ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

কৃষক অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু ও সমকালিন বাংলাদেশ

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশিত : ১৫:৫৩, ১৩ আগস্ট ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃষকবান্ধব নীতিমালা এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডের ওপর আলোকপাত করে একটি নিবন্ধ লিখেছে। ‘কৃষক অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু ও সমকালিন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধটি নীচে তুলে ধরা হলো-

‘শোকের এই মাসে বঙ্গবন্ধুর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সময় গ্রামের দুঃখী মানুষগুলোর কথাই বেশি করে মনে পড়ে। নগরের এই কোলাহল থেকে বহু দূরে তিনি শান্তিতে শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় টুঙ্গিপাড়ায়। কাছের মানুষের মাঝেই। প্রতিদিনই তারা তাঁকে স্মরণ করছেন তাদের অন্তরের গভীরতম তল থেকে। তিনি যে প্রকৃতিরও বড় আপনজন। 

তো অন্ধকার সেই দিনগুলোতে গোলাপ ও পলাশ বলে দিয়েছিল কবি নির্মলেন্দু গুণকে তিনি যেন শেখ মুজিবের কথা তাঁর কবিতায় বলেন। আরেক কবি মহাদেব সাহা বলেছিলেন তিনি তো ‘বাংলাদেশের আড়াইশত নদী’। ‘ধন্য সেই পুরুষের’ নামের ওপর ‘ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া’ বলে দাবি করেছেন আমাদের অন্যতম কবিশ্রেষ্ঠ শামসুর রাহমান। আসলেই তিনি আমাদের ইতিহাসের বরপুত্র। 

আমাদের ভবিতব্য। নীল আকাশ ভেদ করে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ নামের দেশটিকে সৃষ্টি করার জন্য। ছিলেন তিনি কৃষক সন্তান। সেজন্যই তিনি অভাজনদের বানিয়েছেন এই রাষ্ট্রের মালিক। 

তিনি বাঙালিকে খুবই ভালোবাসতেন। পুরো মানব জাতিকেও একইভাবে গভীর আন্তরিকতায় ভালোবাসতেন। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছিলেন- ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। কৃষক অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে গ্রাম-বাংলার ছিলো গভীর সংযোগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভাষায় ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয় মাছ ধরে কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত।’ (শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনি, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৬)।

তাই, সারাজীবন তিনি ছিলেন কৃষকের পাশে। কি রাজনৈতিক পথচলায় কিংবা দেশ পরিচালনায়। রাজনৈতিক জীবনের গোড়া থেকেই তিনি কৃষক স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। কর্ডন প্রথার কারণে বিপাকে পড়া মৌসুমী কৃষি শ্রমিক তথা ‘দাওয়াল’দের ন্যায্য আন্দোলন সংগঠিত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। জমিদারদের শোষণ থেকে পূর্ব বাংলার কৃষকদের মুক্ত করতেই মূলত তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৪ ও ১৯৫৬-এই দুই দফায়ই স্বল্প মেয়াদে মন্ত্রীত্ব পেয়ে গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়নে তিনি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পাকিস্তানের গণ-পরিষদে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, গ্রামাঞ্চলে খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা এবং গ্রাম বাংলার বৃহত্তর প্রশ্নে সবচেয়ে সরব আইনপ্রণেতা হিসেবে তাঁকে দেখা গেছে। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় নগরে ছুটে আসা বিপর্যস্ত অভুক্ত গ্রামীণ মানুষগুলোকে বাঁচাতে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। রাতদিন খেটেছেন তাদের বাঁচানোর জন্য।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং গ্রাম বাংলার মানুষের বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে এর আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব পুরোপুরি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণেই তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩-এ আরমানিটোলা মাঠে আয়োজিত জনসভায় উচ্চারণ করেছিলেন ‘ভাষা-আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগরিক অধিকার চাই।’ 

দেশের বাইরে গেলেও তিনি তাঁর দুঃখী মানুষের কথা ভুলতে পারেননি। তাই, বিপ্লবোত্তর চীন সফরের সময় ঐ দেশের সম্পদের ওপর গণমানুষের কর্তৃত্ব তাঁকে আলোড়িত করেছিলো। এ নিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনিতে লিখেছেন ‘চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করেছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল, অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর, আর তারা যেন কেউই নন। ফলে, দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।’ চীনের আমূল ভূমিসংস্কার তাঁর মনে দারুন প্রভাব ফেলেছিল। সে কারণেই হয়তো কৃষি-নির্ভর সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে যথার্থভাবেই ভূমি সংস্কারকে চিহ্নিত করেছিলেন মূখ্য দাবি হিসেবে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে তাই তাঁকে বলতে দেখি-‘ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ^র্য্যরে অধিকারী রয়েছেন। তারা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। তাদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু, তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেবলমাত্র বেঁচে থকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে।’ 

