শেখ কামাল : আজন্ম স্বপ্নযোদ্ধা ও বিরল প্রতিভা
প্রকাশিত : ১০:১৮, ৫ আগস্ট ২০২১
মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। যাপিত জীবনের পরিধি তাই মূখ্য নয় সবসময়। মাত্র ২৬ বছরের কর্মময় জীবনই তাই যুগ যুগান্তরে বাচিয়ে রাখবে শেখ কামালকে। খুব কাছ থেকে শেখ কামালকে দেখেছেন এমন অনেকের মুখেই তাঁর অতিসাধারণ চলাফেরা, বিনয়ী আচরণ, পরোপকারী মনোভাব, পিতার পরিচয়কে পুজি করে কখনো নিজেকে জাহির না করার কথা জেনেছি। একজন শেখ কামাল কেবলমাত্র তার নিজস্ব মেধা, প্রতিভা, নেতৃত্বগুন, মননশীলতা, সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় যায়গা করে নিতে সক্ষম, নিয়েছেনও।
৬৬ কিংবা ৬৯ এ পিতা মুজিব যখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর তখনই পুত্র কামাল পিতার স্বপ্নের সারথী হয়ে স্বপ্ন বুনে চলেছেন আপন মনে- একটি সংস্কৃতিমনা সমাজ এবং বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে মাথা উচু করে দাড়ানো বাংলাদেশ বিনির্মানের। বহুমাত্রিক অনন্য প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল তাই তার ২৬ বছরের ছোট্ট জীবনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে যে শক্ত ভীত রচনা করেছিলেন তার উপরে দাড়িয়েই বাংলাদেশ আজ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের জ্বলজ্বলে নাম। আর সংস্কৃতির বিকাশের কারনেই নানান সময়ে রাস্ট্রীয় প্রচ্ছন্ন পৃষ্টপোষকতায়ও বাংলাদেশকে পূর্ণ গ্রাস করতে পারেনি ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ।
১৯৪৯ সালের ৫ আগষ্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ সন্তানের মধ্যে তাঁর অবস্থান ২য়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরেই জন্ম হয়েছিলো তাঁর। খুব ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় প্রচন্ড আগ্রহী শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুলে পড়াকালীন স্কুলের প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন। এর মধ্যে ক্রিকেটটা তাকে সবচেয়ে বেশী টানতো। ছিলেন দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার। প্রচন্ড গতি আর নিখুঁত লাইন লেন্থ দিয়ে হরহামেশাই কাবু করতেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদেরকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম সম্ভাবনাময় উদীয়মান পেসার হওয়া স্বর্ত্বেও কেবলমাত্র বাঙালি হবার কারনে এবং শেখ মুজিবের পুত্র হবার কারনে চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছিলেন। ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন দীর্ঘদিন।
ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেকে বিস্মৃত করেন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও। ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের মেধাবী ছাত্র শেখ কামালের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা থিয়েটার। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’র তিনি ছিলেন প্রধান সংগঠক। যেখানে স্বাধীনতা-উত্তর তরুণ সমাজের সৃজনশীলতা হয়েছিল অবারিত।
সুঅভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যঅঙ্গনে যেমন সুপরিচিত ছিলেন তেমনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেনও ছিলেন। বাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার হলের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল তার থাকাকালীন পুরোটা সময়।
ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শেখ কামাল সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। গান, খেলাধুলা, অভিনয় আর আড্ডা যাঁর প্রাণ সেই ব্যক্তিই আবার সভা-সমিতি করে মুজিবপন্থী ছাত্রলীগকে সঞ্জীবিত করেছিলেন।
স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরেই আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে ১৯৭২ সালে সংস্থার নামে কেনেন ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল। ক্রিকেট আর হকির দল কেনেন ইস্পাহানী স্পোর্টিংয়েরটা। এগুলোর সমন্বয়ে নতুন যাত্রা শুরু হয় আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামে একটা ক্লাবের।
ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শেখ কামাল। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেই লক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন সবক্ষেত্রেই। উপমহাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মত আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছিলেন সব খেলার খোলনলচে।
দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে তৈরি করছিলেন নতুন দিনের জন্য, সেই সময় আপাত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। স্বপ্ন কিন্তু এখানেই শেষ নয়, দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে সেটা বহুদূরে বিস্তৃত ছিলো তাঁর। আজ তাঁর সেই স্বপ্নবোনা সিড়ি বেয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে আলোকিত নাম টিম বাংলাদেশ।
আর ফুটবলে তো রীতিমত বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন শেখ কামাল। দূরদর্শিতা আর আধুনিকতার অপূর্ব সমন্বয়ে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন গোটা উপমহাদেশে। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশী কোচ বিল হার্ট কে এনে ফুটবল প্রেমিকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! তখন ক্লাব তো দুরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশী কোচ ছিলোনা। আর তাইতো ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘আই এফ এ’ শীল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশী কোচ আর পশ্চিমা বেশ ভুষা দেখে সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকদের চোখ ‘ছানা বড়া’ হয়ে যায়! শেখ কামাল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন পুরো উপমহাদেশের ফুটবলে। হকিতেও নতুন দিনের সূচনা করেছিলেন তিনি। যোগ্যতা, দক্ষতা আর দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফুরনে এই মানুষটা বদলে দিচ্ছিলেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশের পুরো ক্রীড়া ক্ষেত্র। শুধু ক্রীড়াই নয়, শিল্প সাহিত্যের সব শাখা পুনর্গঠনে তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও শেখ কামালের ছিল দীপ্ত পদচারণা। আইয়ুব খান দেশে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে শেখ কামালও অন্যদের সঙ্গে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ছায়ানটের যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে নিয়মিত সেতার বাজানো শিখতেন। কেবল নিজেই সংগীতচর্চা করেননি, একইসঙ্গে অন্যদেরও উৎসাহিত করেছেন সমানভাবে। নিয়মিত মঞ্চনাটক করা শেখ কামাল অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন কলকাতার মঞ্চেও। স্বাধীনতার পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আন্দোলনের মাধ্যমে নাট্যাঙ্গনে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সেখানেও অগ্রণী ভুমিকা ছিলো তাঁর।
অথচ যারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাস্ট্র প্রমাণে মরিয়া ছিলো তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বেছে নিয়েছিল তার সন্তানদের। যে শেখ কামাল ছিলেন মাটির মানুষ, কেউ কোনোদিন কোন সাহায্যে তার কাছে এসে বিফল মনোরথে ফিরে গেছেন বলে তার শত্রুরাও কোনোদিন বলতে পারবে না, সেই শেখ কামালের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ফাঁদলো একের পর এক সাজানো মিথ্যে বানোয়াট গল্প। যে গল্পের নিখুঁত পরিবেশনায় কোন ফাঁক ছিল না, অকল্পনীয় নিরেট মিথ্যায় মোড়ানো সেই গল্পগুলো যে মিথ্যে ছিল তা ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়েছে জাতির কাছে।
৭১-এ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও শেখ কামালের কপালে জুটেছিলো মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার অপবাদ।
ডালিমের বউ অপহরণের মিথ্যা অপবাদও জুটেছিলো শেখ কামালের কপালে। ডালিম নিজে সেই অপহরণ সম্পর্কে তার “যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি” বইতে পরিস্কার লিখে গেলেও শেখ কামালের সেই অপবাদ ঘোঁচেনি!
