ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কোথায় লুকোই নিজেকে?

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১০:৪৩, ৫ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১১:০০, ৫ আগস্ট ২০২১

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

কামাল, আজ তোর জন্মদিন। জানি, তোর জন্মদিন উপলক্ষে আমার এ শুভেচ্ছা বার্তা কোনো দিনই তোর হাতে পৌঁছবে না। কিন্তু তবু বড় মায়ায় তোকে লিখছি।

তোর বয়স আজ ৭২ হলো। আমরাও সে সংখ্যা ছুঁই ছুঁই করছি। আসল ব্যাপার কি জানিস, দিন-মাস-বছর পেরিয়ে আমাদের বয়স বেড়েছে কিন্তু তুই ওই ২৫-এ রয়ে গেলি। দ্যাখ না, আমাদের বুড়ো বয়সের ছবি আছে, তোর কিন্তু ২৫-এর পরে কোনো ছবি নেই। তোর বয়স ২৫-এর পরে বাড়ল না, আর আমরা বয়সের সেতুতে একটার পর একটা সেতু স্তম্ভ পার হয়ে এলেম। তোকে দেখে আমার হিংসা হয়, বুঝলিরে চিরযুবা?

মনে আছে, বয়সে একটু বড় বলে তুই আমাকে কী বলতি? বলতি, ‘আমি বড়, আমাকে পা ধরে সালাম করবি।’ বেশির ভাগ দিনই তাচ্ছিল্য করতাম। একদিন দুষ্টু বুদ্ধি চাপল মাথায়। লাইব্রেরির চাতালে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই গল্প করছি—ছেলেরা-মেয়েরা মিলে। যেই আমার কোন এক কথায় তুই বললি, ‘এ্যাই, আমি তোর বড়। আমাকে পা ধরে সালাম করবি।’ যেই না বলা, আমি মাটিতে বসে পড়ে দু’হাত বাড়িয়ে তোর দুই পা জড়িয়ে ধরলাম। আর মুখে কান্নাজড়িত ভয়ার্তস্বরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, ‘আমারে মাফ কইরা দেন।’

চারদিকে পথ চলতি ছাত্রছাত্রীরা ভিড় জমাল। সবাই ভাবল, কামাল বোধহয় আমাকে শাসিয়েছে, আর তাই বোধহয় আমি ওর মার্জনা ভিক্ষা করছি। ঘটনা পল্লবিত হতে ৩ মিনিটও লাগল না। তুইও ততক্ষণে বুঝে গেছিস যে, কী বিপদে তুই পড়েছিস! এমনভাবে তোর হাঁটুসহ পা আমি ধরেছি যে, পা তুই ছাড়াতে পারছিস না। বেশি জোরাজুরি করলে তুই পড়ে যেতে পারিস! তখন তুই অনুনয়-বিনয় করতে লাগলি, ‘ছেড়ে দে, প্লিজ ছেড়ে দে। আর কখনো বলব না।’ বহু বলা-কওয়ার পরে আমি তোর পা ছেড়ে দিয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালে তোর প্রথম কথা ছিল, ‘তুই একটা মিচকা শয়তান।’ সারা জীবনে বহু অভিধায় অভিহিত হয়েছি আমি, কিন্তু আমাকে আর কেউ ‘মিচকা শয়তান’ বলেনি।

মনে আছে আরেকদিনের কথা? সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের চাতালে তুঙ্গ আড্ডা দিতে দিতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে গেছে টেরও পাইনি। মাটিতে এলিয়ে পড়া বেড়ালের মতো নরম রোদের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আড্ডাধারীরা সব লাফিয়ে উঠলাম। উঠতে হবে এবং যেতে হবে ছাত্রাবাসে ও বাড়িতে। প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তুই জিজ্ঞেস করলি, ‘হলে গিয়ে তো খাওয়া পাবি না এখন। খাবি কোথায়?’ পপুলারে চলে যাব, মৃদুস্বরে বলি আমি। পপুলার রেস্তোরাঁ সময়ে-অসময়ে আমাদের খাবারের অন্যতম শেষ ভরসা। ‘না, এ অবেলায় পপুলারে যেতে হবে না। আমাদের ওখানে চল, যা আছে দুজনে ভাগাভাগি করে খাব’—তুই বললি।

৩২ নম্বরে তোর ঘরে পৌঁছানোর পরে দেখি, দোতলার চাতালে বেতের চেয়ারে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধু তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে। তার হাতে জ্বলন্ত পাইপ। সামনের দুটো চেয়ারে বসে আছেন বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও প্রফেসর মুশাররফ হোসেন। সেরনিয়াবাত সাহেব তখন খুব সম্ভবত পানিসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী এবং স্যার সদ্য পরিকল্পনা কমিশন ছেড়েছেন। দুজনের কাছেই আমি পরিচিত—সেরনিয়াবাত সাহেবের কাছে বাবার কারণে এবং প্রফেসর হোসেনের কাছে তার ছাত্র বলে।