১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহারের কৃষিবান্ধব প্রস্তাবনার মধ্যে ছিল জমির মালিকানার উর্ধ্ব সীমা নির্ধারণ এবং বাড়তি জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ। আর ছিল সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের শক্তি ও উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া তিনি চেয়েছিলেন তখনকার বিদ্যমান ভূমি কর প্রথায় আমূল সংস্কার (২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমিকে করের আওতামুক্ত) করে গ্রামীণ সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনতে। বনজ সম্পদ রক্ষা, চাষাবাদ, গবাদি পশুপালন এবং মৎস্য চাষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রস্তাবও জায়গা করে নিয়েছিল ঐ ইশতেহারে।

ঐ সব প্রতিশ্রুতির কথা তিনি কখনো ভোলেননি। তাই ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরই প্রথম বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না।’ এই দুটো লক্ষ্য পূরণের জন্যও তিনি কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার সুফল গ্রামোন্নয়নে আজও ভূমিকা রাখছে। বলা যায় বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তার অবদান অসীম।

সদ্য স্বাধীন দেশের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু তাঁর কৃষিবান্ধব প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়েন। তাই তো স্পষ্ট করে বলে দেন, ‘এই সম্পত্তি আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। কোন লোক একশো বিঘার ওপর জমি রাখতে পারবে না। এতে যে জমি উদ্বৃত্ত হবে তা ভূমিহীন গরীবদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। খাস মহলের জমি গরীবদের ছাড়া আর কাকেও দেয়া হবে না।’ (রাজশাহী মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ০৯ মে ১৯৭২)। কৃষি খাতে তিনি দিয়েছিলেন যথার্থ নীতি-মনোযোগ। তিনি জানতেন কৃষি দেশের বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিবে। কৃষি খাতেই সদ্য স্বাধীন দেশের শ্রমশক্তির বড় অংশ যুক্ত থাকবে। কৃষি থেকে আসবে শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্প পণ্যের চাহিদা। 

প্রত্যাশিত সামাজিক রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধুর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উৎপাদনের প্রক্রিয়াগুলোর সামাজিক মালিকানা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। সমবায়গুলো যাতে নিজস্ব অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা নির্ভর হয় (তাই আমলাতন্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত) সে রকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টনই ছিল মূল লক্ষ্য। স্থানীয় অবকাঠামো, সমাজকল্যাণ, এবং আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে সমবায়ের ভূমিকার কথা খোলামেলা ভাবেই তিনি বলেছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় এক-চতুর্থাংশ রাখা হয়েছিল কৃষি খাতের জন্য। কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের তিনি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন, পাশাপাশি কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন গবেষণার জন্য বার্কসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো বঙ্গবন্ধুও বিশ^াস করতেন যে কৃষির উন্নয়ন কেবল কৃষকের একার কাজ নয়, এ জন্য তাদের সঙ্গে ‘বিদ্বান ও বিজ্ঞানী’কেও যুক্ত হতে হবে।

কৃষির পুনর্বাসন ও বিকাশে নিয়েছিলেন অসংখ্য সময়োচিত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি। প্রথম বছরের মধ্যেই ১৭ হাজার টন বীজ বিনা মূল্যে ও ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। ১ কোটি সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন। ৪০,০০০ লো-লিফট পাম্প, ২,৯০০ গভীর নলকূপ, ৩,০০০ অগভীর নলকূপ স্থাপন করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কৃষি অবকাঠামো পুননির্মাণ এবং কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই সজাগ।

রাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন গ্রামীণ মানুষকে স্বনির্ভর করার অনুঘটক হিসেবে। সে জন্যেই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘রাষ্ট্র তোমাকে ঋণ দেবে, টাকা দেবে, ইনপুটস দেবে, তোমার সেচের ব্যবস্থা করে দেবে। সেটা করে দেবে যদি তুমি এ ধরনের সমবায় কর। সমবায়ের ফল দিয়ে যে উৎপাদনশীলতা বাড়বে তার সুফলটা যেমন পাবে জমির মালিক, তেমনি এটার অংশ পাবে যারা ভূমিহীন কৃষক, যারা ওখানে শ্রম দেবে তারা। যারা এখানে বিনিয়োগ করবে, তারাও এখানকার একটা অংশ পাবে।’ (২৬ মার্চ ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণে গ্রাম সমবায়ের রূপরেখার বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।

সে সময়কার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য তিনি দিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর ডাক। সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তিকে একই ছাতার নিচে আনা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করার উদ্দেশ্যেই তিনি এই আমূল সংস্কারবাদী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থায় সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয় দুটো ছিলো মূখ্য। পাশাপাশি গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থাপনাতেও সমবায় সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

নিজের দেশপ্রেম ও কর্মনিষ্ঠতাকে জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করাটিই ছিল তাঁর গ্রামোন্নয়ন কৌশলের মূলমন্ত্র। আর তাই তিনি আহ্বান করেছিলেন, ‘মবিলাইজ দ্যা পিপল। (সেচের জন্য) পাম্প যদি পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায়, তবে স্বনির্ভর হোন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। ... যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করার জন্য চিন্তার কী আছে?’  (১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা)।

এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল চালিকা শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের অগাধ আস্থা। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বে থাকা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. নরুল ইসলাম এভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্ভরশীলতাকে মূল্যায়ন করে বলেছেন- ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, বিশেষত: প্রধানমন্ত্রীর জনগণের মধ্যে অশেষ জনপ্রিয়তার কারণে, দলের কাঠামোর উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণক্ষমতার কারণে এবং তাঁর সুউচ্চ যাদুকরী ব্যক্তিত্বের কারণে দেশের ভেতরে অবস্থিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলির অথবা দলের ভেতরে অবস্থিত উপদলগুলির স্বার্থ সংঘাতকে একটি সঠিক ভারসাম্যের মধ্যে বজায় রাখা সম্ভব হবে।’

বঙ্গবন্ধুর রূপান্তরবাদি নেতৃত্বে সঠিক পথেই এগুচ্ছিলো দেশ। ১৯৭২ থেকে ৭৫-এর মধ্যেই মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে বেড়ে ২৭৩ ডলার হয়েছিলো। তাঁকে শারীরিকভাবে হারানোয় মুখ থুবড়ে পড়ে দেশ। মাথাপিছু আয় তাঁর শাসনামলের পর্যায়ে পৌঁছুতে লেগে যায় ১৩ বছর। হারিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সামাজিক সুবিচার। বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের পর দেশ আবার তাঁর দেখানো পথেই ফিরেছে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে অভাবনীয় গতি পেয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। স্বাধীনতার পর পর খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি টনের কম, বর্তমানে উৎপাদন তার তিন গুনেরও বেশি। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ দশম বৃহত্তম ফসল উৎপাদনকারি দেশ-ধানে তৃতীয়, সব্জিতে তৃতীয়, মাছে তৃতীয় এবং আমে সপ্তম। বর্তমানে প্রায় শতভাগ  চাষাবাদেই আধুনিক যন্ত্রাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষি কাজে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ পাইওনিয়ার (১৫ হাজারেরও বেশি সোলার ইরিগেশন পাম্প এখন সক্রিয়)। কৃষি রপ্তানিতে বিশেষত প্রক্রিয়াজাতকৃত কৃষি পণ্য রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে অমিত সম্ভাবনা। কৃষি গবেষণাও পেয়েছে নতুন গতি। এক দশকে ১০৯টি জলবায়ু-সহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। কৃষিকে জলবায়ু সহিষ্ণু করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

অর্থনৈতিক মন্দায় রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে শক্তিশালি কৃষি খাত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয়নি, কারণ কৃষি দাঁড়িয়ে আছে শক্ত ভিত্তির ওপর। গ্রামে অ-কৃষি খাতের বিকাশ ঘটেছে (৬০% আয় অ-কৃষি থেকে)। তাই উৎপাদন বাড়লেও মজুরি কমেনি। করোনায় শহর থেকে গ্রামে ফেরাদের ঠাঁই করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি। কৃষিকে রক্ষার জন্য দেয়া হয়েছে পর্যাপ্ত প্রণোদনা। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপকতা এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানধর্মী মুদ্রানীতির পাশাপাশি এবারের বাজেটেও ভর্তুকি ও অন্যান্য কৃষি বরাদ্দে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। 

পাশাপাশি সার্ক সিড ব্যাংক, ৪১ জেলায় কৃষকের বাজার ও সকল ইউনিয়নে সব্জি পুষ্টি বাগান এবং পারিবারিক পুষ্টিবাগানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে আরও ২,১০০ ফসলের জাত উদ্ভাবিত হবে, কৃষি উন্নয়ন ব্যয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে হবে ৪৩৮ বিলিয়ন টাকা। তাছাড়া কৃষিখাতে উদ্যোক্তা তৈরির প্রচেষ্টা তো আছেই। সব মিলিয়ে বহু বাধা পেড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর কৃষি ও পল্লীবান্ধব ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নের পথে দৃঢ় পায়েই এগুচ্ছে তাঁর বাংলাদেশ। কারণ, আমাদের জন্য ভরসার বাতিঘর হয়ে বিরাজমান তাঁর চিন্তা, কর্ম ও দর্শন। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবি বাবলু জোয়ারদরের ‘সে ছিল দিঘল পুরুষ, কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি।
‘হাত তুললেই
ধরে ফেলতো চাঁদ
আকাশের নীল
ধরে ফেলতো সপ্তর্ষীমণ্ডল কেমন অনায়াসে।
সে ছিল দিঘল পুরুষ
তার বুকের গভীর শব্দে
আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যেতো স্বদেশের মমতায়
আর সাড়ে সাত কোটি মানুষ হয়ে যেতো মন্ত্রমুগ্ধ
হেঁটে যেতো তার সাহসের সীমানায়’ 

লেখকঃ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

সূত্র : বাসস
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি