স্মৃতিচারণ : কিভাবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বিশ্বকে কাঁপিয়েছিল
প্রকাশিত : ২০:৪১, ২২ আগস্ট ২০২১
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। এরপর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিলম্বিত বিচারকার্যে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে বর্বরোচিত ওই হামলায় তৎকালীন ‘রাষ্ট্রী-যন্ত্রকে’ কাজে লাগানো হয়েছিল।
১৭ বছর আগের ওই ঘটনার পর্যালোচনায় এখন বেরিয়ে এসেছে যে, এই হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষ মনযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং এই ঘটনায় বিশ্বের প্রধান শক্তিধর ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো অত্যন্ত বিব্রত হয়েছিল, যা তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।
আন্তর্জাতিক এই চাপ তৎকালীন সরকারকে একটি তদন্ত শুরু করতে বাধ্য করেছিল। পরবর্তিতে বেরিয়ে এসেছে যে, এই ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতকারীদের রক্ষায় এটি ছিল একটি প্রহসনমূলক তদন্ত এবং এই হামলা পরিকল্পনার সাথে সরাসরি ৩৬ জন জড়িত ছিল। জঘন্য এই হামলায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন এবং আরো ৫শ’ জনের মতো আহত হন, যাদের অধিকাংশই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
সেই সময়ে সরকার যেভাবে এই হামলা-পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তাতে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাস একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। এতে সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তারা তাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তারা তখন ওই তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি তৎকালীন সরকারের ওই হামলা পরবর্তী পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক শক্তিধর দেশসমূহ ও পর্যবেক্ষকগণ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছিল। তারা এই তদন্তকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে করছিল এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছিল।’
তিনি উল্লেখ করেন, ওই হামলার পর সরকারের কোন উচ্চ-পদস্থ প্রতিনিধি, এমনকি কোন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রধানও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি। ‘আপনি যদি বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেও বিষয়টি বিবেচনা করেন, তাহলেও এটিকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হবে।’
ইমতিয়াজ আরো বলেন, এই ঘটনা ও আলামতগুলো দেখে এখন এটাই মনে হচ্ছে যে, একটি ভাঁওতাবাজির তদন্তের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই ওই পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছিল। আদালত এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও অপর প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ দুষ্কৃতকারীকে মৃত্যুদ-াদেশ এবং বর্তমানে ‘পলাতক’ আসামী ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের অপর জ্যেষ্ঠ নেতা (পলাতক) হারিস চৌধুরীসহ আরো ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেছে।
ওই হামলার স্পষ্টতই প্রধান লক্ষ্য ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ভয়াবহ ওই হামলায় তিনি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। তবে এতে তাঁর কানের ক্ষতি হওয়ায় কম শুনতে পান। এই হামলার বার্ষিকী পালনের প্রায় কাছাকাছি সময়েই এই মামলার রায় খুব শিগগিই কার্যকর হতে যাচ্ছে।
হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তাঁর সাথে কথা বলেন। এরপর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল তাঁকে ফোন করেন।
ঠিক ওইদিনই সন্ধ্যাবেলায় জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোশকা ফিশার এই হামলায় তার দেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এরপরে দিনগুলোতে জাতিসংঘ, ভারত, চীন ও ইউরোপীয় দেশগুলো এই ঘটনার নিন্দা জানায় এবং এই ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে। কোন কোন বিশ্লেষক বলেন, ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে এই হামলার ঘটনা তাদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করেছিল।
২২ আগস্ট তৎকালীন তুর্কী প্রধানমন্ত্রী নেকমেতিন এরবাকান, ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা এল কে আদভানি ও মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা রোকা শেখ হাসিনাকে ফোন করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারী কে টমাস ও ভারতীয় হাই কমিশনার বীনা সিক্রি পৃথকভাবে শেখ হাসিনাকে ফোন করে তাদের সমবেদনা জানান এবং তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় সকল নেতৃত্বকে হত্যার এই অপচেষ্টাকে ‘কমান্ডো স্টাইলে হামলা’ আখ্যায়িত করে বলেছিল, যদি এই হামলা সফল হতো, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারত।
ঢাকাস্থ ইউরোপীয় দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণও এক যৌথ বিবৃতিতে তৎকালীন সরকারের কাছে এই জঘন্য হামলার ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছিল।
২৩ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল শেখ হাসিনা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উভয়কেই তাদের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার্তা অবহিত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রীর ওপর হামলাকারীদের ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরে পাওয়েল ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে এই হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশর সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ওই দিনই যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র এক বিবৃতিতে বলেন, তিনি আশা করেন যে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এই হামলাকারী দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন।
নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানী ও ইতালি এবং শ্রীলংকার দূতগণও বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে নিজ নিজ সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন ও তাঁর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। পাকিস্তানের সিনেটর ইকবাল হায়দারও শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন। ২৪ আগস্ট, জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান হামলার ঘটনার পরের দিন এক বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী দূতাবাসগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে হামলার তদন্ত কার্যক্রমে সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে। এই ইস্যুটি তখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। গণমাধ্যমে বলা হয় যে বিদেশী কূটনীতিকরা লুৎফুজ্জামান বাবর আমন্ত্রিত একটি ব্রিফিংয়ে অংশ নিতেও অস্বীকৃতি জানান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৫ আগস্ট কমনওয়েলথ এর তৎকালীন মহাসচিব ডন ম্যাককিনন শেখ হাসিনার সাথে কথা বলেন।
একই দিন অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও বিবৃতি প্রদান করে। ক্যানবেরা এই ঘটনাকে জঘন্য হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করে জানায়, কোন যুক্তিতেই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন কূটনৈতিক কোরের ডিন শাহতা জারাবের নেতৃত্বে ১৯ জন রাষ্ট্রদূত ২৬ আগস্ট শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর মাধ্যমে তারা একটি নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তৎকালীন সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করেন।
ঢাকায় বিশেষত পশ্চিমা কূটনীতিকরা এই হামলার ঘটনার সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়ায় সন্দেহ পোষন করে ‘একটি নিরপেক্ষা তদন্তের জন্য’ চাপ দিতে থাকেন। সূত্র: বাসস
এসি
আরও পড়ুন