাকেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী কর্ণেল শওকত আলীর (সাবেক ডেপুটি স্পিকার) দিক নির্দেশনায় শেখ কামাল ও তানভীর ইসলাম তান্না ধানমণ্ডির শারিরীক শিক্ষা ইন্সটিটিউটে মাঠে রাত্রিকালীন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সেই প্রশিক্ষণ অনেকটা প্রকাশ্যেই চলতে থাকল। ’৭১ এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী সেনা অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করলে শেখ কামালদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা আগে থেকেই জানতেন, তাই সাথীদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। কলকাতার বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের প্রথম অফিসার ওয়ার কোর্সের জন্য প্রাথমিক ও শারিরীক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। শুরু হল ক্যাডেট কামালের সামরিক জীবন।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ও ভারত সরকারের সমঝোতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার ট্রেনিং সেন্টার করা হল ভারতের জলপাইগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে, শুরু হল বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স -১ এর অফিসার ট্রেনিং। ভারতীয় সেনা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার টি ডে যশই ছিলেন ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ডেন্ট আর কর্নেল দাস গুপ্তা ছিলেন চিফ ইনসট্রাক্টর। ৬১ জনের এই কোর্সের মনোবল বা Course Morale ছিলেন ক্যাডেট কামাল। মূর্তি ক্যাম্প ছিল ঘন অরণ্যে দুর্গম এলাকায়, বৃষ্টি বহুল এই ক্যাম্পে মশা, মাছি, জোক ছিল সাধারণ বিষয়, প্রায়ই থাকত বাঘ কংবা বন্য হাতির আতঙ্ক। থাকা খাওয়ার কষ্ট, কঠোর প্রশিক্ষণ এসব নিয়ে প্রশিক্ষনার্থীদেরদের সকল অভিযোগ আর ক্লান্তি দূর করে দিতেন ক্যাডেট কামাল। মুক্তির গান, কবিতা কিংবা গল্পে মাতিয়ে রাখতেন পুরো দলকে, তিনি জানতেন কী করে দলকে প্রাণবন্ত রাখতে হয়। ভাল ইংরেজী জানতেন তাই ভারতীয় প্রশিক্ষক ও দেশী প্রশিক্ষনার্থীদের মাঝে সেতু বন্ধন করতেন ক্যাডেট কামাল। সফলতার সাথে প্রশিক্ষণ শেষে, শেখ কামালসহ প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ৬১ জন ক্যাডেট কমিশন লাভ করলেন। ৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে পাসিং আউট প্যারেডের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসারদের কমিশন হল। কমান্ডেন্ট এবং চিফ ইনসট্রাক্টর শেখ কামালের প্রশিক্ষণ রেজাল্ট নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন, তার কোর্স রিপোর্ট এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স-২ এর কারিকুলামও ঠিক করা হয়। কমিশনপ্রাপ্তরা লেফট্যানেন্ট হিসেবে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করলেন। এরই মধ্যে সেন্সেটিভ এপয়েনমেন্টের জন্য প্যানেল গঠিত হল, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার লেফটেন্যান্ট কামাল কে মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল ওসমানির এডিসি নিযুক্ত করল। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন ক্যাপ্টেন শেখ কামাল।
‘দিকে দিকে ওড়ে মুক্তি পতাকা, মুক্তি বাহিনী তোল আওয়াজ, শহীদ হবার দিন চলে গেছে, সকলে হব গাজী যে আজ।’
দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ কামাল স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী ছেড়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলেন কিন্তু Once a Soldier, Always a Soldier. বেসামরিক জীবনেও শেখ কামাল ছিলেন গভীর দেশ প্রেমিক। তার দেশপ্রেম ও সৃজনশীলতা যেন সামরিক প্রশিক্ষনে আরও দূর্বার ও অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের আবার পড়ালেখা শুরু করলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলেন।
শেখ কামাল ছিলেন সমাজ সচেতন অফিসার তিনি খেয়াল করলেন ৭১ এর পরাজিত শক্তিরা এক জোট হয়ে ছাত্র যুবকদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। সে অবস্থা থেকে তরুণদের মুখ ফেরাতে তিনি খেলাধুলার দিকে নজর দিলেন। আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে আধুনিক ফুটবলের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন শেখ কামাল। তিনি প্রথম বিদেশি ফুটবল কোচ বিল হার্ট কে আবাহনীতে নিযুক্ত করেন। ১৯৭৩ সাল তখন ক্লাব তো দুরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশী কোচ ছিলোনা। শেখ কামাল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন পুরো উপমহাদেশের ফুটবলে।
ক্রিকেটও খুব প্রিয় ছিল তার, ভাল ফাস্ট বোলিং করতেন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শেখ কামাল প্রথম বিভাগের লীগে খেলেছেন সেসময়। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্কেটবল দল ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
এই মানুষটি ১৯৭৪-এ প্লাবনের খবর পেয়ে স্থির থাকতে পারেন না, তাই রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতে।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল বিবাহ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী, দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে। তাঁর হাতের মেহেদির রঙ না মুছতেই ৭৫ এর ১৫ অগাস্টের ভয়াল রাতে জিয়া- মোস্তাকের ঘাতক বাহিনীর হাতে তিনি শহীদ হন। সেই রাতে ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধও করেছিলেন শেখ কামাল। আর তাই প্রথম গুলিটা লাগে তার বুকে, তিনিই প্রথম শহীদ হলেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে আমরা হারালাম সম্ভাবনাময় ইউথ আইকন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল কে।
তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করছি, ‘স্যালুট ক্যাপ্টেন কামাল’।
লেখক : সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস; সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সূত্র : আ.লীগ’র ওয়েবসাইড
এসএ/
আরও পড়ুন