অপহরণ ঘটনার দিন ঢাকা লেডিস ক্লাবে ডালিমের খালাতো বোন তাহমিনার বিয়ে চলছিলো। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও রেডক্রসের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবারসহ অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক অতিথিবৃন্দ। ডালিমের কানাডা ফেরত শ্যালক বাপ্পির চুল টানা নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেদের সাথে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। বিষয়টা সেখানেই নিস্পত্তি হয় না। গাজী গোলাম মোস্তফা সশস্ত্র লোকজন নিয়ে ক্লাবে এসে ডালিম, ডালিমের বউ নিম্মী ও তাদের পরিবারের আরো কয়েকজনকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিলো।
শেখ কামালের বিরুদ্ধে আরেকটা ডাহা মিথ্যাচার হলো ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ। ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসের আগের রাতে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সিরাজ শিকদার তার দলবল নিয়ে এসে শহরের বিভিন্নস্থানে হামলা চালাতে পারে। এ অবস্থায় সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিতে থাকে। সর্বহারা পার্টির লোকজনের খোঁজে শেখ কামালও তার বন্ধুদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডি এলাকায় বের হন। সিরাজ শিকদারের খোঁজে টহলরত পুলিশ মাইক্রোবাসটি দেখতে পায় এবং আতংকিত হয়ে কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই গুলি চালায়। শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ হন। গুলি শেখ কামালের কাঁধে লাগে। তাকে তখনকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
যে জিপটিতে শেখ কামালরা দুষ্কৃতকারীদের ধরতে গিয়েছিলেন সেটি কার ছিলো জানেন? বর্তমান বিএনপির নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর এবং সেদিন জিপটি টুকুই ড্রাইভ করেছিলেন। এই ঘটনাটি পরদিন ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’ এ প্রকাশিতও হয়। দৈনিক মর্নিং নিউজের তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত প্রতিথযশা সাংবাদিক এ.বি.এম.মুসা।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক পিটাল হেজেল হার্স্টকে এই নিরেট মিথ্যে বানানো গল্প খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলে তিনি বলেছিলেন " একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির প্রয়োজন কি? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই তাকে টাকা এনে দেবে"।
অপপ্রচার রয়েছে শেখ কামাল নাকি তৎকালীন স্বনামধন্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকিকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। শেখ কামাল সুলতানার প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেটা তাকে জানিয়েওছিলেন সত্যি। কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে যাননি। রীতিমতো দুই পরিবারে মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে হয়। সুলতানা কামালের বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী দবির উদ্দিন আহমেদ।
শেখ কামালের শৈশবের হৃদয়স্পর্শী স্মৃতি উঠে এসেছে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বড় বোন শেখ হাসিনার লেখায়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এর ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- "একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমিতো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইলো। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।"
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামের লেখায় উল্লেখ করেছেন- “১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেফতার হন। আমি তখন খুবই ছোট্ট আর আমার ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সে সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়।
কামাল তখন অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা-আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম।
অনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না।”
প্রতিভাবান তরুণ শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী, দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল বিবাহ করেন। খ্যাতনামা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল সারাদেশে ‘গোল্ডেন গার্ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাতের মেহেদির রঙ না মুছতেই স্বামীর সঙ্গে তিনিও ১৫ অগাস্টের ভয়াল রাতে শহীদ হন।
ক্ষণজন্মা শেখ কামাল বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের প্রতিটি সাফল্য কিংবা এগিয়ে চলার ভিত্তি রচনাকারী। শেখ কামালরা বারবার পৃথিবীতে আসে না। একবার এসেই যে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে যায় তার উজ্বলতা অটুট থেকে সময়ের প্রয়োজনে উজ্বলতর হয়ে ওঠে। আর সেই জ্বলজ্বলে আলো জুড়েই থাকে শেখ কামালদের উপস্থিতি।
ঘাতকের বুলেট একজন শেখ কামালকে, একজন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পুত্রকে মৃত বানাতে পারে। তবে ক্রীড়া, শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা সৃষ্টিশীল তারুন্যের ইতিবাচক সকল কর্মকান্ডে শেখ কামাল চিরভাস্বর।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপ-কমিটি।
সূত্র : আ.লীগ’র ওয়েবসাইড
এসএ/
আরও পড়ুন