এক মুক্তপ্রাণ যুবকের জন্মদিন
প্রকাশিত : ১০:২৬, ৫ আগস্ট ২০২১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহিদ হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ কামাল এ দেশের ক্রীড়া ও সংস্কৃতিজগতের এক উজ্জ্বল নাম। সংগঠক হিসেবে তিনি অতুলনীয়। তারই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়া চক্র, আজকের আবাহনী লিমিটেড। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীের প্রধান সংগঠক শেখ কামাল বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যচর্চার অন্যতম পথিকৃত্। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী ত্যাগ করে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যুবমানস গঠনে অধুনিক চিন্তা ও সৃজনশীলতার কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেখ কামাল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রথম শহিদ।
বিধাতার কী নিষ্ঠুর বিধান যে বাঙালির শোকাবহ আগস্টেই শহিদ শেখ কামালের জন্মদিন। বুকে পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে আজ আমরা তাকে শুভেচ্ছা বা শ্রদ্ধাই কেবল জানাতে পারি। মনের বিশাল দরজা-জানালা খুলে দিয়ে উদাত্ত স্বরে বলতে পারি না ‘শুভ জন্মদিন’। সবাই মিলে গাইতে পারি না, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ শেখ কামাল’।
বছর পাঁচেক আগে শেখ কামালের সঙ্গে যারা নানা কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তারা সম্মিলিত হয়ে তার জন্মদিন পালন করেছিলেন ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায়। জন্মদিন পালনে জাতীয় প্রেসক্লাবে সতীর্থ-স্বজনেরা একটি স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এ উপলক্ষ্যে অল্প দিনের প্রস্তুতিতে একটি মুদ্রিত সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশনার শিরানোম ছিল, ‘উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশে উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত হিসেবে এসেছিলেন। চেয়েছিলেন এ দেশের যুবমানস নতুন ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে। খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সংগীত ভুবন থেকে জাতীয় রাজনীতি—সবখানেই তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন। নতুন প্রতিভা অন্বেষণ করতেন। সবাইকে সমানভাবে আগ্রহ জোগাতেন। বন্ধুবত্সল, পরোপকারী শেখ কামালের সততা, রুচির পরিচ্ছন্নতা, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও প্রগাঢ় নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় তার কর্মযজ্ঞের প্রতিটি পদক্ষেপে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষ নেতৃত্বের গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যথার্থ যুবনেতা। শেখ কামালের চরিত্রের বহুমাত্রিকতা আজকের দিনের সকলের জন্য শিক্ষণীয়।
‘উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’ প্রকাশনাটি খুব বড় কলেবরে করা সম্ভব হয়নি প্রধানত আর্থিক সামর্থ্যের কারণে। কিন্তু প্রকাশনাটি সমৃদ্ধ হয়েছিল বেশ কয়েকটি অর্থবহ লেখায়। তথ্যবহুল লেখকের তালিকায় ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থেকে শুরু করে ডাকসুর কর্মচারী গোপাল চন্দ্র দাস এবং শহিদ মধুদার ছেলে অরুণ দে পর্যন্ত। সবচেয়ে তথ্যবহুল এবং সংরক্ষণে রাখার মতো নিবন্ধনটি লিখেছিলেন বন্ধু ড. হাবিবুল হক খোন্দকার। তার নিবন্ধে অনেক অজানা তথ্য ছিল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির অভ্যন্তরীণ আবহ সম্পর্কে। তথ্য ছিল শেখ কামাল এবং তার নববিবাহিতা স্ত্রী কৃতী ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল সম্পর্কে। ড. খোন্দকার ছিলেন শেখ কামাল এবং সুলতানা আহমেদ খুকীর সহপাঠী। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে একসঙ্গে পড়তেন। খোন্দকার হাবিবের লেখা থেকে জানা যায় শেখ কামাল এবং সুলতানা খুকী লেখাপড়াতেও মেধাবী ছিলেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তাদের আরেক সহপাঠী তওরিদ হুসেইন বাদলকে যখন ‘উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’-এর জন্য একটি স্মৃতিকথা লেখার অনুরোধ করা হলো তখন বাদলের তাত্ক্ষণিক উত্তর ছিল, শেখ কামালের কোনো স্মৃতি নাই। শেখ কামাল আমার কাছে জীবনভর জীবন্ত। উত্তর শোনার পর আমি দ্বিতীয়বার আর তাকে অনুরোধ করি নাই। বাদল হয়তো যথার্থই বলেছে। বন্ধুদের কাছে শেখ কামাল ফ্রেমে বাঁধানো কোনো ছবি নয়। সুদূরের নীহারিকাও নয়। শেখ কামালকে নিয়ে কিছু বলতে কিংবা লিখতে তাই স্মৃতি হাতড়াতে হয় না। এতটাই জীবন্ত, এতটাই সত্য তার উপস্থিতি বন্ধুদের কাছে, ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। দুই সহোদরার কাছেও নিশ্চয় সেরকমই। তবে সহোদরাদ্বয়ের দুঃসহ কষ্ট যে সবাইকে ছাপিয়ে, সবকিছুকে ছাপিয়ে—সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যতই বলি না কেন, শেখ কামাল স্মৃতি নয় চিরজীবন্ত, বাস্তব তো তা বলে না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের করিডরে, টিএসসির মাঠ, মধুর ক্যান্টিনের সামনের রাস্তায়, আবাহনীর নেটে, স্পন্দনের রিহার্সালে অথবা ছাত্রলীগের কার্যালয়ে কোথাও যে সেই প্রণবন্ত যুবকটিকে আজ দেখি না। আগস্টের পনেরোর যেই উজ্জ্বল প্রভাতে উজ্জ্বল শেখ কামালকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজানো-গোছানো আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ভীষণ ব্যস্ত থাকার কথা নিশ্চিত ছিল, সেই প্রভাত থেকেই যে তিনি মর্ত্যের পৃথিবীতে নেই। চোদ্দোর রাতে যিনি বললেন—‘দেশি, ঘরে যাও কাইল তো সকাল সকাল আসতে হবে।’ সেই নির্দেশদাতাই পনেরোর সকাল সকাল নেই হয়ে গেলেন। মানা যায় না। মানা সম্ভবও নয়। তবু ভাবি, কী ভীষণ কঠিনকে মেনে নিয়ে পেরিয়ে এসেছি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়। এবং বন্ধু বাদলের মতোই বলি, শেখ কামালের কোনো স্মৃতি নেই, শেখ কামাল জীবন্ত। কবির ভাষায়—সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে।
শেখ কামালের সঙ্গে আমার পরিচয় রাজনীতির ক্ষেত্রে। ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। দুজনেই তখন একই বর্ষের ছাত্র। তবে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শেখ কামাল ঢাকা কলেজে আর আমি ফরিদপুরের স্বনামধন্য রাজেন্দ্র কলেজে। পরিচয়ের দিন থেকেই আমরা পরস্পর পরস্পরকে ‘দেশি’ বলে সম্বোধন করতাম। ছাত্রলীগের বন্ধনের বাইরে আমাদের দেখা হতো ক্রিকেটের মাঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার মঞ্চে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ব্যাচটা সম্ভবত সর্বশেষ র্যাগ ডে উদ্যাপন করেছিলাম শেখ কামালের নেতৃত্বে। সকাল থেকে রং খেলা এবং বিকালে কলাভবনের সামনে মঞ্চ বানিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সে সময়কার অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়ক দুলাল ভৌমিকের নেতৃত্বে জগন্নাথ হল অর্জন করল প্রথম পুরস্কার। পুরস্কার নিয়ে যখন সদলবলে হলে ফিরছি তখন আমাদের আনন্দমিছিলে ঢুকে গেল শেখ কামাল। ভাবখানা এমন যে, সেও জগন্নাথ হলের ছাত্র। নির্মল আনন্দের স্রোতে মুহূর্তে গা ভাসিয়ে দেওয়ার এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গি শেখ কামালের মতো আর কখনো দেখিনি। সবার মধ্যে, সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সহজাত এবং ঈর্ষণীয় গুণ ছিল শেখ কামালের। বর্তমান সময়ের সকল ক্ষেত্রে যা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ’—কবিগুরুর এই অসাধারণ বাণীর যথার্থ রূপকার যেন ছিলেন শহিদ শেখ কামাল।
লেখার শুরুতেই বলেছি যে, ১৫ আগস্টের রাতে শেখ কামাল ছিলেন বত্রিশ নম্বরের প্রথম শহিদ। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কর্তব্যরত সেই কালরাতের সাক্ষী মোহিতুল আলমের মুখে শুনেছি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হূদয়ছেঁড়া ঘটনার বর্ণনা। বর্বরতার দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে মোহিতুল আলম অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না। শুনতে শুনতে চোখের জল আটকানো আমার পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
শহিদ শেখ কামালের জন্মদিনে শোকের পদাবলি লিখে ঘনিষ্ঠজনদের হূদয় ভারী করা উচিত নয়। তবু সত্য যে কঠিন এবং কঠিনকে ভালোবেসেই আজ তার জন্য সবাই মিলে ফুলের ডালা সাজাই। হাজার তারার মালা গেঁথে বুকে পাথর বেঁধে বলি—‘শুভ জন্মদিন’। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ শেখ কামাল’।
লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, একুশে টেলিভিশন
এসএ/
আরও পড়ুন