সেরনিয়াবাত সাহেব আমাকে দেখেই বলেছিলেন, ‘আরে, তুমি এখানে?’ তারপর আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বঙ্গবন্ধুর দিকে ফিরে বললেন, ‘আমাদের প্রফেসর সিরাজুল হক সাহেবের ছেলে।’ বাবার নামটি শুনে বঙ্গবন্ধু আধা মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলেন। তারপর চোখ খুলে আমার দিকে বলে উঠলেন, ‘তোমার আব্বার সিভিকস আর ইকোনমিকসের ওপরে দুটো পাঠ্যবই আছে না?’ আমি হতবাক! আমার মুখে কোনো কথা ফুটল না।

আমার অবস্থা দেখে স্যার বলে উঠলেন, ‘আমার ছাত্র। খুব ভালো ছেলে।’ এবার তোর পালা। ‘ইকোনমিকসে আমাদের ফার্স্টবয়’, বন্ধুগর্বে তোর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায়। তারপর পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে স্মিতমুখে আমাকে বললেন, ‘তোমারে একটা কথা জিগাই। ঠিক ঠিক জবাব দেবা কিন্তু।’ ততক্ষণে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। বুঝলাম না কী প্রশ্ন তিনি করবেন। ভাবলাম, যদি ঠিক জবাব না দিতে পারি, তাহলে বাবার বন্ধুকে ও আমার শিক্ষককে কী একটা লজ্জায় ফেলে দেব আমি। আর কি অপদস্থ হব আমি জাতির পিতার সম্মুখে! নিঃশ্বাস চেপে কোনোক্রমে বললাম, ‘জি।’

মনে আছে তোর, বঙ্গবন্ধু তার কৌতুকভরা চোখ আমার দিকে তুলে রহস্যভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বাবা, তুমি তো ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র। খুব স্বাভাবিক, কামাল তোমার লগে বন্ধুত্ব করতে চাবে। কিন্তু আমারে কও তো ক্যান তুমি কামালের লগে বন্ধুত্ব করতে চাও?’ আমি একমুহূর্ত ভাবলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘বন্ধুত্বে অন্য কোনো বিষয়-বিবেচনা গৌণ, বন্ধুতাই মুখ্য।’ এটুকু বলতেই আমার জিভ শুকিয়ে গেল।

আমার জবাব শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেল। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুখোড় ছাত্র আপনার।’ তারপর তোকে আর আমাকে সস্নেহ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘যা, তোরা খা গিয়া।’ ঘর থেকে বের হতে হতে শুনেছিলাম, তিনি প্রফেসর মুশাররফ হোসেনকে বলছেন, ‘প্রফেসার সাব, পোলাটারে দেইখ্যা রাখবেন।’ তারপর সারা দিন এবং তার পরের দিনগুলো কেমন করে গেল, তা আমার মনে নেই। আমি যেন হাওয়ায় ভাসছিলাম। অপার এক আনন্দে আমার সারা মন ভেসে যাচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধুকে আমি শুধু একদিনই কাছে থেকে দেখেছি, একদিনই ক্ষণিকের জন্য তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। একদিনই এবং একবারই মাত্র সেটা ঘটেছে। ওই একদিনই তো আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি, যার স্মৃতি আমি চিরদিনই হৃদয়ে বহন করব। কামাল, এ অনিন্দ্যসুন্দর স্মৃতিটি তোর জন্যই সম্ভব হয়েছিল।

আজ তোর জন্মদিন। একটা কথা দিয়ে শেষ করি। ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্টের রাতের কথা। আমার নেতৃত্বে সলিমুল্লাহ হল ১৯৭৫ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃহল বিতর্ক জিতেছে সবে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনজুড়ে সে কী উত্তেজনা! মঞ্চের ওপরে সাদুর কাঁধে আমি—হাতে আমার সেই বিশাল শিরোপা। মঞ্চের ঠিক নিচে তুই। এক হাতে আমার কাছ থেকে শিরোপাটি নিচ্ছিস আর অন্য হাতে আমার হাত ধরে আছিস, যাতে আমি পড়ে না যাই। ওই মুহূর্তটিই ক্যামেরাবন্দি করে ফেললেন সে সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য চিত্রগ্রাহক প্রয়াত আজমল হক।

হয়তো এটাই তোর জীবনের শেষ ছবি। পুরো ছবিটার একটি বিষয় আমাকে বড় বেশি টানে। ওই যে আমাকে ধরে আছিস, আমাকে রক্ষা করছিস সম্ভাব্য পতন থেকে। কারণ আর তিন রাত পরেই খুনিরা যখন তোর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল বড় অকালে, তখন তো আমি তোর হাত ধরতে পারিনি, তোকে রক্ষা করতে পারিনি। এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি, পৃথিবীর কোন অন্ধকার গহ্বরে আমি লুকোই?

তোরই,
সেলিম

এনএস//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি